৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পরও বিতাড়িত হলেন ৭৩ বছর বয়সী ভারতীয় নারী
Published: 27th, September 2025 GMT
হারজিত কর (৭৩) তাঁর জীবনের ৩০ বছরের বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। হঠাৎ সেখান থেকে তাঁকে বিতাড়িত করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) কর্মকর্তারা ৮ সেপ্টেম্বর হারজিতকে আটক করেন। এ ঘটনায় শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
পাঞ্জাবের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বাঁচতে ১৯৯১ সালে ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাড়ি জমান হারজিত কর। এত দিন ধরে সেখানেই বসবাস ও কাজ করছিলেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকবার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।
আরও পড়ুনভারতের এত লোক কেন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পথে ঢুকছে১২ ডিসেম্বর ২০২৪হারজিত করের আইনজীবী দীপক আহলুয়ালিয়া অভিযোগ করেছেন, কোনো ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার ইতিহাস নেই হারজিতের। এরপরও আটক করার সময় আইসিই কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, তা অগ্রহণযোগ্য।
ওই আইনজীবী আরও বলেন, হারজিতকে ১৯ সেপ্টেম্বর জর্জিয়ার একটি আটককেন্দ্রে রাখা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর তাঁকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাড়িতে যেতে কিংবা পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে ভালোমতো বিদায় নিতে পারেননি।
সান ফ্রান্সিসকো বে এলাকার হারকিউলিসে বসবাস করতেন হারজিত। দুই দশক ধরে শাড়ির দোকানে সেলাইয়ের কাজ করতেন তিনি। পাশাপাশি নিয়মিত কর পরিশোধ করেছেন। আশ্রয়প্রার্থীরা তাঁদের আবেদনের প্রক্রিয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাস ও কাজ করতে পারেন।আহলুয়ালিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে এক ভিডিওতে হারজিতের সঙ্গে হওয়া আচরণকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, হারজিতকে কোনো বিছানা ছাড়াই ৬০ থেকে ৭০ ঘণ্টা আটক রাখা হয়। তিনি মেঝেতে ঘুমাতে বাধ্য হন। ওষুধ খাওয়ার জন্য তাঁকে বরফ দেওয়া হয়েছিল। তিনি যে খাবার খেতে পারতেন, তা দেওয়া হয়নি। এমনকি প্রহরীরা তাঁকে স্যান্ডউইচ খেতে পারেন না বলেও দোষারোপ করেছেন।
সান ফ্রান্সিসকো বে এলাকার হারকিউলিসে বসবাস করতেন হারজিত। দুই দশক ধরে শাড়ির দোকানে সেলাইয়ের কাজ করতেন তিনি। পাশাপাশি নিয়মিত কর পরিশোধ করেছেন। আশ্রয়প্রার্থীরা তাঁদের আবেদনের প্রক্রিয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাস ও কাজ করতে পারেন।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্র ফেরত পাঠালে অবৈধ অভিবাসী গ্রহণে ভারত সহযোগিতা করবে২২ জানুয়ারি ২০২৫এর আগে বিবিসিকে আইস বলেছে, প্রায় দশক ধরে সব আইনিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন হারজিত। ২০০৫ সালে এক অভিবাসন বিচারক তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়নের আদেশ দেন।
হারজিতকে আটকের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁরা বিক্ষোভ করেছেন।
ঠিক এমন এক সময় হারজিত করকে আটক করা হয়, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কঠোর অভিবাসন নীতি অনুসরণ করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
প্রতিবছর লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে পৌঁছান। বর্তমানে আশ্রয়সংক্রান্ত ৩৭ লাখের বেশি মামলা অভিবাসন আদালতে চলমান।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি সবচেয়ে খারাপ মানুষদের নির্বাসিত করতে চান। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, যাঁদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ইতিহাস নেই ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন, এমন অভিবাসীরাও ট্রাম্পের এই নীতির নিশানা হচ্ছেন।
আরও পড়ুনকর্মী ভিসায় ট্রাম্পের ফি আরোপে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোন দেশ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য় য ক তর ষ ট র স প ট ম বর প রক র য় ক জ করত কর ছ ন করত ন বসব স
এছাড়াও পড়ুন:
নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি
কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।
করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।
বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।
অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।
আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।
বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।
ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।
কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।
কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।
যা করা যেতে পারে:
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।
সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়