ভারতের ওপর আরো শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের
Published: 14th, August 2025 GMT
ট্রাম্প-পুতিন আলোচনা ব্যর্থ হলে ভারতের ওপর শুল্ক আরো বাড়তে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট। তিনি বলেন, শুক্রবার আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের ফলাফলের ওপর সেকেন্ডারি শুল্ক আরোপের এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে। খবর বিবিসির।
স্থানীয় সময় বুধবার ব্লুমবার্গ টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বেসেন্ট বলেন, “আমরা রাশিয়ার তেল কেনার জন্য ভারতের ওপর ইতিমধ্যে অতিরিক্তি শুল্ক আরোপ করেছি। কিন্তু যদি পরিস্থিতি ঠিক না হয়, তাহলে নিষেধাজ্ঞা বা সেকেন্ডারি শুল্ক আরো বাড়তে পারে।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার তেল কেনায় ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে সম্প্রতি একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেছিলেন। এর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্যের ওপর মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ।
আরো পড়ুন:
পুতিন যুদ্ধ না থামালে ‘কঠোর পরিণতির’ হুমকি ট্রাম্পের
শুল্ক বৃদ্ধি আরো ৯০ দিন স্থগিত রাখতে একমত যুক্তরাষ্ট্র-চীন
যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে। বুধবার ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছেন, মস্কো যদি শান্তি চুক্তিতে রাজি না হয় তাহলে ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ কীভাবে শেষ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে ট্রাম্প এবং পুতিন শুক্রবার আলাস্কায় বৈঠকে বসবেন।
মার্কিন অর্থমন্ত্রী বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা করছেন। ইউক্রেন যুদ্ধে বন্ধের সমাধান কী শর্তে হওয়া উচিত তা নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপগুলো ইউরোপের যোগ দেওয়া উচিত।”
ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে দিল্লির সস্তা রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের আমদানি বৃদ্ধি ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলেছে এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা ব্যাহত করেছে।
রাশিয়া ভারতের অন্যতম শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালে ভারতের মোট অপরিশোধিত তেল আমদানির ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে; যা ২০২১ সালে ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।
দিল্লি রাশিয়ার তেল কেনা সমর্থন করে বলেছে, একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের স্বার্থে সাশ্রয়ী তেলের উৎস নিশ্চিত করা।
এর আগে মঙ্গলবার মার্কিন অর্থমন্ত্রী ফক্স বিজনেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাণিজ্য আলোচনায় ভারতকে ‘একটু অবাধ্য’ বলে মন্তব্য করার পর, এবার সেকেন্ডোরি শুল্ক আরো বাড়ানোর হুঁশিয়ারি দিলেন।
ট্রাম্প বলেছেন, বিভিন্ন দেশের ওপর তার প্রশাসনের শুল্ক আরোপ মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার এবং বিশ্ব বাণিজ্যকে আরো ন্যায্য করার পরিকল্পনার অংশ।
তিনি বারবার ভারতকে খুব বড় শুল্ক অপব্যবহারকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন এবং এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আগ্রহী।
দিল্লি এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা বেশ কয়েক মাস ধরেই চলছে। মার্কিন আলোচকরা আগামী ২৫ আগস্ট আবারো ভারত সফর করবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে ভারতের অস্বীকৃতি আলোচনার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের ওপর ট্রাম্পের নতুন ৫০ শতাংশ শুল্ক হার ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে চলেছে। এতে করে ভারত এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর আরোপিত মার্কিন বাণিজ্য অংশীদার হতে যাচ্ছে। ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে ভারতের বস্ত্র ও গহনার মতো রপ্তানি-কেন্দ্রিক শিল্পগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা ভারতের প্রবৃদ্ধি অর্ধেক শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে।
ঢাকা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র শ ল ক আর প ম র ক ন অর ইউক র ন
এছাড়াও পড়ুন:
নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি
কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।
করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।
বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।
অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।
আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।
বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।
ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।
কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।
যা করা যেতে পারে:
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।
সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়