এক দশকের বেশি সময় আগে পল্লবীতে পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন ওরফে জনির মৃত্যু হয়। তাঁকে আটক, থানাহাজতের পরিবর্তে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে রাখা এবং আটকে রেখে নির্যাতন সম্পূর্ণ বেআইনি। নির্দিষ্ট এ ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধান, তদারকি ও জবাবদিহি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। নিরপরাধ একজন যুবকের মূল্যবান জীবন ও অন্যদের নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় পুলিশ বিভাগ নৈতিক দায় এড়াতে পারে না বলে রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এ রায় দেন। হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে জনির মৃত্যুতে করা মামলায় তিন আসামির আপিলের ওপর শুনানি শেষে আজ দ্বিতীয় দিনে রায় ঘোষণা শেষ করেন আদালত।

ঘটনা, পারিপার্শ্বিকতা ও সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে আদালত বলেন, নিরপরাধ যুবকের মূল্যবান জীবন ও অন্যদের নির্যাতন থেকে সুরক্ষায় পুলিশ বিভাগ তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। যেখানে জনিসহ চারজনকে হেফাজতে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। পুলিশ বিভাগ বা সরকার ভুক্তভোগীর (জনি) বিধবা মা, বিধবা স্ত্রী এবং দুই সন্তানের পুনর্বাসনের জন্য এগিয়ে আসতে পারে।

২০১৩ সালে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণয়ন করা হয়। জনিকে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট মামলা করা হয়। এটা ওই আইনে করা প্রথম কোনো মামলা। এ মামলায় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রায় দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ।

বিচারিক আদালতের রায়ে পাঁচ আসামির মধ্যে তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রায়ে পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই জাহিদুর রহমান, এএসআই রাশেদুল হাসান ও কামরুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। তাঁদের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। অপর দুই আসামি পুলিশের তথ্যদাতা (সোর্স) সুমন ও রাসেলের ৭ বছর করে কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন বিচারিক আদালত।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তিন আসামি হাইকোর্টে পৃথক আপিল করেন। তাঁরা হলেন জাহিদুর, রাশেদুল ও রাসেল। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুসারে, বিচারিক আদালতে দণ্ডিত পাঁচ আসামির মধ্যে কামরুজ্জামান শুরু থেকে পলাতক। অপর আসামি সুমন সাজা ভোগ করে বেরিয়েছেন।

তিন আসামির পৃথক আপিলের ওপর একসঙ্গে গত ৯ জুলাই হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। ৭ আগস্ট শুনানি শেষে আদালত রায়ের জন্য ১০ আগস্ট তারিখ নির্ধারণ করেন। ১০ আগস্ট রায় ঘোষণা শুরু করেন আদালত, যা আজ শেষ হয়।

এক আসামির যাবজ্জীবন বহাল, অন্যজনের ১০ বছর, খালাস এক

হাইকোর্ট রায়ে রাজধানীর পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন। বিচারিক আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পল্লবী থানার তৎকালীন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল হাসানের সাজা পরিবর্তন করে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে জনির মায়ের অনুকূলে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারিক আদালতের রায়ে সাত বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত রাসেলকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

সবই বেআইনি: হাইকোর্ট

রায় ঘোষণার এক পর্যায়ে আদালত বলেন, এ রকম সাধারণত হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই হেফাজতে দু–একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দুর্ধর্ষ অপরাধী পুলিশ ধরে, যেমন হাজার কোটি টাকার মাদকের কারবারি। তাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রক্রিয়ায় মারা যেতে পারে। এটাও অপরাধ। এ ক্ষেত্রে মনোভাব থাকে যে অপরাধী। নিরপরাধ লোকদের ধরবেন, আইনগত কারণ ছাড়া তাদের হাজতখানায় না রেখে আরেক জায়গায় নিয়ে নির্যাতন করা সবই বেআইনি। একজন মানুষকে গ্রেপ্তারের পর হাজতখানায় রাখতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে (জনির) পুলিশ বিভাগ কিছু করল না, মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

নথিপত্র, সাক্ষী ও তথ্যাদি পর্যালোচনা করে রায়ে আদালত বলেন, ধারাবাহিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের কারণে জনির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, পুলিশের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধান, তদারকি ও জবাবদিহি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল—নির্দিষ্ট এ ঘটনার ক্ষেত্রে। জাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে অপ্রয়োজনীয় ও বেআইনিভাবে জনি ও তাঁর ভাই রকিসহ অন্যদের আটক করা হয়। যেখানে ভুক্তভোগীর (জনির) ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার অতীত কোনো রেকর্ড নেই। বেআইনিভাবে আটক করে তাঁদের হাজতখানার পরিবর্তে থানার প্রথম তলায় (দ্বিতীয়) রাখা হয়। এভাবে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কিছু পুলিশ কর্মকর্তার চোখের সামনে তাঁদের নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। কোড–বিধি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চালানো অমানবিক ও নিষ্ঠুর এ ঘটনার বিষয়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো রিপোর্টও করেননি। গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনার পর সকালে পুলিশ মামলা করে। তাতে দুই পক্ষের মারামারির কারণে ভুক্তভোগী (জনি) আহত হয়ে মারা যান উল্লেখ করা হয়, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি অপরাধী পুলিশ সদস্যদের আড়াল করার চেষ্টা, যেখানে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদারকি ও জবাবদিহি প্রক্রিয়া পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।

আদালতে আসামিপক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও মো.

