অমিত দেবনাথের জন্ম যে ভিটাটিতে, সেই জায়গায় এখন অথৈ পানি। মেঘনার বর্তমান তীর থেকে যার দূরত্ব ৫০০ ফুটের মতো। ১৯৮১ সালে যখন তাদের বসতভিটা-জমিজমা ভাঙনের মুখে পড়ে, তখন অমিতের বয়স বছর পাঁচেক। এক ঝটকায় সেই বছর ২৪ শতাংশ জমি হারায় তাঁর পরিবার। এখন তাঁর বাড়ি মেঘনাতীর থেকে প্রায় ৩৫০ মিটার দূরে। তবু ভাঙনের আতঙ্ক ছাড়েনি অমিতকে। এখনও এই আতঙ্ক তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর বাজার ও আশপাশের এলাকার লোকজনের কাছে কয়েক দশক ধরেই চেনা মেঘনার এই আগ্রাসী রূপ। এই বাজারেই ওষুধের দোকান অমিত দেবনাথের (৪৯)। তিনি বললেন, ভিটা হারানোর পরও জমি ছিল তাঁর পরিবারের। সেখানে ফসল হতো। এখন নদীর মাঝখানে চর। নদীর এই দিকবদলের কারণে তাদের এলাকায় কয়েক বছর ধরে বেড়েছে ভাঙনের তীব্রতা। বহু বছরের পুরোনো পানিশ্বর বাজারে এক সময় ৪০-৪৫টি চাতাল ছিল। এসব চাতালে কাজ করতেন কয়েক হাজার শ্রমিক। শত শত মণ চাল সরবরাহ হতো দেশের বিভিন্ন এলাকায়। একে একে মেঘনায় বিলীন হয়েছে প্রায় সব চাতাল। যে ক’টির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোও বন্ধ। ফলে পানিশ্বর বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য একরকম মৃত।
পানিশ্বর পালপাড়ায় ১০-১২ শতাংশ জমিতে ভিটা পারুল পালের (৪০)। নদী ভাঙতে ভাঙতে যেন হা করে আসছে তাঁর ভিটার দিকে। পারুল বললেন, চার-পাঁচ বছর ধরে ভাঙন খুব বেশি। যেভাবে ভাঙন এগিয়ে আসছে, আর বোধহয় বেশি দিন তারা এ বাড়িতে থাকতে পারবেন না।
একই পাড়ায় থাকেন অধীর চন্দ্র সূত্রধর। ৬৫ বছরের জীবনে নদীভাঙনের কারণে তাঁকে বাড়ি বদলাতে হয়েছে পাঁচ দফায়। অধীর বললেন, সাত-আট বছর ধরে পালপাড়ার পাশে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এই এলাকায় সূত্রধর পরিবার আগে ছিল ৫০-৬০টি। ভাঙনের শিকার হয়ে তারা গ্রামছাড়া। এখন সাকল্যে পাঁচ-ছয়টি পরিবার কোনোমতে টিকে আছে।
পানিশ্বর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মো.
এই রাজনীতিবিদের ভাষ্য, নিশিতে এলাকার বেশ কিছু চাতাল, ইটভাটা ও কয়েকশ বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিগত সরকারের সময় প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধের একটি প্রকল্প একনেক পর্যন্ত গেছে। কিন্তু আর আলোর মুখ দেখিনি। এদিকে দিন দিন ভাঙনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। এখনই টেকসই ব্যবস্থা না নিলে বাজারসংলগ্ন পানিশ্বর স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও বড় মাদ্রাসাটি নদীতে বিলীন হতে বেশিদিন লাগবে না।
মো. মোস্তফা ভাঙনের জন্য খননযন্ত্র (ড্রেজার) বসিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলাকেও দায়ী করেন। তিনি বলেন, ঈদুল আজহার কিছুদিন আগেই ওই এলাকায় কিছু লোক বালু তুলতে এসেছিল। এলাকাবাসী তাদের আটক করলে ড্রেজার না চালানোর অঙ্গীর করে ছাড়া পায়। এখন তারা সামান্য ভাটিতে ঠিকই বালু লুট করছে। ফলে পানিশ্বর এলাকায় ভাঙন ঠিকই চলছে।
একই ওয়ার্ডের বর্তমান সদস্য সাদু মিয়া এলাকাটি রক্ষায় বেড়িবাঁধ দ্রুত নির্মাণের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘নদীভাঙনের কারণে পানিশ্বর বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা ভাব আর নেই। ৪০-৫০টি বয়লার (চাতাল) নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পাঁচ-ছয়টি ব্রিকফিল্ডও গেছে।’ ১০-১২ বছরে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে সাদু মিয়া বলেন, বহু পুরোনো এই জনপদ ও বাজারটি রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ ড্রেজারগুলো বন্ধ করতে হবে।
প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল মেসার্স আজমেরী রাইস মিলের চাতালটি। সেটির মালিক নূরুল ইসলাম নূরু সম্প্রতি মারা গেছেন। তাঁর ছেলে উজ্জ্বল মিয়া বললেন, বাবার চাতালটি নদীভাঙনের শিকার হতে শুরু করে ২০১৮ সালে। চলতি বছরই সব জমি নদীর পেটে গেছে। এসব কারণে সব মিলিয়ে তাদের ব্যবসার চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে ভাঙনের শিকার হতে শুরু করে চৌধুরী রাইস মিলটি। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ওসমান চৌধুরীর ভাষ্য, এ পর্যন্ত নদীভাঙনে তাঁর চাতালের তিন-চতুর্থাংশ জমি (প্রায় ৪০ শতাংশ) বিলীন হয়ে গেছে। বাকি জমিও নদীতে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সব মিলিয়ে তাঁর প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। চাতাল নদীতে চলে যাওয়ায় ৫০ লাখ টাকার বকেয়া তিনি পাননি। তবে পাওনাদারের টাকা ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে। তিনি প্রাচীন এ জনপদ রক্ষায় দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
সরাইলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশাররফ হোসাইন সরেজমিন এসব এলাকায় গেছেন। তিনি বলেন, জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী তাঁকে জানিয়েছেন, জরুরি ভিত্তিতে ওই এলাকার জন্য ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। স্থায়ী বেড়িবাঁধের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। মেঘনা নদীতে স্বীকৃত কোনো বালুমহাল নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা অবৈধভাবে ড্রেজার বসাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে শিগগির ব্যবস্থা নেবেন।
জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুর আহাম্মদের কাছ থেকে জানা গেছে, জরুরি ভিত্তিতে তিনটি প্যাকেজে ওই এলাকার ছয়টি পয়েন্টে ২২ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হবে। এতে ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। জুলাইয়ের মধ্যেই এই কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন।
পাউবোর হয়ে এ কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোসার্স ঊর্মি ট্রেডার্স, মেসার্স এসবি এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স দিয়া এন্টারপ্রাইজ। ঊর্মি ট্রেডার্সের প্রতিনিধি মো. মুজাহিদ জানিয়েছেন, তাদের কার্যাদেশে ৩০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। এই প্যাকেজে ৮ হাজার ৩৮১টি জিও ব্যাগ ফেলার কথা। ২৭ জুন থেকে কাজ শুরু করেছেন। ১০-১২ দিনের মধ্যেই কাজটি শেষ করতে পারবেন।
স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ বিষয়ে মঞ্জুর আহাম্মদ বলেন, ২০২১ সালে তীর সংরক্ষণ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় সেটি ফেরত আসে। ২০২৩ সালের জুন থেকে প্রায় এক বছর মেঘনা নদীর ১৫টি পয়েন্টে সম্ভাব্যতা যাচাই করে পাউবো। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের মে মাসে ৯৬৭ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে সেটি বোর্ড সভায়ও যাচাই-বাছাই হয়েছে। প্রকল্পটির প্রক্রিয়া চলছে। এর আওতায় পানিশ্বর এলাকায় ১ হাজার ৩৫০ মিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব আছে। এতে ৭৫ কোটি টাকা খরচ হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় প ন শ বর ব জ র ব ল ন হয় র ব যবস প রকল প পর ব র এল ক র এল ক য় ম ঘন র র এল ক বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
আ’লীগের অগ্নিসন্ত্রাসের প্রতিবাদে শহরে মহানগর বিএনপির বিক্ষোভ
আওয়ামী লীগের অগ্নিসন্ত্রাসের প্রতিবাদ ও মানবাধিকার অপরাধে অভিযুক্ত শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি।
এসময়ে বিক্ষোভ মিছিল থেকে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দেয়, “ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই” খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই, শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকল্পিত করে তোলে পুরো শহর।
সোমবার ( ১৭ নভেম্বর) সকাল এগারোটায় শহরের মিশন পাড়া হোসিয়ারি সমিতির সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। বিক্ষোভ মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে দুই নম্বর নগরভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
এদিকে বিএনপির মিছিলকে সফল করতে সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আওতাধীন সদর থানা, বন্দর থানা, বন্দর উপজেলা ও বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড বিএনপি ও যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিকদল, মহিলাদল, ওলামাদলসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যানার- ফেস্টুনে সু-সজ্জিত হয়ে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে মিশন পাড়া হোসিয়ারি সমিতির সামনে এসে জড়ো হয়।
এছাড়াও মানবাধিকার অপরাধে অভিযুক্ত শেখ হাসিনার ফাঁসিকে শহরে যাতে করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কোন অগ্নিসংযোগ বা কোন নাশকতা করতে না পারে তার জন্য শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা অবস্থান করেন।
এসময়ে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক এমপি এড. আবুল কালাম , নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুগ্ম আহ্বায়ক মনির হোসেন খান, যুগ্ম আহ্বায়ক ফতেহ রেজা রিপন, যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাউসার আশা, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এড. রফিক আহমেদ, ডা. মজিবুর রহমান, মাসুদ রানা, এড. এইচএম আনোয়ার প্রধান, বরকত উল্লাহ, ফারুক হোসেন, বন্দর থানা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক রানা, মহানগর শ্রমিকদলের সদস্য সচিব ফারুক হোসেন,বিএনপি নেতা আক্তার হোসেন, শেখ সেলিম, নাজমুল হক, চঞ্চল মাহমুদ,সাইফুল ইসলাম বাবু, হিরা সরদার, ইকবাল হোসেন, সোহেল খান বাবু, মহানগর মহিলাদলের সভানেত্রী দিলারা মাসুদ ময়না, গোগনগর বিএনপির সভাপতি আক্তার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন মিয়াজী, আলীরটেক ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আঃ রহমান, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, মুছাপুর ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক শাহিন আহমেদ, ধামগড় ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মহসিন মিয়া, মদনপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মামুন ভূইয়া, সাধারণ সম্পাদক শাহেন শাহ্ মিঠু, বন্দর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি রাজু আহম্মেদ, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহাজাদা আলম রতন, মহানগর ওলামা দলের সভাপতি হাফেজ শিবলীসহ অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।