গাজায় না খাইয়ে মানুষ মারা ও আমাদের বৈশ্বিক লজ্জা
Published: 17th, August 2025 GMT
অনাহার হলো ধীরে ধীরে শরীরকে ভেঙে দেওয়ার এক প্রক্রিয়া। প্রয়োজনীয় খাবার না পেলে শরীর প্রথমে লিভারে বা যকৃতে জমে থাকা শর্করা ব্যবহার করে। এরপর শুধু মস্তিষ্ক আর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য শরীর পেশি ও চর্বি গলিয়ে ফেলে এবং টিস্যু ভেঙে ফেলে। একসময় এ ভান্ডারও শেষ হয়ে যায়। তখন হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভেঙে যায়, মস্তিষ্ক কাজ করার ক্ষমতা হারাতে শুরু করে।
চামড়া হাড়ের সঙ্গে লেগে যায়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। একে একে অঙ্গগুলো বিকল হয়। দৃষ্টিশক্তি কমে আসে। শরীর ফাঁকা হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। এটি এক দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
আরও পড়ুনগাজা দখল করে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গড়তে চান নেতানিয়াহু১২ আগস্ট ২০২৫আজ আমরা সে দৃশ্যই গাজায় দেখছি। কঙ্কালসার নবজাতক আর শিশু মায়ের কোলে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে অনাহারে। এর মধ্যেই ইসরায়েল যুদ্ধ আরও তীব্র করেছে। তারা গাজা সিটি ‘দখল’ করার নামে নতুন অভিযান শুরু করেছে। ফলে আরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হয় বোমার আঘাতে, নয়তো অনাহারে মারা যাবেন।
জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ মানবিক কর্মকর্তা রমেশ রাজাসিংহাম ১০ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, ‘এটি আর ভবিষ্যতের দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি নয়, এটি সরাসরি অনাহারে মানুষ মেরে ফেলা।’ দুর্ভিক্ষবিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ডি ওয়াল জানান, গাজার হাজারো শিশু এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তারা খাবার পেলেও খেতে পারবে না। তাঁর ভাষায়, তাদের শরীর এখন আর খাবার হজম করতে সক্ষম নয়।
ইতিমধ্যে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে যে গাজায় ইসরায়েল গুরুতর অপরাধ করছে। তারা যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহারকে ব্যবহার করছে। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছিল। এরপর বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশের দেশ থেকেই এ বিষয়ে সতর্কবার্তা এসেছে। এমনকি ইসরায়েলের ভেতর থেকেও অনেকে স্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুনতারা তোমার অশ্রুর যোগ্য ছিল না, আনাস!১২ আগস্ট ২০২৫সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেছেন, গাজায় যা ঘটছে, তা যুদ্ধাপরাধ। আর শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি গণহত্যার সমান।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত এবং ২০০ জনের বেশি জিম্মি হওয়ার দুই দিন পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ঘোষণা দেন, ‘আমি গাজা উপত্যকায় পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। সেখানে কোনো বিদ্যুৎ থাকবে না, খাবার থাকবে না, জ্বালানি থাকবে না। সেখানে সবকিছু বন্ধ থাকবে। আমরা মানবপশুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করব।’
এ ঘোষণায় পুরো গাজার মানুষকে অমানবিকভাবে চিত্রিত করা হয়। সেখানে আর বেসামরিক ও যোদ্ধাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি। এটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মৌলিক নীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। সেই অবরোধ টানা ৭০ দিন চলেছিল এবং সব সরবরাহ বন্ধ ছিল। এটি ছিল সরাসরি সমষ্টিগত শাস্তি।
ইতিহাস এ মুহূর্তকে চিরকাল বৈশ্বিক লজ্জা হিসেবে মনে রাখবে। কঙ্কালসার শিশুদের ছবি যোগ হবে অতীতের সেই ছবিগুলোর পাশে, যখন পৃথিবী তাদের জন্য কিছু করেনি। আশা একটাই, পৃথিবী যেন এখনই জেগে ওঠে, মানবতার শেষ আলোটা অন্তত বাঁচিয়ে রাখে। তার আগে যদি কিছু করা না যায়, তবে আরও অসহায় শিশু ক্ষুধার্ত চোখ মেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।২০২৪ সালের শুরুর দিকে ইসরায়েল সামান্য কিছু সরবরাহ গাজায় ঢুকতে দেয়। কিন্তু সেই এপ্রিলেই ইউএসএইডের প্রধান সামান্থা পাওয়ার সতর্ক করেন, গাজার কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। এর পরের মাসে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন ঘোষণা দেন, উত্তর গাজায় পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ চলছে।
আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টভাবে বলেছে, যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহার ব্যবহার নিষিদ্ধ। দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের বাধ্যবাধকতা হলো বেসামরিকদের যথেষ্ট খাবার, পানি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিশ্চিত করা। যদি গাজার ভেতরে এগুলো জোগাড় না হয়, তবে বাইরে থেকে, এমনকি ইসরায়েল থেকেই সরবরাহ করতে হবে।
