একদিন পৌষ মাসের সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার তেরো বছরের চাচাতো বোন কাজলের পেছনের দিকটা রক্তে ভিজে গেছে। আর ঘরের মাঝখানে একটা কাঠের খুঁটি ধরে বসে বসে কাঁদছে সে। তার কান্না দেখে মনে হলো বাড়িতে বুঝি কেউ মারা গেছে। আমি ছিলাম কাজলের এক বছরের বড়, তাই ওর ব্যাপারে সবকিছুতে নাক গলানো আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চাচিকে জিজ্ঞেস করলাম, তাইর কিতা অইছে?
চাচি উত্তর দিলেন, পেট থাকি গজার মাছোর তেল বাইর অইছে। দেখোনানি তাই কিলা খাই খাই, কাইল গলা পর্যন্ত ঠাসিয়া গজার মাছোর ডিম আর তেল খাইছে। আইজ ওউ অবস্থা। অত তেল যাইব কোয়াই? বাইর অইতে অইব তো?
আমি বললাম, হুম। কিন্তু গজার মাছোর তেল তো লাল অয় না।
তাইলে কিজাত্ রং অয়?
সরিষার তেলোর লাখান অয়!
কিন্তু কাঁচা থাকতে কিলান থাকে? চাচি জিজ্ঞেস করলেন।
রক্তোর লাখান!
তাইলে হুনো, সরিষার রঙোর তেল মানুষোর পেটো গিয়া আবার কাঁচা অই গেছে। এর লাগি রক্তোর রং ধরছে!
আমার আর কথা থাকার কথা নয়। ওর তেল আরও বের হোক, শাস্তি পাক। কাল তো আমাকেও একমুঠো ভাজা ডিম দেয়নি। আর বিন্নি ভাত জবজবা তেলে দিব্যি গিলছিল সে।
কিন্তু কাজলের মুখটা ছিল কাতর। মনে হচ্ছিল তেল বের হতে ওর কষ্ট হচ্ছে। গরুর মতো ড্যাব ড্যাব চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। মুখে রা ছিল না।
কাজল আমাদের বাড়ির বোনদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ছিল। কয়েক বছর আগে, যখন আমরা আরও ছোট ছিলাম, একসঙ্গে জামাই-বউ খেলা খেলেছি। এখন এসব মনে পড়লে লজ্জা পাই। কাজলও ওসব কথা আর তোলে না।
কাজলের তেল বের হওয়ার ঘটনা দেখে ফেলেছিল আরও দুজন। একজন কাজলের বাবা, মানে আমার চাচা। অন্যজন আমাদের ঘরের সারা বছরের কামলা জালাল ভাই।
জালাল ভাই বয়সে আমার চেয়ে ছয়-সাত বছরের বড় ছিল। দেখতে লম্বা, হালকা–পাতলা; মাথায় কোঁকড়া চুল। গায়ের রং ফরসা। কাজলের প্রতি তার আলাদা টান আছে বুঝতে পারি।
জালাল ভাই উঠানে দাঁড়িয়ে কাজলকে দেখছিল, পেছন থেকে চাচা তার মাথায় মারেন এক ধাক্কা। শুয়োরর বাচ্চা, ইখানো কিতা? কামো যা!
জালাল ভাই খুব ভয় পেয়েছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে সটকেও পড়ে। কিন্তু জালাল ভাইকে এ রকম গালি দেওয়ার মানে বুঝলাম না। চাচা তাকে এত জোরে মারলেনই-বা কেন? সে তো শুধু আমাদের মতোই কাজলকে দেখছিল।
এর আগে জালাল ভাইয়ের ওপর হাত তুলতে দেখিনি চাচাকে। চাচা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কথা বলতেন কম। এমনকি চাচির সঙ্গেও গুনে গুনে কথা বলতেন। চাচাকে খুব ভয় পেতেন চাচি। আমরাও ভয় পেতাম। শুধু কাজল ভয় পেত না। কাজল বাবার আহ্লাদি ছিল।
এই ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভালো ছিল, কিন্তু হয়নি।
.
