স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি এক সেমিনারে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এই দাবি করেন।

ব্যবসায়ীদের এই দাবির পর এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছে। এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানো কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে নানা মতামত দেখা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সময় বৃদ্ধির আবেদন করার জন্য কী কী যৌক্তিক কারণ আছে, সরকার চাইলেই কি সময় পেছাতে পারবে—এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে। কারণ, গত মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ—এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সেই হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় আছে ১৫ মাসের কিছুটা বেশি। এই সময়ে এসে উত্তরণের সময় পিছিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে।

তবে নির্ধারিত সময়েই এলডিসি উত্তরণ হবে বলে গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ নির্ধারিত সময়েই হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করেছি। অনেকের কারখানা পরিদর্শনও করেছি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তাঁরা অন্য কথা বলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর পিছিয়ে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে এলে কি বিদ্যুৎ সমস্যা, যানজট সমস্যা ইত্যাদি সমাধান হয়ে যাবে? বৈশ্বিক রাজনীতি এখন খুবই টালমাটাল—এটা মাথায় রেখে আমাদের রেখে কাজ করতে হবে।’

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসিতে (সিডিপি) সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর জন্য বাংলাদেশের যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে। আট বছর সময় পাওয়ার পরও প্রস্তুত নয়—এই কারণ দেখিয়ে সময় পেছানো যাবে না। সম্প্রতি এক সেমিনারে একজন বিশেষজ্ঞ অ্যাঙ্গোলা ও মিয়ানমারের এলডিসি উত্তরণ পেছানোর কারণ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য দেননি। আসল তথ্য হলো—তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় অ্যাঙ্গোলার আর্থসামাজিক সূচক পড়ে যায়। আর মিয়ানমারের উত্তরণ সিডিপি নিজেই পিছিয়ে দেয়। কারণ, এই সিদ্ধান্তের দুই সপ্তাহ আগে সেখানে সামরিক ক্যু হয়।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের এখন সব মনোযোগ দেওয়া উচিত মসৃণ উত্তরণ কৌশলে (এসটিএস)। এ জন্য শিল্প উৎপাদক, ওষুধ খাত ও কৃষি খাতের উদ্যোক্তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা উচিত। তিনটি বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। এগুলো হলো— এক.

অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা; দুই. শ্রম ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি; তিন. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।

সময় পেছাতে কী করতে হবে

২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সাধারণত ৬ বছরে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দেশকে আরও দুই বছর সময় দেওয়া হয়।

গত ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৬ সালে নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। এ নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এখন এলডিসি উত্তরণ পেছাতে হলে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।

জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদনের দুটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো, সরকারপ্রধানকে সরাসরি ইকোসকের সিডিপির প্রধানের কাছে চিঠি লিখতে হবে। চিঠিতে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে যে নির্দিষ্ট এক বা একাধিক নতুন ও অপ্রত্যাশিত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন উত্তরণ পেছানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আবেদন পেলে সিডিপি একটি মূল্যায়ন করবে এবং এই মূল্যায়নের ওপর পেছানোর বিষয়টি নির্ভর করবে। দ্বিতীয় উপায়টি হলো, বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে। তখন সাধারণ পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভূমিকা রাখতে পারে এমন শক্তিশালী দেশের সহায়তা লাগবে এবং যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণ নির্ধারিত সময়েই হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করেছি। অনেকের কারখানা পরিদর্শনও করেছি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তাঁরা অন্য কথা বলেনআনিসুজ্জামান চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এরপর অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার হয়েছে। তবে এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। ব্যাংক খাতেও কিছু সংস্কার হয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ওই খাতে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। তাহলে এলডিসি উত্তরণের সময় পেছাতে গেলে বাংলাদেশ কী কারণ দেখাবে, সেটাও এখন প্রশ্ন। তবে দক্ষ শ্রমশক্তি, অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে সংস্কার, রাজস্ব খাত, বিনিয়োগ পরিবেশসহ নানা খাতে দুর্বলতা আছে।

কোন দেশ কী কারণে পিছিয়েছে

এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর আবেদন করে সফল হয়েছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। ২০২৩ সালে দেশটির সরকার গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ দেখিয়ে বাড়তি সময় চেয়ে সিডিপির কাছে আবেদন করে। সিডিপি মূল্যায়ন করে তিন বছর সময় বাড়িয়ে দেয়।

