সিনথিয়া মেহরিন সকাল। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই মাথায় আঘাত পাওয়ার ঘটনাটা তাঁর মনে ফিরে ফিরে আসে। সেদিন সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় নেমেছিলেন তিনি। বিক্ষোভের সময় ছাত্রলীগের এক কর্মীর হামলার মুখে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী সকালের মাথায় ১০টি সেলাই পড়ে। সাময়িকভাবে স্মৃতিও হারিয়েছিলেন।

পরদিন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করছিলেন ২৩ বছর বয়সী আবু সাঈদ। তাঁর ওপর গুলি চালায় পুলিশ। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। মুহূর্ত পরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাচ্ছেন। ভিডিওটি ভাইরাল হয়। শুরু হয় নজিরবিহীন এক আন্দোলন। এরই জেরে গত আগস্টে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কঠোর শাসনের অবসান হয়।

সরকারের চরম দমন-পীড়ন অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমেছিলেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। তরুণ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবক, শিক্ষক ও সাধারণ নাগরিকেরাও। বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো জরুরি সমর্থন জুগিয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে এক অপ্রত্যাশিত ঐক্য গড়ে তোলে।

সকাল আল–জাজিরাকে বলেন, ‘প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও ছাত্ররা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। মনে হচ্ছিল, সত্যিই একটা বদল আসতে যাচ্ছে।’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাজার হাজার বিক্ষোভকারী শেখ হাসিনার বাসভবন ও কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন। অন্যদিকে ৭৭ বছর বয়সী হাসিনা একটি সামরিক উড়োজাহাজে করে তাঁর প্রধান মিত্র প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। তিনি এখনো সেখানে অবস্থান করছেন। সংশ্লিষ্ট আদালত তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও অন্যান্য অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে আদেশ দিয়েছেন। ভারতে বসে তিনি এ আদেশ অমান্য করে চলেছেন।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁদের বেশির ভাগই নিহত হন আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি বাহিনী গুলি চালালে। আহত হন হাজার হাজার মানুষ। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের তিন দিন পর গত বছরের ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন আন্দোলনকারীরা।

চলতি বছরের মে মাসে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

মঙ্গলবার বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পূর্তি উদ্‌যাপনের আগ দিয়ে সিনথিয়া মেহরিন সকাল শোনান হতাশার কথা। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের মূল সুর ছিল যে ঐক্য আর আশা, তা এখন মোহভঙ্গ আর হতাশায় রূপ নিয়েছে।

আগামী বছর সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে সিনথিয়া বলেন, ‘তারা বিপ্লবটা বিক্রি করে দিচ্ছে।’

‘আমার ছেলের আত্মত্যাগ কিসের জন্য’

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৮৫ বছর বয়সী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস। তবে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ছেন তিনি। তাঁর সরকার যখন নতুন একটি সংবিধানের খসড়া তৈরির জন্য ঐকমত্য খুঁজছে। বিরোধী যেসব গোষ্ঠী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিল করেছিল, তারাই এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যাত্রাপথ নিয়ে রাজনৈতিক যুদ্ধে নেমে পড়েছে।

মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনার পতনের বর্ষপূর্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর প্রশাসনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে কী কী গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন, সেটার রূপরেখা এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়, তার পথনকশা দিচ্ছে এ দলিল।

তবে খুব বেশি মানুষ আশাবাদী নন।

তাঁদেরই একজন সানজিদা খান দীপ্তি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১৭ বছরের ছেলে আনাসকে হারিয়েছেন তিনি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় আনাস। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, আনাস নিরস্ত্র ছিল। গুলি থেকে বাঁচতে দৌড় দিয়েছিল সে। ঠিক তখনই পেছন থেকে গুলি লাগে। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় আনাসের। তখনো সে একটা জাতীয় পতাকা আঁকড়ে ধরে ছিল।

সানজিদা খান দীপ্তি বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু তা তো আমরা পাচ্ছি না।’

‘প্রত্যাশা ছিল, সংস্কার হবে এবং জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পাব। তা তো যথাযথভাবে হচ্ছে না’, বলেন ৩৬ বছর বয়সী এই মা। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা ভালো, শান্তিপূর্ণ ও ন্যায্য দেশের জন্য রাস্তায় নেমেছিলাম। সেটাই যদি না হয়, তাহলে আমার ছেলে আত্মত্যাগ করল কেন?’