রাতের বাসি কাপড়চোপড় কিংবা ধোয়া হবে এমন কাপড় চাচি সব সময় পুকুরঘাটে স্তূপ করে রাখতেন। সূর্য আকাশে উঠলে, চাচা হাটে যাওয়ার আগে গোসল দিয়ে নিজের লুঙ্গিটাও স্তূপের পাশে রেখে যেতেন। সঙ্গে ময়লা গেঞ্জি বা কুর্তাও। দুপুরে চাচি সব একসঙ্গে ধুয়ে উঠানের দড়িতে লটকিয়ে দিতেন। আর কাঁথা বা বিছানার চাদর দিতেন পুকুরপাড়ের ঘাসের ওপর।
স্কুল না থাকলে আমরা হয়তো তখন পুকুরপাড়ের গাছের ফল পাড়ছি কিংবা বড়শি দিয়ে পুকুরের কোনায় মাছ ধরছি। কাজল আমার সঙ্গী থাকত।
ওই দিন সকালে চাচি কাজলের নোংরা সব জামা পুকুরের পাথরের ওপর রেখে উঠানে কাঠ কাটছিলেন। রবিবার হবে। স্কুল বন্ধ। আমি পুকুরপাড়ে ফড়িঙের পেছনে ঘুরছি। হঠাৎ দেখি জালাল ভাই পুকুরঘাটে চোরের মতো কিছু একটা খুঁজছে। ওদিকে আর কেউ নেই।
সচরাচর আমি এমন করি না। আমিও গাছের আড়ালে চলে যাই আর খেয়াল করতে থাকি জালাল ভাইয়ের মতলব। কয়েক দিন আগে ঘাটে চাচির আম্মার নাকফুল খসে পড়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তা পাওয়া যায়নি। জালাল ভাই বুঝি তা-ই খুঁজছে!
হঠাৎ দেখি জালাল ভাই ঘাটের পাথরের দিকে ঝুঁকে পাথরে রাখা একটা জামা হাতে নিয়ে পরখ করছে। আমি উৎসুক হই। আমার শ্বাস ঘন হতে থাকে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটি কী?
জালাল ভাই এবার জামাটি নাকের সামনে নেয়, তারপর শুঁকে দেখে; জামাটিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। আঙুল দিয়ে ঘষায়। আমি দেখি তার মুখখানা ডাকাতের মতো লাগছে। বলব নাকি, জালাল ভাই, আমি দেখিলিছি, কাপড় তুমি হুঙ্গিছো!
কিন্তু আমি কোনো কথা বলি না; যেমন ছিলাম, তেমন থাকি গাছের আড়ালে। জালাল ভাইও আরেকবার জামাটি পরখ করে পাথরের ওপর রেখে চলে যায়। যাওয়ার আগে এদিক-ওদিক তাকায়।
জালাল ভাই একটা চোর! আমি মনে মনে বললাম।
জালাল ভাই চলে গেলে আমি ঘাটে আসি, দেখি পাথরের ওপর কাজলের রক্তমাখা জামা। গজার মাছের তেলের রঙে ভরা। কিন্তু এটা জালাল ভাই শুঁকল কেন? ভেবে অস্থির হওয়ার জোগাড়। মাথাও ঝিঁঝি করতে থাকে।
জালাল ভাই আমাদের গরুও রাখত। গরুর রাখাল ছিল সে। কিন্তু তাকে সব সময় আমার রহস্যঘেরা মানুষ বলে মনে হতো। দুদিন আগেও গজার মাছ শিকারে আমি তার সঙ্গী ছিলাম। আমার সঙ্গে আমার মামাতো ভাই আকিলও ছিল। শর্ষেখেতে শর্ষের ফুল ও কলাখেতে নদী ও হাওর থেকে উঠে আসে গজার মাছেরা। শুকনার মধ্যে মাছকে ধারালো কোচ দিয়ে গেঁথে নেওয়ার আনন্দই আলাদা। জালাল ভাই দারুণ শিকারি। প্রতি রাতে দু-চারটা গজার সে শিকার করতই। সেই গজারের তেল খেয়ে কাজলের এমন মরণদশা হয়েছে।
এদিক-ওদিক ঘুরে জালাল ভাই বলে, চান উঠতে অনেক দেরি অইব। চল, আমরা চেলাজুরি যাই।
চেলাজুরি পাশের গ্রাম, কৈবর্তপাড়া। বাউয়াবিলের ওপারে। আকিল ভাই বলে, চেলাজুরি তো বেশ দূর।
জালাল ভাই বলে, আরে বেটা নাহ্, দূর কই। জালাল ভাই বিড়ি ফুঁকছিল ঘন ঘন। আর আমি গোপনে সেই ধোঁয়া গিলে আসছিলাম। শরীরেও কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছিল। আকিল ভাইকে আমি বুঝতে দিই না।
...
লম্বা পায়ে আমরা একসময় চেলাজুরি পৌঁছাই।
গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে আকিল ভাই আমাকে ফিসফিস করে বলে, ই গ্রামটা ভালা নায়। আমি ইকানো আগে আইছি।
আসলে গ্রামটি আমার মামাবাড়ির পাশে। এখানে মামারা ধান ফলায়। শুকনার মৌসুমে গরু নিয়ে আসে। আমি বললাম, ভালা নায় কেনে?
ইকানোর বেটিন ভালা নায়!
আমি সাতপাঁচ ভাবলাম। একটা গাছের নিচে আমাদের রেখে জালাল ভাই একটা ঘরে ঢুকে গেল। কেন যে ঢুকল, কার বাড়িতে ঢুকল কে জানে? কিন্তু মনে হলো গ্রামের পথঘাট সব জালাল ভাইয়ের চেনাজানা। আমরা দেখলাম গাছটি জারুলের। শীতের সময় বলে ডালপালাশূন্য, পাতা নেই। ওদিকে পুব দিকে গোল হয়ে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো ছিটকে পড়ছে গ্রামের ওপর, মাঠের ওপর। যাক, এবার মাছ শিকারে অসুবিধা নেই।
জালাল ভাই বেরিয়ে এল ঝুপড়ি থেকে। পেছনে একটি মেয়েমানুষ, বয়স একটু বেশি। হালকা আলোতে আমরা দেখতে পাই। মেয়েমানুষটি হাসছে।
আকিল ভাই বলল, কইছলাম না ইকানোর বেটিনগুলা ছিনাল?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিতা অইছে? বেটিয়ে কিতা করছে!
তর মাথা। বেটি ইগু মাগি। ওয়াক্ থু।
‘মাগি’ শব্দটা আমি প্রথম শুনলাম। মাগিরা কী করে? এরা খারাপ কেন? আকিল ভাইয়ের কথার কোনো থই পাই না।
জালাল ভাইকে অনেক আমুদে দেখা গেল। আনন্দে টগবগিয়ে হাঁটছে এখন। বলল, বাউয়া বিলের পারেই আইজ মাছ শিকার করমু। অনেক মাছ পাইমু কইলাম।
জালাল ভাইয়ের কথা ও কাজ রহস্যে ভরা ছিল। চাঁদের আলো তার চোখের রহস্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার আজকের পুকুরঘাটের ঘটনার পর মনে হচ্ছে সে একজন রহস্যমানব। রহস্যময় দ্বীপে এমন মানুষের কথা বইয়ে পড়েছি। তারাও মাছ শিকার করত। জালাল ভাইয়ের চুলও তো তাদের মতো!
...