কয়েক বছর আগে আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলা এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদন করে। সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ায় দেশটি সরাসরি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আবেদন করে। দেশটি কারণ দেখায়, তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় তাদের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতের সব সূচক পড়ে গেছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পর্তুগালের সহায়তায় তারা বাড়তি সময় পায়।

অন্যদিকে মিয়ানমার নিজে চেয়েছিল এলডিসি থেকে বের হতে। কিন্তু সিডিপি বা জাতিসংঘ সেই সুযোগ দেয়নি। কারণ, চার বছর আগে যখন দেশটি নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছিল, তার দুই সপ্তাহ আগে মিয়ানমারে সামরিক ক্যু হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়ে দেশটি। তাই ২০২৭ সাল পর্যন্ত দেশটির এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেয় সিডিপি।

এ ছাড়া সুনামির কারণে মালদ্বীপ এবং ভূমিকম্পের কারণে নেপালের এলডিসি উত্তরণ নির্ধারিত সময়ে হয়নি।

ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন কেন

পোশাক, ওষুধসহ রপ্তানির বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ ৩ থেকে ৬ বছর পেছানোর দাবি করছেন। গত বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) এক সেমিনারে তাঁরা এই দাবি জানান। সেমিনারে আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় বাড়ানোর জন্য পাঁচটি কারণ বা যুক্তি তুলে ধরেন। সেগুলো হচ্ছে ১. ভালো বাণিজ্য দর-কষাকষির জন্য, ২. তৈরি পোশাকের বাইরে রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা, ৩. শিল্প খাতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, ৪. বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ৫. প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানো ও জলবায়ু সহনশীলতা টেকসই করা। তাঁর মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক বাড়বে ১২ শতাংশ। আর জিএসপিসহ অন্যান্য বাণিজ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রপ্তানি কমবে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ।

যেভাবে উত্তরণ হয়

এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে সিডিপি। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ হতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়।

বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য দুই বছর সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ।

আট দেশের এলডিসি উত্তরণ

বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এলডিসি দেশগুলোও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এই তালিকায় রাখা হয়। আগামী পাঁচ বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় আছে ছয়টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় লাওস ও নেপালও আছে।

১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ধ র ত সময় ই সময় প ছ ন ব যবস য় র ২০২৬ স ল বছর সময় প রক র য় সরক র র র এলড স উপদ ষ ট র অর থ র জন য প রথম সময় ব

এছাড়াও পড়ুন:

এলডিসি উত্তরণ পেছানো কতটা বাস্তবসম্মত

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি এক সেমিনারে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এই দাবি করেন।

ব্যবসায়ীদের এই দাবির পর এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছে। এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানো কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে নানা মতামত দেখা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সময় বৃদ্ধির আবেদন করার জন্য কী কী যৌক্তিক কারণ আছে, সরকার চাইলেই কি সময় পেছাতে পারবে—এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে। কারণ, গত মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ—এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সেই হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় আছে ১৫ মাসের কিছুটা বেশি। এই সময়ে এসে উত্তরণের সময় পিছিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে।

তবে নির্ধারিত সময়েই এলডিসি উত্তরণ হবে বলে গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ নির্ধারিত সময়েই হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করেছি। অনেকের কারখানা পরিদর্শনও করেছি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তাঁরা অন্য কথা বলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর পিছিয়ে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে এলে কি বিদ্যুৎ সমস্যা, যানজট সমস্যা ইত্যাদি সমাধান হয়ে যাবে? বৈশ্বিক রাজনীতি এখন খুবই টালমাটাল—এটা মাথায় রেখে আমাদের রেখে কাজ করতে হবে।’

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসিতে (সিডিপি) সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর জন্য বাংলাদেশের যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে। আট বছর সময় পাওয়ার পরও প্রস্তুত নয়—এই কারণ দেখিয়ে সময় পেছানো যাবে না। সম্প্রতি এক সেমিনারে একজন বিশেষজ্ঞ অ্যাঙ্গোলা ও মিয়ানমারের এলডিসি উত্তরণ পেছানোর কারণ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য দেননি। আসল তথ্য হলো—তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় অ্যাঙ্গোলার আর্থসামাজিক সূচক পড়ে যায়। আর মিয়ানমারের উত্তরণ সিডিপি নিজেই পিছিয়ে দেয়। কারণ, এই সিদ্ধান্তের দুই সপ্তাহ আগে সেখানে সামরিক ক্যু হয়।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের এখন সব মনোযোগ দেওয়া উচিত মসৃণ উত্তরণ কৌশলে (এসটিএস)। এ জন্য শিল্প উৎপাদক, ওষুধ খাত ও কৃষি খাতের উদ্যোক্তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা উচিত। তিনটি বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। এগুলো হলো— এক. অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা; দুই. শ্রম ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি; তিন. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।