অন্য আরও মানুষজন অবশ্য এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা ধরে রেখেছে। নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে মুখমণ্ডলের প্রায় পুরোটা উড়ে যাওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমার কোনো আফসোস নেই। আমি গর্বিত যে আমার এ আত্মত্যাগ একটি বৈষম্যভিত্তিক শাসনব্যবস্থার পতনে সহায়ক ছিল।’

খোকন চন্দ্র বর্মণের মতে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন দেশ এখন আরও ভালো হাতেই রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আগের সব কুকর্ম রাতারাতি মুছে ফেলা যাবে না। তবে আমরা আশাবাদী।’

এ কথার সঙ্গে একমত আতিকুল গাজী। গত রোববার আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘ইউনূস স্যার যোগ্য এবং তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাঁকে (অধ্যাপক ইউনূস) পুরোপুরি সহযোগিতা করত, তাহলে সবকিছু আরও ভালো হতো।’

আতিকুল গাজী একজন টিকটকার। বয়স ২১ বছর। থাকেন ঢাকার উত্তরায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গুলি লাগে তাঁর। প্রাণে বাঁচলেও বাঁ হাত হারান আতিকুল।

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর একটি সেলফি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন আতিকুল। একটি হাত হারানো সত্ত্বেও ওই ভিডিওতে তাঁকে হাসতে দেখা গেছে। ভিডিওটি ভাইরাল হয়। তিনি হয়ে ওঠেন ঘুরে দাঁড়ানো ও মনোবলের প্রতীক।

আতিকুল বলেন, ‘আমি ভয় পাই না.

..আমি আবার মাঠে ফিরে এসেছি। যদিও একটি হাত নেই, তবু আমি আবার জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত আছি।’

‘অস্থিতিশীলতা আরও বাড়তে পারে’

তবে সবাই এতটা আশাবাদী নন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘ওটা ছিল এক নজিরবিহীন ঐক্যের মুহূর্ত।’

২০২৪ সালের ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক বিক্ষোভে রাব্বানী একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। গত মাসে গণ-অভ্যুত্থানের স্মরণ উদ্‌যাপনে আয়োজিত এক সভায় তিনি বলেন, ‘সেই ঐক্যকে রক্ষা করাই নতুন সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা সেটা ক্ষয়ে যেতে দিয়েছে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা এবং পেশাজীবী ও অ্যাকটিভিস্টরা জোটবদ্ধ হয়ে যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, তা শেখ হাসিনার সরকারকে হটিয়ে দেয়। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তারা বিভক্ত হতে শুরু করে।

মানুষের মনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে প্রবল ভাব জাগে, সেটাকে কাজে লাগাতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শুরু থেকেই দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি করে আসছে। কিন্তু ২০২৪ সালের আন্দোলন থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতাদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের দাবি চায়।

ভিন্ন ভিন্ন এসব দাবির সুরাহা করতে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইউনূস প্রশাসন ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে।

তাদের কাজ হলো বিশেষজ্ঞ কমিশনগুলোর দেওয়া নানা সংস্কার প্রস্তাব একত্র করে একটি রাজনৈতিক রূপরেখা দাঁড় করানো। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে যারা বিজয়ী হবে, তাদের এই রূপরেখা বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার করতে হবে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত এই কমিশনের বৈঠকগুলো বিভাজন ও মতবিরোধে জর্জরিত। মূল বিরোধগুলো যেসব প্রশ্নে, সেগুলো হচ্ছে: সংসদকে দুই কক্ষবিশিষ্ট করা, উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু করা এবং বৃহৎ পরিসরে পক্ষপাতহীনতা ও দলনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সংস্কার আনা।

বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি সতর্ক করে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংস্কার নিয়ে একমত হতে না পারে, তাহলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে।’

তবে ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের খণ্ডকালীন ফেলো মোবাশ্বার হাসান মনে করেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা সম্ভবত হবে না। বেশির ভাগ পক্ষ আগামী বছর নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে বলেই তাঁর মনে হচ্ছে।

যদিও মোবাশ্বার হাসান সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, এগুলোকে তিনি ‘ওপরভাসা রদবদল’ (কসমেটিক রিসেট) বলে বর্ণনা করেন।

মোবাশ্বার আল–জাজিরাকে বলেন, ‘কিছু গণতান্ত্রিক অগ্রগতি হবে, কিন্তু আসল পরিবর্তন আসবে না।’

একসময় কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার কথা উল্লেখ করে মোবাশ্বার আরও বলেন, কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে বিষয়টি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতাকে দুর্বল করে দিতে পারে।

এদিকে গত বছরের বিক্ষোভে কিশোর ছেলেকে হারানো দীপ্তি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এখন শুধু ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে ছুটছে। গত বছর যারা বিক্ষোভ চলাকালে শেখ হাসিনার দমন-পীড়নে সহায়তা করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

আল–জাজিরাকে দীপ্তি আরও বলেন, ‘বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, যারা সহিংসতায় জড়িত ছিল, তাঁরা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আর রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা দখলের দৌড়ে মেতে আছে।’

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী সতর্ক করে বলেন, বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে দেশ আবার ফ্যাসিবাদের কবলে পড়বে। ইনকিলাব মঞ্চ হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।

২৫ জেলায় তাঁর সংগঠনের সদস্যসংখ্যা এক হাজারের বেশি। তাঁরা ২০২৪ সালের আন্দোলনের স্মরণে কবিতা পাঠ, প্রদর্শনী ও পথনাটক আয়োজন করে এবং দোষীদের বিচারের দাবি জানায়। এমন একটি সময়ে তাঁরা এ কাজ করছেন, যখন দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।

‘বিক্ষোভের শহর’

বাংলাদেশের পুলিশ এখনো জনগণের আস্থা ফিরে পায়নি। শেখ হাসিনার শাসনামলে কঠোর দমন-পীড়নে সহযোগিতা করার অভিযোগে তাদের নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। এ অবস্থায় দেশের সড়কগুলোতে সেনাসদস্যরা টহল দিচ্ছেন। তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষমতার আওতায় সেনাসদস্যরা আইনভঙ্গকারীকে গ্রেপ্তার, আটক, এমনকি জরুরি প্রয়োজনে গুলিও করতে পারে।

সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৭২ জন নিহত ও ১ হাজার ৬৭৭ জন আহত হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে আটটি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনার তথ্য-প্রমাণও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে পুলিশ ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মতো বাহিনীগুলো জড়িত ছিল। এ ছাড়া এ সময় অন্যান্য অপরাধও বেড়েছে।

পুলিশের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ১ হাজার ৫৮৭টি হত্যা মামলা হয়েছে। এটা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। ডাকাতির ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩১৮টিতে দাঁড়িয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ৯ হাজার ১০০ ছাড়িয়েছে। অপহরণের ঘটনাও বাড়তে দেখা গেছে।

অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক মো. ইজাজুল ইসলাম আল–জাজিরাকে বলেন, ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ (মব জাস্টিস) ও পরিকল্পিত হত্যা (টার্গেটেড কিলিং) বেড়েছে। এসব ঘটনার অনেকগুলোর সঙ্গেই রাজনৈতিক সংযোগ আছে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে না আনে, তাহলে মনোবল হারানো পুলিশ বাহিনী এটা সামাল দিতে পারবে না।’

পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ার সূচনাটা হয়েছে মূলত ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের সময় থেকে। তখন সারা দেশে ৫০০টির বেশি থানায় হামলা হয়েছিল। পুলিশ সদস্যরা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাস্তায় ছিলেন না।

ইজাজুল বলেন, পুলিশ বাহিনীকে মনোবল হারানো অবস্থা থেকেই আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছে।

তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আল–জাজিরাকে আরেকটি সমস্যার কথা বলেছেন। সেটা হলো: গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ‘অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) রাজনৈতিক কাঠামো’ ভেঙে পড়া।

কুড়িগ্রামের রৌমারী থানার এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে পুলিশ অনেক সময় গ্রামীণ বিরোধ নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতাকারী ক্ষমতাসীন নেতাদের সঙ্গে মিলে কাজ করত। এখন সেই কাঠামো ভেঙে গেছে। বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও আরও কিছু দল ও গোষ্ঠী এখন বাজার, পরিবহনকেন্দ্র এবং সরকারি টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।’

ঢাকার পরিস্থিতিও ভালো নয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার তালেবুর রহমান আল–জাজিরাকে বলেন, ‘প্রতিদিনই রাজপথের বিক্ষোভ সামলানোটা আমাদের বড় একটি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হয়, ঢাকা যেন এক বিক্ষোভের শহরে পরিণত হয়েছে। মানুষ শুধু তাদের দাবি শোনাতে সরকারি দপ্তরের ভেতর ঢুকে পড়ছে।’