চাচাকে আমি ‘চাচাই’ ডাকতাম। দুপুরের ঘটনাটা আমি চাচাইয়ের কাছে ফাঁস করে দিলাম রাতে। কারণ, আমার মনে হয়েছিল জালাল ভাই কিছু একটা অন্যায় করেছে। এটা চাচাইয়ের কাছে বলা দরকার। এ ছাড়া রক্তমাখা জামাটা কাজলের। এ জন্য আমার আরও কেমন জানি লাগছিল। তখন ইচ্ছা করছিল জালাল ভাইয়ের মাথায় কাঠ দিয়ে একটা বাড়ি মারি।
চাচাই আমার কথা শুনে বললেন, শুয়োরের বাচ্চা গেছে কুনানো? আমি তারে খুন করমু আইজ! চাচাইকে অস্থির দেখাল।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চাচাই এত রাগলেন কেন? খুন করার কারণই-বা কী? এটা কি খুন করার মতো ঘটনা? আমি ভেবে কূল পেলাম না। চাচাই যদি সত্যি খুন করেন তাহলে তো তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে! আমাকেও কি ধরে নিয়ে যাবে? ঘটনাটা তো চাচাইকে আমিই বলে দিয়েছি। না হলে তো চাচাই জানতেন না। আমি ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম। ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বাড়ল।
কিন্তু বাড়িতে খুনের ঘটনা ঘটল না। দিন দিন কাজলও কেমন রহস্যময় হয়ে উঠল আমার কাছে। এখন আর আগের মতো আমার সঙ্গে দৌড়ায় না। পুকুরপাড়ে আসে না। কথাও বলে কম। এক দিনের ঘটনায় একটা মানুষের এমন পরিবর্তন হয় কী করে, ভেবে আমি তল পাই না!
...
এর কয়েক দিন বাদে বৈশাখ আসে। ঝড়, বজ্র-বিদ্যুৎ আর বৃষ্টিতে গ্রামের আলুথালু অবস্থা। সবজির খেত বৃষ্টির পানিতে ভরে যায়। মরিচের খেত পচতে থাকে। আলু, কপি, শালগম, পেঁয়াজ সব পানির নিচে তলিয়ে যায়। বাড়ির মেয়েরা সবজিখেতের ফসল গোছাতে ব্যস্ত আর পুরুষেরা বোরো ধান তুলে আনতে ব্যস্ত। সবচেয়ে ব্যস্ত জালাল ভাই। বৈশাখের পর ধান নিয়ে যাবে মায়ের কাছে। মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। ওদের গ্রাম আবার অনেক দূরে। ছাতকের কাছে। বাড়িতে গিয়ে এবারে বিয়ে করবে। এ কথা দাদির কাছে জানতে পারি। জালাল ভাই শুধু মুচকি হাসে আর নেচে নেচে ধানের বোঝা মাথায় এনে উঠানে রাখে। সন্ধ্যার পর মাড়াই হয় গরু দিয়ে। কুপি জ্বালিয়ে। সঙ্গে চলতে থাকে খাবারদাবার; বোরো ধানের চিড়া আর আখের গুড়। পড়াশোনা আমাদের মাথায় ওঠে।
বৈশাখ পার হতে থাকে। কিন্তু ধানের মৌসুম শেষ হতে চায় না। নদীতে বানের ঘোলা পানি বাড়ে। বিলেও পানি ঢুকতে শুরু করেছে। প্রতি রাতে ঝড় আর বিজলির আওয়াজ।
দিনে জালাল ভাইয়ের গোসলেরও সময় নেই। গোরু রাখা, ধান কাটা, ধান তুলে আনা ও মাড়াই দেওয়া—এই তার কাজ। এই তার জীবন। তার মাথার চুল আরও লম্বা হয়েছে। কোঁকড়া চুলে তাকে কেমন যেন দেখায়। একদিন হাওর থেকে নিয়ে এল এত্তগুলো কই মাছ। ওগুলো নাকি মাঠে উঠে আসছিল। দাদি বলেন, উজাইর মাছ। পেটো অ্যান্ডা আছে!
