ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে চাপে ফেলেছে মিত্রদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া
Published: 25th, September 2025 GMT
গাজা যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বজুড়ে ওয়াশিংটনের প্রতি বাড়তে থাকা ক্ষোভ খোলাখুলি প্রকাশ পেল এ সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে বড় ধরনের চাপে ফেলল।
দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ দ্রুত বন্ধের উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু এখন ফিলিস্তিনের আবদ্ধ ভূখণ্ডে ইসরায়েলি সেনারা আক্রমণ বাড়াচ্ছে, অথচ তিনি আঞ্চলিক ঘনিষ্ঠতম মিত্রকে রাশ টানতে বলতে চাইছেন না। তাঁকে ক্রমেই একজন নিছক দর্শক বলে মনে হচ্ছে।
এ মাসেই কাতারে হামাস নেতাদের ওপর হানা দিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে চমকে দিয়েছিলেন। হামলাটির কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির সর্বশেষ উদ্যোগটি প্রায় ভেস্তে যায়।
এরপর ইসরায়েল গাজা নগরীতে স্থল অভিযান শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র নির্বিবাদে তা মেনে নেয়, যদিও বিশ্ব গাজায় মানবিক সংকটকে ধিক্কার দিচ্ছে।
আর চলতি সপ্তাহে নাটকীয় কূটনৈতিক মোড় ঘুরে জাতিসংঘের অধিবেশনের আগে এবং চলাকালে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের এক দল মিত্র ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ট্রাম্প অবশ্য এই বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে এই স্বীকৃতি আদতে হামাসের জন্য একটি উপহার।
ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো ব্রায়ান কাটুলিস বলেন, ‘ট্রাম্প অঞ্চলটিতে (মধ্যপ্রাচ্যে) কোনো বড় অগ্রগতি বা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি, বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ক্ষেত্রে। পরিস্থিতি ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার সময়ের তুলনায় এখন আরও খারাপ হয়েছে।’
ট্রাম্প অঞ্চলটিতে (মধ্যপ্রাচ্যে) কোনো বড় অগ্রগতি বা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি, বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ক্ষেত্রে। পরিস্থিতি ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার সময়ের তুলনায় এখন আরও খারাপ হয়েছে।ব্রায়ান কাটুলিস, জ্যেষ্ঠ ফেলো, ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটপ্রায় দুই বছর ধরে চলা এই সংঘাত বন্ধ হওয়া এখন অনেক দূরের কথা। আপাতদৃষ্টে ট্রাম্প গৌণ হয়ে গেছেন। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে তাঁর উচ্চারিত একটি দাবি আরও বেশি সন্দেহের মুখে পড়েছে। ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন, তাঁর মতো দক্ষ মধ্যস্থতাকারী শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের দাবি রাখে।
গতকাল মঙ্গলবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, ট্রাম্প যদি সত্যিই নোবেল শান্তি পুরস্কার জিততে চান, তবে তাঁকে গাজার যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। নিউইয়র্ক থেকে ফ্রান্সের বিএফএম টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাখোঁ বলেন, ‘ইসরায়েলকে যুদ্ধ শেষ করার জন্য চাপ দেওয়ার ক্ষমতা শুধু ট্রাম্পেরই আছে। তিনি এ কাজটা আমাদের চেয়ে ভালো পারবেন। কারণ, গাজায় যুদ্ধ টিকিয়ে রাখার অস্ত্র আমরা জোগাই না।’
কিছু বিশ্লেষকের মতে, নেতানিয়াহুকে চাপ দিতে ট্রাম্পের অনীহা আছে। কারণ, তিনি বোঝেন যে এ যুদ্ধ অনেক বেশি জটিল ও কঠিন।
আরেক দল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ অনীহা আসলে পরোক্ষে মেনে নেওয়া যে নেতানিয়াহু নিজের ও ইসরায়েলের স্বার্থের বিবেচনা থেকেই কাজ করবেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট সেটা বদলাতে তেমন কিছু করতে পারবেন না।
এমন জল্পনাও আছে যে অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের দিকে সেভাবে মন দিচ্ছেন না। রয়টার্স হোয়াইট হাউসের কাছে মন্তব্য চেয়েছিল। তাৎক্ষণিক সাড়া মেলেনি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি
কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।
করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।
বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।
অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।
আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।
বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।
ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।
কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।
যা করা যেতে পারে:
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।
সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়