সরওয়ার আহমেদ এবং আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ও নাজমুল করিম শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বদিউজ্জামান তপাদার শুনানি করেন। বাদীপক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এস এম রেজাউল করিম। রায় ঘোষণার দুই দিন পুরোটা সময় মামলার বাদী নিহত ইশতিয়াকের ভাই ইমতিয়াজ হোসেন ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বদিউজ্জামান তপাদার প্রথম আলোকে বলেন, আসামি রাসেলকে খালাস দেওয়া হয়েছে, যা যুক্তিযুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়া সাপেক্ষে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এ ঘটন র আস ম র জন র ম অপর ধ আগস ট ব আইন

এছাড়াও পড়ুন:

ভাইকে বাঁচাতে বান্ধবীকে ফাঁসানোর অভিযোগ

পাবনার ভাঙ্গুড়ায় ঘুমন্ত অবস্থায় বান্ধবীর ছবি তুলেছিলেন ভাই। বিষয়টি নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানালে ভাইকে বাঁচাতে উল্টো বান্ধবীর নামে মিথ্যা চুরির মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে তানিয়া হক নামের এক নারীর বিরুদ্ধে। 

এছাড়াও চুরির ঘটনার কোনো তদন্ত ছাড়াই মামলা নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।

মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পাবনা জেলা জজকোর্টের সামনে গণমাধ্যমকে এসব কথা বলেন ভুক্তভোগী নারী ইফফাত মোকাররমার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল। 

পাবনা সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আখতারুজ্জামানের আদালত ভুক্তভোগী নারী ইফফাত মোকাররমা সানিমুনকে জামিন দিয়েছেন।

অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল বলেন, “আমার মক্কেল ইফফাত মোকাররমা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতায় পেশায় নিয়োজিত। তিনি একজন সম্মানিত লোক। মামলার বাদীর সঙ্গে তার দীর্ঘদিন বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের কারণে তার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলেন এবং একসঙ্গে ঘোরাঘুরির পর যখন রাত্রীযাপন করছিলেন সেই সময়ে বাদীর ভাই ইফফাত মোকাররমার ছবি তুলেছিলেন। বিষয়টি টের পেয়ে তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান এবং ছবিগুলো দেখানোর জন্য অনুরোধ করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরেরদিন সকালে আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে ইফফাত মোকাররমা ঢাকায় চলে যান এবং সেখানে জিডি করেন। কিন্তু এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে উল্টো ইফফাত মোকাররমার বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির মামলা দায়ের করেন তার বান্ধবী।”

তিনি আরো বলেন, “বাদী তানিয়া হক উল্লেখ করেছেন ২৬ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার চুরি হয়েছে যা তিনি তার শরীরে পড়ে তার বান্ধবীর সঙ্গে ঘুড়ে বেড়িয়েছিলেন। কিন্তু ওইদিনের ঘোরাঘুরির ছবিতে তার শরীরে কোনো স্বর্ণালঙ্কার ছিল না। এছাড়াও ঘটনার দুইদিনের মাথায় যেভাবে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে তাতে বোঝা যায় কোনো তদন্ত ছাড়াই থানা কোনো পক্ষ থেকে প্রভাবিত হয়ে মামলা গ্রহণ করেছেন।”

ভুক্তভোগী নারী ইফফাত মোকাররমা বলেন, “এই মামলার নূন্যতম প্রমাণ নেই। আমি যে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার ছাত্রদের সামনে দাঁড়াবো সেই অবস্থাও তারা আমাকে রাখেনি। আমার সন্তানসহ পুরো পরিবার সামাজিকভাবে হেয় পতিপন্ন হচ্ছে। আমি চাই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”

এ বিষয়ে মামলার বাদীর তানিয়া হকের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করে ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে ভাঙ্গুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, “উনি (আইনজীবী) উনার মক্কেলের জন্য এসব কথা বলতেই পারেন। উনার মক্কেলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এসব অভিযোগ করেছেন। কিন্তু ঘটনার তদন্ত করে এবং আইনানুগভাবেই মামলা দায়ের হয়েছে, যা এখনও তদন্ত চলছে।”

ঢাকা/শাহীন/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঋণ আদায়ে লাগবে ৩৩৩ বছর
  • ভাইকে বাঁচাতে বান্ধবীকে ফাঁসানোর অভিযোগ