পুলিশের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহি ভেঙে পড়েছিল: হাইকোর্ট
Published: 11th, August 2025 GMT
এক দশকের বেশি সময় আগে পল্লবীতে পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন ওরফে জনির মৃত্যু হয়। তাঁকে আটক, থানাহাজতের পরিবর্তে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে রাখা এবং আটকে রেখে নির্যাতন সম্পূর্ণ বেআইনি। নির্দিষ্ট এ ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধান, তদারকি ও জবাবদিহি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। নিরপরাধ একজন যুবকের মূল্যবান জীবন ও অন্যদের নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় পুলিশ বিভাগ নৈতিক দায় এড়াতে পারে না বলে রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এ রায় দেন। হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে জনির মৃত্যুতে করা মামলায় তিন আসামির আপিলের ওপর শুনানি শেষে আজ দ্বিতীয় দিনে রায় ঘোষণা শেষ করেন আদালত।
ঘটনা, পারিপার্শ্বিকতা ও সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে আদালত বলেন, নিরপরাধ যুবকের মূল্যবান জীবন ও অন্যদের নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় পুলিশ বিভাগ তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। যেখানে জনিসহ চারজনকে হেফাজতে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। পুলিশ বিভাগ বা সরকার ভুক্তভোগীর (জনি) বিধবা মা, বিধবা স্ত্রী এবং দুই সন্তানের পুনর্বাসনের জন্য এগিয়ে আসতে পারে।
২০১৩ সালে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণয়ন করা হয়। জনিকে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট মামলা করা হয়। এটা ওই আইনে করা প্রথম কোনো মামলা। এ মামলায় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রায় দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ।
বিচারিক আদালতের রায়ে পাঁচ আসামির মধ্যে তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রায়ে পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই জাহিদুর রহমান, এএসআই রাশেদুল হাসান ও কামরুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। তাঁদের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। অপর দুই আসামি পুলিশের তথ্যদাতা (সোর্স) সুমন ও রাসেলের ৭ বছর করে কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন বিচারিক আদালত।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তিন আসামি হাইকোর্টে পৃথক আপিল করেন। তাঁরা হলেন জাহিদুর, রাশেদুল ও রাসেল। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুসারে, বিচারিক আদালতে দণ্ডিত পাঁচ আসামির মধ্যে কামরুজ্জামান শুরু থেকে পলাতক। অপর আসামি সুমন সাজা ভোগ করে বেরিয়েছেন।
তিন আসামির পৃথক আপিলের ওপর একসঙ্গে গত ৯ জুলাই হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। ৭ আগস্ট শুনানি শেষে আদালত রায়ের জন্য ১০ আগস্ট তারিখ নির্ধারণ করেন। ১০ আগস্ট রায় ঘোষণা শুরু করেন আদালত, যা আজ শেষ হয়।
এক আসামির যাবজ্জীবন বহাল, অন্যজনের ১০ বছর, খালাস এক
হাইকোর্ট রায়ে রাজধানীর পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন। বিচারিক আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পল্লবী থানার তৎকালীন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল হাসানের সাজা পরিবর্তন করে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে জনির মায়ের অনুকূলে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারিক আদালতের রায়ে সাত বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত রাসেলকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
সবই বেআইনি: হাইকোর্ট
রায় ঘোষণার এক পর্যায়ে আদালত বলেন, এ রকম সাধারণত হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই হেফাজতে দু–একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দুর্ধর্ষ অপরাধী পুলিশ ধরে, যেমন হাজার কোটি টাকার মাদকের কারবারি। তাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রক্রিয়ায় মারা যেতে পারে। এটাও অপরাধ। এ ক্ষেত্রে মনোভাব থাকে যে অপরাধী। নিরপরাধ লোকদের ধরবেন, আইনগত কারণ ছাড়া তাদের হাজতখানায় না রেখে আরেক জায়গায় নিয়ে নির্যাতন করা সবই বেআইনি। একজন মানুষকে গ্রেপ্তারের পর হাজতখানায় রাখতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে (জনির) পুলিশ বিভাগ কিছু করল না, মিথ্যা মামলা দায়ের করে।
নথিপত্র, সাক্ষী ও তথ্যাদি পর্যালোচনা করে রায়ে আদালত বলেন, ধারাবাহিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের কারণে জনির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, পুলিশের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধান, তদারকি ও জবাবদিহি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল—নির্দিষ্ট এ ঘটনার ক্ষেত্রে। জাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে অপ্রয়োজনীয় ও বেআইনিভাবে জনি ও তাঁর ভাই রকিসহ অন্যদের আটক করা হয়। যেখানে ভুক্তভোগীর (জনির) ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার অতীত কোনো রেকর্ড নেই। বেআইনিভাবে আটক করে তাঁদের হাজতখানার পরিবর্তে থানার প্রথম তলায় (দ্বিতীয়) রাখা হয়। এভাবে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কিছু পুলিশ কর্মকর্তার চোখের সামনে তাঁদের নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। কোড–বিধি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চালানো অমানবিক ও নিষ্ঠুর এ ঘটনার বিষয়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো রিপোর্টও করেননি। গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনার পর সকালে পুলিশ মামলা করে। তাতে দুই পক্ষের মারামারির কারণে ভুক্তভোগী (জনি) আহত হয়ে মারা যান উল্লেখ করা হয়, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি অপরাধী পুলিশ সদস্যদের আড়াল করার চেষ্টা, যেখানে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদারকি ও জবাবদিহি প্রক্রিয়া পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।
আদালতে আসামিপক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও মো.
রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বদিউজ্জামান তপাদার প্রথম আলোকে বলেন, আসামি রাসেলকে খালাস দেওয়া হয়েছে, যা যুক্তিযুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়া সাপেক্ষে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এ ঘটন র আস ম র জন র ম অপর ধ আগস ট ব আইন
এছাড়াও পড়ুন:
সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সন্নিকটের নয়টি বালুমহালের ইজারা কার্যক্রম স্থগিত
কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু ও উখিয়া—এই তিন উপজেলার সংরক্ষিত–রক্ষিত বনাঞ্চল এবং সন্নিকটে অবস্থিত নয়টি বালুমহালের ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। ওই বন এলাকা থেকে বালু উত্তোলনে জড়িত ইজারাগ্রহীতাসহ দোষী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি এবং বালু উত্তোলনের ফলে বনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণ করে তিন মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার রুলসহ এ আদেশ দেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) গত মাসে রিটটি করে।
নয়টি বালুমহাল হচ্ছে চকরিয়ার খুটাখালী মৌজার খুটাখালী-১; রামুর ধোলিরছড়া মৌজার ধলিরছড়া এবং পানিরছড়া খাল; উখিয়ার উখিয়া ঘাট মৌজার বালুখালী-১, উয়ালাপালং এবং রাজাপালং মৌজার দোছড়ি বালুমহাল, পালংখালী মৌজার পালংখালী; রাজাপালং মৌজার হিজলিয়া, ধোয়াংগারচর ও কুমারিয়ারছড়া।
আদালতে বেলার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ আশরাফ আলী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. গোলাম রহমান ভূঁইয়া।
বেলা জানায়, জেলা প্রশাসক কক্সবাজার জেলার ৫টি উপজেলায় মোট ২৭টি বালুমহালের তালিকা প্রস্তুত করে ২০২৫-২৬ (১৪৩২ বঙ্গাব্দ) সালের জন্য ইজারার উদ্দেশ্যে গত ১১ মার্চ দরপত্র আহবান করেন। ২৭টি বালুমহালের মধ্যে ওই ৯টি বালুমহাল সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনের মধ্যে এবং কাছাকাছি। তাই সংশ্লিষ্ট বনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের সম্ভাব্য ক্ষতি বিবেচনা করে ওই বালুমহালগুলো ইজারা প্রদান থেকে বিরত থাকতে কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেন। এই অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনটি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। অন্যগুলোর ইজারাপ্রক্রিয়া চলমান। এ অবস্থায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বালু উত্তোলনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সংরক্ষিত ও রক্ষিত বন রক্ষায় রিটটি করে।
নয়টি বালুমহাল ইজারার জন্য তালিকাভুক্ত করা সংবিধান ও অন্যান্য আইনের পরিপন্থী বলে কেন তা বেআইনি ও জনস্বার্থবিরোধী ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে বলে জানান বেলার অন্যতম আইনজীবী এস হাসানুল বান্না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই বালুমহালগুলো বিলুপ্ত ঘোষণা এবং ইজারাযোগ্য বালুমহালের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সংরক্ষিত–রক্ষিত বনাঞ্চলের সুরক্ষা নিশ্চিতের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে। বালু উত্তোলনের ক্ষতি নিরূপণ করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, রুলে তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে।