ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে বের করতে আলোচনার জন্য ১৫ আগস্ট শুক্রবার আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ সেনাদের ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।

ক্ষমতায় গেলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন—নির্বাচনী প্রচারের সময় এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কয়েক মাসে ইউক্রেনে একটি শান্তিচুক্তির জন্য চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু একাধিক দফায় শান্তি আলোচনা, ফোনে আলোচনা ও কূটনৈতিক সফরের পরও এখন পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধে উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।

ট্রাম্প শুরুতে পুতিনকে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আলোচনার মধ্যমে একটি শান্তিচুক্তির জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করেছেন। তাতে অগ্রগতি না হওয়ায় এখন অর্থনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে পুতিনকে ইউক্রেনে হামলা বন্ধ করতে বাধ্য করতে চাইছেন।

‘ইউক্রেন ও রাশিয়া—উভয়ের মঙ্গলের জন্য কিছু এলাকা অদলবদল করা হবে।’ এ নিয়ে বিস্তারিত আর কোনো কিছু তিনি বলেননিডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট

ট্রাম্পের এই চাপ প্রয়োগের মধ্যেই দুই নেতার বৈঠক ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের পথে বড় অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের জন্য কেন আলাস্কা বেছে নেওয়া হয়েছে, ওই বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সশরীর উপস্থিত থাকবেন কি না, বা তাঁকে ফোনে যুক্ত করা হবে কি না, এসব নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।

কখন ও কোথায়

নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, পুতিনের সঙ্গে তাঁর আসন্ন বৈঠক হবে ১৫ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের সুদূর উত্তরাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য আলাস্কায়।

পরে ক্রেমলিন থেকেও বৈঠকের খবর নিশ্চিত করা হয়।

কয়েক দিন ধরে দুই পক্ষ থেকে আগামী সপ্তাহে দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক হওয়া নিয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। এবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এল।

গতকাল শুক্রবার ক্রেমলিন আলাস্কায় শীর্ষ বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করে একে ‘একেবারেই যৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেছে।

ট্রাম্প শুরুতে পুতিনকে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আলোচনার মধ্যমে একটি শান্তিচুক্তির জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করেছেন। তাতে অগ্রগতি না হওয়ায় এখন অর্থনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে পুতিনকে ইউক্রেনে আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য করতে চাইছেন।

এর আগের দিন গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প বলেন, ‘তাঁরা আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন, এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে আমার পক্ষে যা সম্ভব, তার সবই আমি করব।’

এখানে ‘তাঁরা’ বলতে ট্রাম্প রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কথা বুঝিয়েছেন।

বৈঠকের বিষয়ে গতকাল হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেন ও রাশিয়া—উভয়ের মঙ্গলের জন্য কিছু এলাকা অদলবদল করা হবে।’ এ নিয়ে বিস্তারিত আর কোনো কিছু তিনি বলেননি।

কেন আলাস্কা

ট্রাম্প-পুতিন আসন্ন বৈঠকটি আলাস্কায় অনুষ্ঠিত হবে। ১৮৬৭ সালে রাশিয়া অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। অঙ্গরাজ্যটির পশ্চিম প্রান্ত থেকে রাশিয়ার পূর্বতম অংশ খুব বেশি দূরে নয়, মাঝে শুধু বেরিং প্রণালি।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র ইউরি উশাকভ টেলিগ্রামে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আলাস্কা ও আর্কটিক এমন অঞ্চল, যেখানে আমাদের দুই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের মিল রয়েছে এবং বড় পরিসরে পারস্পরিকভাবে লাভজনক প্রকল্পের সম্ভাবনাও আছে।’

তবে এবারের বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ অধিক মনযোগ পাবে বলে জানান উশাকভ।

উশাকভ বলেন, ‘প্রেসিডেন্টরা অবশ্যই সন্দেহাতীতভাবে এবার ইউক্রেন সংকটের দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাব্য উপায়গুলো নিয়ে আলোচনায় মনোযোগ দেবেন।’

দুই প্রেসিডেন্টের পরবর্তী সাক্ষাৎ রাশিয়ার মাটিতে হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন উশাকভ। তিনি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এরই মধ্যে সে অনুযায়ী আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে।

আলাস্কা ও আর্কটিক এমন অঞ্চল, যেখানে আমাদের দুই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের মিল রয়েছে এবং বড় পরিসরে পারস্পরিকভাবে লাভজনক প্রকল্পের সম্ভাবনাও আছেইউরি উশাকভ, ক্রেমলিনের সহযোগী

পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। এ কারণে পুতিন আইসিসির সদস্যদেশগুলোতে গেলে তারা পুতিনকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে। স্বাভাবিকভাবেই তাই ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের স্থান ঠিক করতে এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্যরাষ্ট্র নয়।

পুতিন আগে বৈঠকের সম্ভাব্য আয়োজক হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আর গণমাধ্যম বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদন করেছিল, সম্ভাব্য স্থান হতে পারে তুরস্ক, চীন বা এমনকি ভারতও।