তবে তালেবুর রহমানের দাবি, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পরপরই পরিস্থিতি যেমনটা দাঁড়িয়েছিল, তার তুলনায় এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো।

গত ১৫ জুলাই সময় টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সামগ্রিক পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে বোঝা যায়, পরিস্থিতি স্থিতিশীল হচ্ছে।

শফিকুল আলম আরও বলেছেন, অভ্যুত্থানের সময়সহ বছরের পর বছর ধরে যাঁরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁরা এখন মামলা করতে এগিয়ে আসছেন।

শফিকুল আলমের এসব কথার সঙ্গে কেউ কেউ একমত।

ঢাকার অভিজাত বসুন্ধরা এলাকার ৩৮ বছর বয়সী রিকশাচালক মোহাম্মদ শাইনুর বলেন, ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।

অর্থনীতির দিক দিয়ে কিছু ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, আর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক ও কৃষি খাত।

২০২৪ সালের মে মাসে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে এ বছর জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারে। অবৈধভাবে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদেশ থেকে রেকর্ড পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নতুন অর্থায়ন এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ বছরের জুনে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

তবে এখনো দেশে ব্যাপক বেকারত্ব রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ কাজও করেন না, লেখাপড়াও করেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা আরেকটি বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। নতুন শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কাজ করা ৪০ লাখ মানুষ জীবনজীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

এদিকে ঢাকায় আতিকুল গাজী ২০২৪ সালের আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখতে এখনো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘জনগণ যেন বিপ্লবে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, আর আমাদের মতো যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের স্মরণে রাখে। আমরা সেই স্বাধীনতার জীবন্ত প্রতীক হয়ে থাকতে চাই।’

আন্দোলন করতে গিয়ে নিজের একটি হাত হারিয়েছেন আতিকুল। তবে এ নিয়ে তাঁর কোনো অনুশোচনা নেই। তিনি বলেন, ‘আমি একটি হাত হারিয়েছি, এ নিয়ে আমার কোনো অনুশোচনা নেই। যদি প্রয়োজন পড়ে আমি জীবন দেব, এই দেশকে ভালোভাবে চালাতে হবে, কে ক্ষমতায় আছে, তা মুখ্য বিষয় নয়।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ২০২৪ স ল র আল জ জ র ক গত বছর র বছর বয়স পর স থ ত ৫ আগস ট ব যবস থ সরক র র র জন য কর ছ ল আম দ র ত হয় ছ ক ষমত র পতন স গঠন ইউন স অবস থ আরও ব র বয়স সদস য ইসল ম আওয় ম বছর ব র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ ২,৯৫৬ কোটি টাকা

নির্বাচনকে সামনে রেখে চলতি অর্থবছরের বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি।

২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটের দলিল দেখে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনের জন্য যত টাকা লাগবে, তা দেওয়া হবে। এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

নির্বাচনের বাজেট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আজ বুধবার অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় জানান। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।

এদিকে গত জুনে চলতি অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হয়। তখন নির্বাচন কমিশনের জন্য আগেরবারের চেয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রেখে ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা রাখা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের জন্য যত বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এর মধ্যে ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় বাবদ বরাদ্দ আর ২২৯ কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ। এর মানে, নির্বাচনের কাজে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হতে পারে।

দেশে সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। সেটি ছিল ২০২৩–২৪ অর্থবছর। ওই বছর নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা; যার মধ্যে পরিচালন খরচ বাবদ বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা আর উন্নয়ন ব্যয় বাবদ বরাদ্দ ছিল ২০৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২০২৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচনের জন্য পরিচালন খরচ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে বিতর্ক ও নাট্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
  • নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ ২,৯৫৬ কোটি টাকা
  • ফনিক্স ফাইন্যান্সের এজিএমের তারিখ পরিবর্তন
  • দিল্লি সকালেও আঁচ করতে পারেনি, দিন শেষে ভারতে পালাতে বাধ্য হবেন শেখ হাসিনা
  • শুল্কনীতি নিয়ে ট্রাম্পের হুমকিকে ‘অন্যায্য ও অযৌক্তিক’ বলল ভারত
  • বিশ্বে ছাত্রদের নেতৃত্বে শীর্ষ ১০টি আন্দোলন
  • ৫ আগস্ট চিরদিনের জন্য আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে: বাঁধন
  • আশা আর অচলাবস্থার দোলাচলে দেশ 
  • প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচ