ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া জিতেছে: হাঙ্গেরি
Published: 13th, August 2025 GMT
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া জিতেছে বলে মন্তব্য করেছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান। গতকাল মঙ্গলবার এ মন্তব্য করেন তিনি।
আগামী শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে অনুষ্ঠেয় শীর্ষ বৈঠককে সামনে রেখে অরবান এ মন্তব্য করলেন।
আমরা এখন এমনভাবে কথা বলছি, যেন যুদ্ধ এখনো চলমান; কিন্তু তা নয়। ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধে হেরেছেন। রাশিয়া এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছে।ভিক্টর অরবান, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা অরবান রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা ও ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তার বিরোধিতা করে কিছু ইউরোপীয় নেতার সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এদিকে তাঁর মন্ত্রিসভা মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্যও লড়ছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পরও পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন অরবান। গত সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র নেতা হিসেবে তিনি এক যৌথ বিবৃতিতে সই করেননি; যেখানে বলা হয়েছে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের তার স্বাধীনতা থাকা উচিত।
‘আমরা এখন এমনভাবে কথা বলছি, যেন যুদ্ধ এখনো চলমান; কিন্তু তা নয়। ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধে হেরেছেন। রাশিয়া এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছে,’ প্যাট্রিয়ট ইউটিউব চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন অরবান।
আরও পড়ুনপুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে কেন আলাস্কাকেই বেছে নিলেন ট্রাম্প১১ আগস্ট ২০২৫অরবান আরও বলেন, ‘এখন শুধু প্রশ্ন, কখন ও কোন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের পক্ষে থাকা পশ্চিমারা স্বীকার করবে যে এটি ঘটে গেছে এবং এর ফলাফল কী হবে।’
হাঙ্গেরি তার জ্বালানির বেশির ভাগ রাশিয়া থেকে আমদানি করে। দেশটি ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানেরও তীব্র বিরোধিতা করেছেন অরবান। তাঁর যুক্তি, এতে হাঙ্গেরির কৃষক ও বৃহত্তর অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে।
গত সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র নেতা হিসেবে অরবান এক যৌথ বিবৃতিতে সই করেননি; যেখানে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের তার স্বাধীনতা থাকা উচিত।অরবান বলেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ হাতছাড়া করেছে ইউরোপ। এখন ইউরোপের ভবিষ্যৎ তার অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্ধারিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
‘আপনি যদি আলোচনার টেবিলে না থাকেন, তবে আপনি মেনুতে থাকবেন,’ বলেন ভিক্টর অরবান। ইউক্রেন নিয়ে ইইউর যৌথ বিবৃতির আংশিক বিরোধিতা করার কারণ হিসেবে তিনি জানান, এতে ইউরোপকে ‘হাস্যকর ও করুণ’ দেখাচ্ছে।
আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি নয়, ইউক্রেনে নতুন করে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুতিন: জেলেনস্কি২০ ঘণ্টা আগে‘আপনি মেনুতে থাকবেন’ বলতে অরবান বুঝিয়েছেন, আপনি আলোচনার অংশ না হয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যাবেন; যেটা মোটেই ভালো নয়।
অরবান আরও বলেন, ‘যখন দুই নেতা—যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার একসঙ্গে আলোচনায় বসবেন, আর আপনাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হবে না; তখন আপনি ফোনের জন্য হুড়োহুড়ি করবেন না, দৌড়াদৌড়ি করবেন না, বাইরে থেকে চিৎকারও করবেন না।’
এ বক্তব্যের মাধ্যমে অরবান বোঝাতে চাচ্ছেন, যদি বড় কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকে (যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে) ইউরোপকে আমন্ত্রণই না জানানো হয়, তবে ইউরোপের কোনো ভূমিকা থাকবে না; বরং তারা শুধু সেই সিদ্ধান্তের শিকার হবে।
আরও পড়ুনকিয়েভের পাশে ইউরোপের নেতারা১০ আগস্ট ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন য ইউক র ন র ইউর প য মন ত র অরব ন
এছাড়াও পড়ুন:
নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি
কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।
করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।
বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।
অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।
আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।
বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।
ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।
কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।
যা করা যেতে পারে:
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।
সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়