সময় পেছাতে কী করতে হবে

২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সাধারণত ৬ বছরে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দেশকে আরও দুই বছর সময় দেওয়া হয়।

গত ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৬ সালে নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। এ নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এখন এলডিসি উত্তরণ পেছাতে হলে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।

জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদনের দুটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো, সরকারপ্রধানকে সরাসরি ইকোসকের সিডিপির প্রধানের কাছে চিঠি লিখতে হবে। চিঠিতে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে যে নির্দিষ্ট এক বা একাধিক নতুন ও অপ্রত্যাশিত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন উত্তরণ পেছানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আবেদন পেলে সিডিপি একটি মূল্যায়ন করবে এবং এই মূল্যায়নের ওপর পেছানোর বিষয়টি নির্ভর করবে। দ্বিতীয় উপায়টি হলো, বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে। তখন সাধারণ পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভূমিকা রাখতে পারে এমন শক্তিশালী দেশের সহায়তা লাগবে এবং যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণ নির্ধারিত সময়েই হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করেছি। অনেকের কারখানা পরিদর্শনও করেছি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তাঁরা অন্য কথা বলেনআনিসুজ্জামান চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এরপর অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার হয়েছে। তবে এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। ব্যাংক খাতেও কিছু সংস্কার হয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ওই খাতে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। তাহলে এলডিসি উত্তরণের সময় পেছাতে গেলে বাংলাদেশ কী কারণ দেখাবে, সেটাও এখন প্রশ্ন। তবে দক্ষ শ্রমশক্তি, অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে সংস্কার, রাজস্ব খাত, বিনিয়োগ পরিবেশসহ নানা খাতে দুর্বলতা আছে।

কোন দেশ কী কারণে পিছিয়েছে

এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর আবেদন করে সফল হয়েছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। ২০২৩ সালে দেশটির সরকার গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ দেখিয়ে বাড়তি সময় চেয়ে সিডিপির কাছে আবেদন করে। সিডিপি মূল্যায়ন করে তিন বছর সময় বাড়িয়ে দেয়।

কয়েক বছর আগে আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলা এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদন করে। সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ায় দেশটি সরাসরি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আবেদন করে। দেশটি কারণ দেখায়, তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় তাদের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতের সব সূচক পড়ে গেছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পর্তুগালের সহায়তায় তারা বাড়তি সময় পায়।

অন্যদিকে মিয়ানমার নিজে চেয়েছিল এলডিসি থেকে বের হতে। কিন্তু সিডিপি বা জাতিসংঘ সেই সুযোগ দেয়নি। কারণ, চার বছর আগে যখন দেশটি নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছিল, তার দুই সপ্তাহ আগে মিয়ানমারে সামরিক ক্যু হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়ে দেশটি। তাই ২০২৭ সাল পর্যন্ত দেশটির এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেয় সিডিপি।

এ ছাড়া সুনামির কারণে মালদ্বীপ এবং ভূমিকম্পের কারণে নেপালের এলডিসি উত্তরণ নির্ধারিত সময়ে হয়নি।

ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন কেন

পোশাক, ওষুধসহ রপ্তানির বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ ৩ থেকে ৬ বছর পেছানোর দাবি করছেন। গত বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) এক সেমিনারে তাঁরা এই দাবি জানান। সেমিনারে আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় বাড়ানোর জন্য পাঁচটি কারণ বা যুক্তি তুলে ধরেন। সেগুলো হচ্ছে ১. ভালো বাণিজ্য দর-কষাকষির জন্য, ২. তৈরি পোশাকের বাইরে রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা, ৩. শিল্প খাতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, ৪. বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ৫. প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানো ও জলবায়ু সহনশীলতা টেকসই করা। তাঁর মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক বাড়বে ১২ শতাংশ। আর জিএসপিসহ অন্যান্য বাণিজ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রপ্তানি কমবে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ।

যেভাবে উত্তরণ হয়

এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে সিডিপি। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ হতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়।

বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য দুই বছর সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ।

আট দেশের এলডিসি উত্তরণ

বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এলডিসি দেশগুলোও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এই তালিকায় রাখা হয়। আগামী পাঁচ বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় আছে ছয়টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় লাওস ও নেপালও আছে।

১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