জেলেনস্কি কি থাকবেন

জেলেনস্কি এই বৈঠককে ত্রিপক্ষীয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি বারবার বলেছেন, পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাই শান্তির পথে অগ্রগতির একমাত্র উপায়।

ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এ সপ্তাহের শুরুর দিকে রাশিয়া সফরে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনা সম্ভবত নাকচ করে দিয়েছেন বলেই মনে হয়েছে।

পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। এ কারণে পুতিন আইসিসির সদস্যদেশগুলোতে গেলে তারা পুতিনকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে।

গত জুনে ইস্তাম্বুলে আলোচনার সময় রুশ আলোচকেরা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পুতিন-জেলেনস্কি সাক্ষাৎ কেবল আলোচনার ‘শেষ ধাপে’ হতে পারে, যখন উভয় পক্ষ শান্তিচুক্তির শর্তে একমত হবে।

শীর্ষ বৈঠকের শর্ত হিসেবে পুতিনকে কি অবশ্যই জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে হবে, গতকাল ট্রাম্পকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, ‘না, তাঁকে করতে হবে না।’

আরও পড়ুন১৫ আগস্ট আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বসবেন ট্রাম্প, ইঙ্গিত দিলেন অঞ্চল বিনিময়ের৫ ঘণ্টা আগে

শেষ কবে ট্রাম্প-পুতিন সাক্ষাৎ হয়েছিল

ট্রাম্প ও পুতিন সর্বশেষ মুখোমুখি হয়েছিলেন ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে, ২০১৯ সালে জাপানে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে তাঁরা কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেছেন।

পুতিন তার আগে ২০১৮ সালে হেলসিঙ্কিতে ট্রাম্পের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেছিলেন। সে সময় ট্রাম্প প্রকাশ্যে পুতিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে হওয়ায় সমালোচনা হয়েছিল।

রাশিয়া ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে বা করার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত জুনে ইস্তাম্বুলে আলোচনার সময় রুশ আলোচকেরা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পুতিন-জেলেনস্কি সাক্ষাৎ কেবল আলোচনার ‘শেষ ধাপে’ হতে পারে, যখন উভয় পক্ষ শান্তিচুক্তির শর্তে একমত হবে।

আলোচনা কী অবস্থায় আছে

কূটনৈতিক তৎপরতা ও একাধিক দফায় শান্তি আলোচনার পরও ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে কোনো সমঝোতার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও ইউরোপ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। যে আহ্বান তিনি এখন পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছেন।

গত জুনে যে আলোচনা হয়েছিল সেখানে রাশিয়া দাবি করেছিল, রাশিয়া ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চলের দখল নিয়েছে, সেগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে, কিয়েভকে ওই অঞ্চলগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এ ছাড়া ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে হবে, পশ্চিমা সামরিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং ন্যাটোতে যোগদান করতে পারবে না।

আর কিয়েভ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চায়। তারা বলেছে, নিজেদের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ তারা কখনো স্বীকার করবে না। তবে তারা এটা স্বীকার করেছে, রাশিয়ার দখলকৃত ভূমি ফেরত পেতে হলে তাদের যুদ্ধ করে নয়, বরং কূটনৈতিক পথেই এগোতে হবে।

কিয়েভ পশ্চিমা সমর্থকদের কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাইছে, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে বিদেশি সেনা মোতায়েনের বিষয়টিও।

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি চুক্তির পরই পুতিন-জেলেনস্কির বৈঠক সম্ভব: রাশিয়া১৭ মে ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইউক র ন য দ ধ য দ ধ বন ধ ইউক র ন ও ইউক র ন র আল স ক য় ক টন ত ক ক প রক কর ছ ল হয় ছ ল বন ধ ক র জন য আইস স

এছাড়াও পড়ুন:

চাকরি পাচ্ছেন না গাজীপুরের কাজ হারানো শ্রমিকেরা, কী করছেন তাঁরা

এক যুগের বেশি সময় বেক্সিমকোর পোশাক কারখানায় চাকরি করেছেন মনির শেখ। চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কারখানায় ঘুরেও চাকরি পাননি। বাধ্য হয়ে এখন সবজি বিক্রি করছেন। শুধু মনির শেখ নন, কাজ হারানো শ্রমিকদের অনেকেই পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।

চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কারখানায় নতুন চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন মনির শেখ; কিন্তু যখনই কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, তিনি আগে বেক্সিমকোতে কাজ করেছেন, তখনই না করে দেয়। চাকরি জোটেনি; কিন্তু কিছু একটি তো করে পেট চালাতে হবে। সে জন্য এখন সবজি বেচে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

গত সপ্তাহের রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর চক্রবর্তী বাজার এলাকায় মনির শেখের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনেক শ্রমিক পেশা বদল করেছেন; অনেকে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বাস্তবতা হলো ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ গাজীপুরের ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি শিল্পকারখানা নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়। শিল্প পুলিশের তথ্যানুসারে, চাকরি হারিয়েছেন ৭৩ হাজার শ্রমিক। অনেক শ্রমিক আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি পেলেও হাজার হাজার শ্রমিক এখনো বেকার। অনেকেই চাকরি না পেয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন; সবজি বিক্রি, ফেরি করে পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে নানা ধরনের পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।

যশোরের কোতোয়ালি থানার নূরপুর গ্রামের বাসিন্দা জামাল হোসেন চক্রবর্তী এলাকায় মামুনের কলোনিতে ভাড়া থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আট-নয় বছর বেক্সিমকোতে কাজ করছেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। কিছুদিন হালচাষ করেছেন; কিন্তু সেই কাজ ভালো লাগেনি। এরপর স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে রেখে দুই মাস আগে নতুন চাকরি খুজেতে আসেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন চাকরি পাচ্ছেন না।

একই কলোনির ভাড়াটিয়া আনিসুর রহমান বলেন, ‘নতুন চাকরি না পাইয়া এখন ফেরি কইরা জিনিসপত্র বিক্রি করতাছি। সংসার তো চালাইতে অইবো—কী করমু কন।’

গত ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থাভাবে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানিমুখী বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা। বেকার হন এসব কারখানার ২৮ হাজার ৫১৩ শ্রমিক। কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছেন শ্রমিকেরা।

গাজীপুর মহানগরের চক্রবর্তী এলাকায় বসবাস করে থেকে ১২ বছরের বেশি সময় বেক্সিমকোতে চাকরি করেছেন জামাল হোসেন। তিনি বলেন, কারখানায় যখন কাজ করেছেন, তখন স্ত্রী–সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন। ছেলেকে কারখানা এলাকায় একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্ট হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করেও কাজ পাচ্ছেন না। এই মাসে (আগষ্ট) চাকরি না পেলে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবেন বলে পরিকল্পনা করছেন।

কলকারখানা, পরিদর্শন অধিদপ্তর ও শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু বেক্সিমকো নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে জুলাই পর্যন্ত গাজীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে ৪১টি। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টিসহ মাহমুদ জিনস, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্ল্যাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলসসহ বিজিএমইএভুক্ত বড় ২০টি প্রতিষ্ঠান।

গত সপ্তাহের রোববার সকালে বেক্সিমকো কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, আগের সেই চিরচেনা হইচই নেই। মানুষের আনাগোনা একেবারেই কমে গেছে। আগে যেখানে শ্রমিকদের ভিড়ে সড়কে হাঁটা কঠিন ছিল, সেখানে এখন নীরবতা নেমে এসেছে। শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে এলাকায় শত শত বাড়িঘর তৈরি করেছিলেন স্থানীয় লোকজন। এখন প্রায় সব বাড়িতেই ঝুলছে ‘বাসা খালি আছে’ নোটিশ। অধিকাংশ বাড়িঘরই এখন খালি পড়ে আছে।

স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, আগে যেখানে সারা দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি হতো, এখন সেখানে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। সারা দিনই বসে বসে কাটাতে হয়। আরেক ব্যবসায়ী শংকর চন্দ্র পাল বলেন, মাসের বেতনের সময় হলে কয়েক ভরি গয়না বিক্রি হতো, এখন বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। টিভি আর মুঠোফোনে ভিডিও দেখে সময় পার করছি।

চক্রবর্তী এলাকার বাড়ির মালিক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তাঁর কলোনিতে ৪৫টি কক্ষ আছে। আগে সব কক্ষেই ভাড়াটিয়া ছিলেন; কিন্তু এখন মাত্র সাতটি কক্ষে ভাড়াটিয়া আছে, বাকিগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। এই অবস্থা এলাকার সব বাসায়। অনেকেই ব্যাংকঋণ নিয়ে বহুতল ভবন করেছেন। তাঁরা এখন ব্যাংকের ঋণও দিতে পারছেন না।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। কারখানার শ্রমিক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নতুন চাকরি পাচ্ছেন না। পরে বাধ্য হয়ে এখন চন্দ্রা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে অটোরিকশা চালাচ্ছেন। মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় হলেও পেশা মনমতো হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হচ্ছে তাঁকে।

জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে যাদের চাকরি চলে গেছে, তাঁদের বেশির ভাগই বেকার, অধিকাংশই গ্রামে ফিরে গেছে। অনেকেই ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। এখনো যাঁরা কাজ করছেন, সেই সব শ্রমিকের মধ্যে ছাঁটাই আতঙ্ক আছে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আল মামুন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ অনেকটাই কমেছে। তবে এখন কিছু কারখানায় নানা ধরনের জটিলতা আছে। যে কারণে শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন। আগে থেকেই টের পেয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হচ্ছে। ফলে সেভাবে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে না।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে,  বন্ধ কারখানাগুলোর বেশির ভাগই কাজ না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল ও আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