সত্যি এদের পেটে ডিম ছিল। বজ্রের ডাকে ওরা হাওরের পানি থেকে কানকো করে বেয়ে বেয়ে এত দূর মাঠে এসেছিল।
একদিন মাঠও পানিতে তলিয়ে যায়। আমাদের খেতের সব ধান তোলা হয়ে গেছে। গ্রামের কারও কারও খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন বন্ধারিতে মাছ শিকারের মৌসুম। লাইটের আলোতে মাছ শিকারকে আমাদের এখানে ‘বন্ধারি’ বলে। বন্ধারিতে অনেক মজা।
তখনো জ্যৈষ্ঠ আসেনি। গাছের আম পাকেনি। ঝড়ে যেসব আমগাছের নিচে স্তূপ হয়ে আছে, পানির নিচেও যেগুলো পড়েছে, জালাল ভাই আর আমি দুজনে মিলে কুড়াই। কাজল আমাদের সঙ্গী হয় না। ঘরেই বসে থাকে।
একদিন কুড়ানো আম থেকে বেছে বেছে কিছু আম জালাল ভাই আমাকে দেয়, বলে কাজলরে দিয়ো। তাই তো আবার কাঁচা আমর পাগল!
আমি তাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, তাইর লাগি আমি বেজায় আম রাখছি। ওউ নু। ঝুড়ির আমগুলো আমি দেখাই।
জালাল ভাই জবাবে কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, কিতা রে, কাজলকে দুই দিন ধরিয়া দেখি না। মামুর বাড়ি গেছেনি?
আমি জানি কাজল বাড়িতেই আছে। কিন্তু বললাম, আমি জানি না। পরে কেন জানি রাগ হলো, যোগ করলাম, কাজলরে দিয়া তোমার কাম কিতা?
জালাল ভাই কিছু বলেনি। মনে হলো লজ্জা পেয়েছে।
আর সেদিন রাতেই ঘটনাটা ঘটল।
...
সন্ধ্যাবেলা জালাল ভাই যখন গরু ঘরে তুলে শেষ করেছে, চাচাই বললেন, জালাল, আইজ মাছ শিকারো যাইমু। উত্তরোর বন্ধো।
জালাল ভাই জবাবে বলল, আইচ্ছা।
আচ্ছা কিতা? লাইট ঠিক কর। কুঁচা-বৈঠা-নাও সব জুইত কর। আইজ মাছ পাওয়া যাইব ভালা।
জালাল ভাই সব গুছিয়ে আনল তাড়াতাড়ি। তারপর একটু বেরোল পাড়ায়। সন্ধ্যার পর পাড়ায় এক চক্কর না ঘুরলে পেটের ভাত হজম হয় না তার। আর শিকারেও যেতে হয় একটু দেরিতে। ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলে, আর মাছগুলো হাওর বা নদী থেকে মাঠের পানিতে উঠে না এলে তো শিকারও হয় না। গভীর রাতে প্রকৃতি নিস্তব্ধ হলেই মাছ উঠে আসে অগভীর পানিতে। তাই হাতে অনেক সময় ছিল।
শিকারে রওনা হওয়ার আগে আমি বেঁকে বসলাম, চাচাই, আমিও যাইতাম!
না, তোমারে নেওয়া যাইত নায় আইজ!
আমিও নাছোড়বান্দা। যাবই, আর কান্না জুড়ে দিলাম।
দাদি বললেন, নেও নারে বাবা। আমার নাতি তো যায়ও মাঝেমধ্যে। ইবার গেলে দোষ কিতা?
আম্মা, তুমি বুঝতায় না। মাছের লগে কালও থাকে। কওয়া যায় না কখন তার ঘাড় মটকাই দেয়! তখন আমারে দুষবায়!
বিষয়টা আমি জানি। মাছেদের একজন রাখাল আছে। তাকে বলা হয় ‘কাল’। মাছশিকারিদের ওপর বিরক্ত হলে সে নাওয়ের মাঝি বা শিকারির ঘাড় মটকে দেয়। তাই কালের তাবিজ নাওয়ে কোমরে বেঁধে শিকারে যেতে হয়। ওই তাবিজ শশী কবিরাজ দেয়। মাঝেমধ্যে বড় চাচাও দেন। তিনি একজন ওঝা। রাখাল তাকে খুব মানে। সাপেরাও মানে। সাপে কাটা মানুষের শরীর থেকে তিনি ঝেড়ে বিষ নামাতে পারেন। তাই আমি কালকে ভয় পাই না। বড় চাচা ও শশী কবিরাজের তাবিজ আমার কোমরে আছে। তাগা দিয়ে বাঁধা।
আমাকে শেষমেশ শিকারে নিতে হলো।
...
নাওয়ের সামনে রাখা হলো বন্ধারির লাইট। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা গলুইয়ের সঙ্গে। অনেক আলো দেয় তেলের এই লাইট। মাঠের পানি ভেদ করে আলো মাটি অবধি পৌঁছায়। পানির গভীরের সামান্য পোকাও চোখে পড়ে। চাচাই ধারালো কোঁচ হাতে লাইটের পেছনে দাঁড়িয়ে। আমি নাওয়ের মাঝখানে ডাবে বসে আছি। জালাল ভাই পেছনের গলুইয়ে বসে ধীরগতিতে নাও চালাচ্ছে। সে বন্ধারির মাঝি।
আমাদের কারও মুখে কথা নেই। বন্ধারির মাছ শিকারে এই নিয়ম। কিন্তু আজ আর কোথাও অন্য শিকারি নেই। চাচাই বললেন, খারাপ রাইত। অমাবইস্যা, মাছ মিলত নায়। কাল সব মাছ সরাই লাইছে। জালাল অন্যদিকে নাও বা।
জালাল ভাই নৌকা ঘোরাল। এক হাওরের পর আরেক হাওর। এক মাঠের পর আরেক মাঠ। কিন্তু মাছের দেখা কোথাও নেই। আর আমরাও গ্রামের এলাকা ছেড়ে অনেক দূর চলে এসেছি।
একসময় জালাল ভাই বলল, মামুজি, আইজ মনে লয় মাছ মিলত নায়।
শুয়োরর বাচ্চা, কথা কস্ কেনে? কথা বন্ধ একবারে, চুপ! বুঝোছ না কাল আমরার লগ ধরছে হাইঞ্জারাই ধরি? আইজ তরে কালে আস্তা রাখব? কলমা পড়।
জালাল ভাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল, আমিও ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। হাত দিয়ে দেখলাম কোমরে তাবিজ দুটি আছে। তাহলে আমার তো কিছু হবে না। কিন্তু জালাল ভাইকে রক্ষা করবে কে?
তোমার তাবিজ আছে? জিজ্ঞেস করলাম।
না! ভয়ার্ত কণ্ঠ।
তাহলে সুরা ইউনুস পড়ো।
আমি তো সুরা ইউনুস শিখি নাই।
তাইলে তুমি বাঁচবায় কিলা? আল্লার নাম লও।
এসব কথা হলো ফিসফিস করে।
এবার দেখা গেল জালাল ভাই শক্ত হয়ে গেছে। বৈঠা পানি থেকে তুলতে পারছে না। তার চেহারাটাও কেমন, ঘুম ঘুম। নৌকাও পানির ওপর স্থির হয়ে আসছে।
যে হাওরে এসেছি তা গ্রাম থেকে অনেক দূরে। আমি কখনো আসিনি আগে। কিচ্ছু চিনতে পারছি না। তাহলে কি আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি?
