চট্টগ্রামে রডবাহী গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী স্কুলছাত্র নিহত
Published: 9th, August 2025 GMT
চট্টগ্রাম নগরের পলিটেকনিক সড়কে লোহার রডবাহী ট্রেলারের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী এক স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে। এতে মোটরসাইকেল আরোহী আরও দুই কিশোর গুরুতর আহত হয়েছে। হতাহত তিনজনের বয়সই ১৭ বছর। আজ শনিবার সন্ধ্যা ছয়টায় পলিটেকনিক সড়কের আগা খাঁর মোড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
নগরের খুলশী থানার তথ্য অনুযায়ী, নিহত স্কুলছাত্রের নাম মোহাম্মদ সজীব। সে নগরের পাহাড়তলী এলাকার একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পরিবারের সঙ্গে পাহাড়তলীর এক্সইএন কলোনিতে ভাড়া থাকত সে। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অন্য দুজন হলো নাহিদ হায়দার ও মো.
খুলশী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুবীর পাল প্রথম আলোকে বলেন, লোহার রড নিয়ে ট্রেলার যাচ্ছিল। এ সময় সজীবদের বহনকারী মোটরসাইকেলের সঙ্গে ট্রেলারের ধাক্কা লাগে। মোটরসাইকেলটিতে তিনজন আরোহী ছিল। ঘটনাস্থলেই সজীবের মৃত্যু হয়। অন্য দুজনও আহত হয়। স্থানীয় লোকজন তাদের চমেক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এম এন লারমার জীবন: আত্মত্যাগের এক অনন্য দলিল
পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাগুলোর স্বীকৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এক কেন্দ্রবিন্দু। এই সংগ্রামের কেন্দ্রস্থলে ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) ও তাঁরই অনুজ জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তাঁদের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগ এখানকার আদিবাসী জাতিসত্তাগুলোর জীবন ও চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
শৈশব ও জাগরণরাঙামাটির মহাপুরম গ্রামে এম এন লারমা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালে, আর তাঁর ছোট ভাই সন্তু লারমা ১৯৪৪ সালে। এম এন লারমা ১৯৫৬ সাল থেকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনে পা দেন। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলনে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন।
কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কারণে হাজারও মানুষের বাস্তুচ্যুতি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে নিবর্তনমূলক আইনে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৫ সালে তিনি আবার কারাগার থেকে মুক্ত হন। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিরোধ সংগ্রাম১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে লারমা ভ্রাতৃদ্বয়ের আন্দোলন তাঁদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিণত করে। এম এন লারমা ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে চার দফাসংবলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করেন।
১৯৭২ সালে যখন সংবিধান সব নাগরিককে ‘বাঙালি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অস্বীকার করে, তখন এম এন লারমা এর প্রতিবাদস্বরূপ গণপরিষদ থেকে ওয়াকআউট করেন। বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্কের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।...কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দপুরুষ—কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা দশটি ছোট ছোট জাতি বাস করি। চাকমা, মগ (মারমা), ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরং ও চাক—এই দশ ছোট ছোট জাতি সবাই মিলে আমরা নিজেদের “পাহাড়ি” বা “জুম্ম জাতি” বলি।’
এম এন লারমা শুধু পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথাই বলেননি। গণপরিষদ বিতর্কের সময় তিনি দেশের মাঝিমাল্লা, জেলে, প্রান্তিক কৃষক, রিকশাচালক, কলকারখানার শ্রমিক, নারী থেকে শুরু করে সব প্রান্তিকের মানুষের অধিকারের কথা তুলে ধরেছিলেন এবং সংবিধানে তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে তিনি পাহাড়ের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময় তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পাহাড়ের জাতিসত্তাগুলোর আন্দোলনে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ধারণা যুক্ত করেন, যা ছিল বিশ্বব্যাপী খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামের একটি দার্শনিক ভিত্তি।
তিনি পাহাড়ে আদিবাসী সমাজে শ্রেণি বিশ্লেষণের দ্বারা রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করেছিলেন, যাতে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শত্রু–মিত্র চিহ্নিত করা যায়। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাঁকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। ১৯৭৭ ও ১৯৮২ সালের জাতীয় সম্মেলনে তিনি জনসংহতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর তিনি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে নিহত হন, কিন্তু মৃত্যু হলেও তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ অমরত্ব পেয়ে যায়।
সংগ্রামের উত্তরাধিকার: আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষাজ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর সন্তু লারমা জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং শান্তিবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। অবশেষে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাগুলোর ন্যূনতম রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের দ্বারা পাহাড়ে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। পরবর্তী সময় তিনি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠনের সভাপতি হিসেবে সারা দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
এম এন লারমা ও সন্তু লারমা ভ্রাতৃদ্বয়ের গল্প যেন এক আধুনিক উপকথা, যা বৌদ্ধ জাতক কাহিনির মহানন্দিক ও চুল্লনন্দিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই উপকথা আমাদের শেখায়—নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে দিকনির্দেশনা দিতে পারে, তৈরি করতে পারে ইতিহাস।
এম এন লারমার আত্মত্যাগ এই আন্দোলনকে দিয়েছে নৈতিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা, আর সন্তু লারমার নেতৃত্বে সেই আন্দোলন পেয়েছে সূত্রবদ্ধ কাঠামো, গতি ও ধারাবাহিকতা।
এম এন লারমার সংগ্রামী জীবনের আখ্যান কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়; এটি আত্মত্যাগ, দূরদর্শিতারও দলিল। তাঁর জীবন প্রমাণ করে যে সত্যিকারের নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতার অনুসন্ধান নয়—এটি গণমানুষের প্রতি অবিচল আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতি। যেখানে নিপীড়ন ও অস্বীকৃতির রাজনীতি প্রায়ই ন্যায় ও মানবতাকে ম্লান করে দেয়, সেখানে লারমার জীবন ও সংগ্রাম পাহাড়ে হয়ে উঠেছে অধিকার, স্বীকৃতি ও মর্যাদার জন্য সংগ্রামরত মানুষের কাছে এক দীপ্ত আলোকবর্তিকা।
মিলিন্দ মারমা: লেখক ও অধিকারকর্মী
Email: [email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)