আরও পড়ুনমুখ ফিরিয়েছে বিশ্ব, গাজা কি নিভে আসছে ০৯ জুন ২০২৫কিন্তু ২১ মাস ধরে অনেক দেশ ও সংস্থা সাহায্য পৌঁছাতে চাইলে ইসরায়েল বাধা দিয়েছে। এ অনুমতি দেওয়া শুধু নৈতিক নয়, আইনি দায়িত্বও। ইসরায়েলের কর্তব্য ছিল অন্যদের ত্রাণ কার্যক্রম সহজ করা। কিন্তু তারা বারবার তাতে বাধা দিয়েছে। এখনো মানবিক সংস্থাগুলোকে সাহায্য পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না।
স্পষ্টতই ফিলিস্তিনিদের ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে মারা হচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই এর লক্ষণ স্পষ্ট ছিল, কিন্তু অনেক সরকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা বলেছে, সাহায্য নাকি হামাস পাচ্ছে। যার কোনো প্রমাণ ইসরায়েলের কাছেই নেই। বরং এসব সরকার গাজায় সাহায্য পাঠানোর তুলনায় ইসরায়েলকে বেশি অস্ত্র দিয়েছে। এখন তারা গণহত্যা ঠেকানো ও থামানোর দায়িত্বে ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
ইতিহাস এ মুহূর্তকে চিরকাল বৈশ্বিক লজ্জা হিসেবে মনে রাখবে। কঙ্কালসার শিশুদের ছবি যোগ হবে অতীতের সেই ছবিগুলোর পাশে, যখন পৃথিবী তাদের জন্য কিছু করেনি। আশা একটাই, পৃথিবী যেন এখনই জেগে ওঠে, মানবতার শেষ আলোটা অন্তত বাঁচিয়ে রাখে। তার আগে যদি কিছু করা না যায়, তবে আরও অসহায় শিশু ক্ষুধার্ত চোখ মেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
● বিনাইফার নওরোজি ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনসের সভাপতি
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র অন হ র ম নব ক
এছাড়াও পড়ুন:
থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরে সর্বনিম্ন, বিশ্ববাজারে এ বছর কমেছে ১৪%
এশিয়াসহ বিশ্বের চালের বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এশিয়ায় চালের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মূলত বাজারে চালের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
থাইল্যান্ডসহ চালের অন্যান্য বড় উৎপাদনকারী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারেও চালের দাম কমছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার খাদ্যসূচক অনুযায়ী, চলতি বছর চালের দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এমনকি বিশ্ববাজার চালের দাম আগস্ট মাসে আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। খবর দ্য নেশনের
থাইল্যান্ডে চালের দামের এই নিম্নমুখী প্রবণতা একদম নতুন কিছু নয়, বেশ কয়েক মাস ধরেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষিবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে চালের দাম কম থাকায় দেশটির কৃষকেরা ধানের আবাদ কমিয়ে দিতে পারেন।
থাইল্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার ৫ শতাংশ খুদযুক্ত চালের দাম দাঁড়ায় টনপ্রতি ৩৩৫ ডলার। আগের সপ্তাহে যা ছিল ৩৩৮ ডলার। থাইল্যান্ডের কৃষি খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১৪ বছরে থাই সরকারের জনতুষ্টিমূলক নীতির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কৃষকদের সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে প্রায় ৪০ বিালিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হলেও একধরনের নীতিগত ফাঁদ তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষকেরা প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষতা বাড়ানো কিংবা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো থেকে নিরুৎসাহিত হয়েছেন।
সেই সঙ্গে থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ এসেছে। এটাও দাম কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো চালের গুণগত মানের উন্নতি করেছে। আধুনিকতা এনেছে উৎপাদনব্যবস্থায়। ফলে তারা কম খরচে ভালো মানের চাল রপ্তানি করতে পারছে। কিন্তু থাইল্যান্ড এখনো ভর্তুকিনির্ভর ব্যবস্থায় আটকে আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এফএওর সূচক কমেছেপ্রতি মাসেই খাদ্যমূল্যসূচক করে থাকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চালের দাম কেমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক নেমে এসেছে ৯৮ দশমিক ৪–এ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা ছিল ১১৩ দশমিক ৬। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক ছিল ১২৫ দশমিক ৭। সেই হিসাবে এক বছরে চালের দাম কমেছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ।
চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি–নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এ ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের
অথচ ২০২৪ সালের শুরুতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। তখন ভারত একের পর এক রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করলে ২০০৮ সালের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যান্য উৎপাদক দেশেও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর পর থেকে চালের দাম কমতে শুরু করে।