আমার দাদির কথা মনে পড়ল। দাদির কাছ থেকে মাছ শিকারের অনেক কথা শুনেছি। দাদা যখন মাছ শিকারে যেতেন অনেক বছর আগে, সেসব গল্প। দাদা তো এখন নেই। কিন্তু গল্পগুলো আছে। অনেক সময় শিকারিকে ভুল পথে নিয়ে যায় কাল। শায়েস্তা করার জন্য। তখন নাওয়ের হালে বসে পড়ে অবিকল মাঝির রূপ ধরে। আর তার আগে মাঝিকে ঘাড় মটকে ফেলে দেয় পানিতে। সামনে থাকা শিকারি কিছুই জানতে পারে না। এমনকি মাঝির কণ্ঠ নকল করে আলাপচারিতাও চালিয়ে যায় শিকারির সঙ্গে। তারপর হাওরের পর হাওর পাড়ি দেয় মাঝি শিকারিকে নিয়ে। যখন সকাল হয়, পথহারা শিকারি পেছনে তাকিয়ে দেখে মাঝি তো নেই। নাওয়ের গলুই শূন্য। মানে এসবই কালের কাণ্ড!
দাদা একবার কালকে চিনতে পেরে কোঁচ দিয়ে ঘা লাগান। মাঝির ছদ্মবেশী কাল গলুইয়ে লুটিয়ে পড়ে। সকালের আলোয় দেখা গেল, একটি কাক পড়ে আছে। রক্তমাখা, মৃত।
এসবই আমার মনে পড়ে। আর গা ছমছম করে ওঠে। আমরাও আজ সে রকম কালের পাল্লায় পড়ে গেছি! এখন কী হবে?
চাচাইও কোঁচ হাতে স্থির দাঁড়িয়ে। চাচাই কী ভাবছেন, আমি ভাবি। তিনি কি ভয় পেয়েছেন? তার হাতে তো কোঁচ আছে। অস্ত্র হাতে। চাচাই জোয়ান মানুষ। খুব সাহসী। কিন্তু ভয় কাটে না আমার।
রাতের তিন প্রহর পেরিয়ে গেছে। জালাল ভাই যেন ঘুমাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে বৈঠা চালাতে চাচ্ছে, কিন্তু শক্তিকে কুলাচ্ছে না। জালাল ভাই কি স্থির হয়ে আছে কাঠের মূর্তির মতো?
এইবার চাচাই ঘুরলেন। তার মুখটা ভয়ানক মনে হলো। কোঁচটা জালাল ভাইয়ের ওপর তাক করলেন। জালাল ভাই সহসা সচকিত হলো। ভয়াল কিছু একটা ঘটবে—এমন কিছু টের পেল। বিকট একটা চিৎকার করতে করতে পানিতে পড়ে গেল, মামুজিবো! আমারে মাফ করি দেও। আমারে মারিও না!
...
অন্ধকার ভেদ করে এই কাতর কণ্ঠ সারা হাওরে ছড়িয়ে পড়ল। এই গলা মানুষের নায়! আমি ঠিক বুঝছি! কোঁচটি ছুড়ে মারলেন চাচাই পানিতে ঝাঁপ দেওয়া জালাল ভাইয়ের মাথায়।
গত বছর মানুষের মতো বড় আকৃতির গজার মাছ শিকারের সময় চাচাই যেমন শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন, এখন করলেন তার চেয়েও বেশি। আগের বারে চাচাইয়ের মুখ ছিল আনন্দে উচ্ছল। এবারে মনে হলো হিংস্র ও বিকৃত। রাগে ফেটে পড়া। পেছনের গলুইয়ে চলে এলেন চাচাই বাতাসের গতিতে। জালাল ভাইয়ের বাঁচার আকুতির শব্দ পানিতে বুদ্বুদ আকারে ফুটছে। কোঁচটা ছাড়িয়ে নিয়ে আরেকটা ঘা দিলেন চাচাই। মনে হলো বুক বরাবর। গজার মাছ যেমন বারবার বিদ্ধ হওয়ার পর একসময় নিস্তেজ হয়ে যায়, জালাল ভাইয়ের অবস্থাও তদ্রূপ। একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল। পানিতে আর শব্দ হলো না।
ঘটনার আকস্মিকতায় চেতনাশূন্যের মতো আমি চোখে অন্ধকার দেখতে থাকি। আমার গলা কাঠ হয়ে আসে। কিছু ভাবতেও পারি না। শুধু দেখি চারদিকে অন্ধকার, কোথাও কোনো শব্দ নেই। আর শুধু শুনি চাচাইয়ের ঘন ঘন শ্বাস ফেলার শব্দ। একসময় শুনতে পেলাম চাচাইয়ের গলার ক্ষীণ আওয়াজ। স্বগতোক্তি করছেন অথবা আমার উদ্দেশে বলছেন, জালালরে আগেই কালে মারিলিছে। আগোর হাওরে ফালাইছে মারিয়া। আমি মারলাম কালটারে, যে জালালের রূপ ধরিয়া নাও বাইছিল। তুই ডরাইছ না। ইটা মানুষ নায়, কাল। ই জালাল নায়!
মামুজিবো! আমারে মাফ করি দেও। আমারে মারিও না! এটা তো জালাল ভাইয়েরই কণ্ঠ।
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম, চাচাই আমাকে সাক্ষী মানছেন, আগের হাওরোর পিছনোর গলুইত টুপ করি আওয়াজ অইতে শুনছেলনি?
কিছু মনে করতে পারি না আমি, শুধু বলি, হুম!
তখন কালটা জালালোর ঘাড় মটকাইয়া পানিত ফালাই দিছিল। আমি বুঝছিলাম; তুই টের পাইছেলনি?
আমার ভয়ার্ত কণ্ঠ থেকে আরেকবার শুধু শব্দটি বেরিয়ে আসে, হুম!
আমি স্মৃতিশূন্য হয়ে পড়েছি। আর শব্দটি আমি কী অর্থে ব্যবহার করেছি, তা–ও বুঝতে পারি না। আমার শুধু ঘুম পাচ্ছিল। ভয় পেলে আমার সব সময় ঘুম পায়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ জ ঞ স করল অন ক দ র ল ভ ই বল হ ওর র প আম র ম ক জল র খ ন কর র আর ক র হ ওর বন ধ র র গল ই আম দ র ও ক মন আম র স ভয় প য় করল ম বলল ম বলল ন একদ ন রহস য ঘটন ট আইজ ম র ঘটন বছর র হওয় র র ওপর ই বলল
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ২৯
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কয়েকটি অপরাধপ্রবণ এলাকায় বুধবার দিনভর বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অভিযোগে ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে তিনটি ছুরি, দুটি ধারালো চাকু, দুটি লোহার রড, একটি সাইকেল ও ৩০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।
বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়মিত মামলা, মাদক মামলা, পরোয়ানাভুক্ত আসামি ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অপরাধী রয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন হীরা (১৯), রফিক (২১), আবদুর রহমান (৩৯), নাবিদ হাসান ওরফে চয়ন (২৬), খোকন (৩১), মনসুর (৩৫), জুয়েল (৩২), সানজু (২২), মিলন (৪২), শাওন (৩৬), নোয়াজ শরীফ (২৮), সেলিম (৩৪), আসাদুজ্জামান ওরফে ইমন (২৩), আনোয়ার হোসেন (৩৬), সজল (৩০), বরকত গাজী (২৮), জুয়েল (৩৮), আরমান (৩০), বাদল (৩৮), কোরবান (২৮), নয়ন (২৭), মাসরুফ (২৩), আল আমিন (২৭), রাকিব (১৮), মিলন (২৫), ওয়াজিদ (৩৬), এরশাদ (২৫), ছালাম ওরফে সামাদ (৩৭) ও দিলসার (৩০)।