সাগর চ্যানেল পার হয়ে জেটি ঘাটে পা রাখতেই চোখে পড়ে লোকজনের জটলা। ছোট্ট দোকানের সামনে সাজানো রকমারি মসলার পান। কেউ মুঠোফোনে ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও। আবার কেউ মসলাদার পানের খিলি মুখে দিচ্ছেন। অনেকে আবার পানের মধ্যে আগুন লাগিয়ে চিবাচ্ছেন। উপস্থিত লোকজন হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন তাঁদের।

গত সোমবার কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ মহেশখালীর গোরকঘাটা জেটিঘাটে দেখা যায় এমন চিত্র। অবশ্য বছরজুড়েই এমন উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা মিলে জেটিঘাটটিতে। কক্সবাজার শহরের ৬ নম্বর জেটিঘাট দিয়ে স্পিডবোট গোরকঘাটা জেটিঘাটে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ ঘাটে চলে হরেক রকম মিষ্টি পান ও ‘আগুন’ পানের বেচাবিক্রি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় ১৫ বছর ধরে দ্বীপটির ঘাটে চলছে মসলাদার পানের এ ব্যবসা। শুরুতে এখানে ছোট্ট এক দোকান থাকলেও পর্যটকের আগ্রহের কারণে এখন দোকান তিনটি। প্রতিটিতেই পর্যটক মৌসুমে ভিড় লেগে থাকে। মূলত, দ্বীপটির খ্যাতি পাওয়া মিষ্টি পান ও হরেক মসলার জন্যই পর্যটকেরা ঘাটে এসে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন।

যেভাবে শুরু

জেটিতে টানা ১৫ বছর ধরে পান বিক্রি করছেন মোহাম্মদ সেলিম (৪০)। মিষ্টির পানের সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ পদের সুগন্ধি মসলা মিশিয়ে ঘাটটিতে তিনিই প্রথম পান বিক্রি শুরু করেন। এরপর ইউটিউব দেখে ‘আগুন’ পান বানানো শিখে নেন। সেই থেকে মহেশখালীতে তিনি আগুন পানের জন্য পরিচিতি পান। এরপর তাঁর দেখাদেখি আরও দুই দোকানিও পান বিক্রি শুরু করেছেন।

সোমবার ঘাটে কথা হয় মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি মহেশখালী পৌরসভার সিকদারপাড়াতে। তিন বছর বয়সেই বাবা হারান তিনি। এরপর সাত বছর বয়স থেকে বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেন। এরপর কখনো শ্রমিকের কাজ, আবার কখনো রিকশা চালিয়েছেন তিনি। প্রায় ১৫ বছর আগে ইউটিউবে ভিডিও দেখে পান বিক্রির আগ্রহ হয় তাঁর। সেই থেকেই তিনি ঘাটে পান বিক্রি করছেন।

মোহাম্মদ সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, মহেশখালীর মিষ্টি পান বিশ্বখ্যাত। বিভিন্ন গান, নাটক, সিনেমা ও লেখাতে মহেশখালীর মিষ্টি পানের কথা ওঠে আসে । বিষয়টা মাথায় রেখে ‘খিলি পান’ বিক্রি শুরু করেন তিনি। স্বাদ ও গুরুত্ব বাড়াতে খিলি পানে যুক্ত করেন রকমারি মসলা। এরপর ভিডিও দেখে শিখে নেন ‘আগুন’ পান।

যা আছে ‘আগুন’ পানে

পানের সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ রকমের মসলা দিয়ে তৈরি হচ্ছে এখানকার ‘আগুন’ পান হয়। নারকেল গুঁড়া, সুপারি গুঁড়া, খেজুর, কিশমিশ, মোরব্বা, নকুল দানা, কালিজিরা, পান পরাগ, এলাচ, সেমাই, চেমনবাহারসহ বাহারি সব পদই থাকে এতে। এরপর বিশেষ এক স্প্রে ব্যবহার করে এতে আগুন ধরানো হয়। গ্লিসারিন, পটাশিয়াম ও পানির মিশ্রণে ওই স্প্রে তৈরি করা হয়।

মূলত পানের মধ্যে আগুন জ্বলতে দেখা, এরপর পুরোটা মুখে দেওয়ার এই দৃশ্য দেখতে পর্যটকেরা হাজির হন এ ঘাটে। দোকানগুলোতে প্রতিটি আগুন পান বিক্রি হয় ৩০ টাকা দরে। তবে পর্যটকের মৌসুম কমে গেলে তা ২০ টাকায় বিক্রি হয়। এর বাইরে খিলি পানও বিক্রি হয় দোকানগুলোতে। এসবের কদর কম নয়।

দ্বীপটিতে ঘুরতে আসা সীতাকুণ্ডের ব্যবসায়ী সাধন বিকাশ প্রথম আলোকে বলেন, মহেশখালীর মিষ্টি পানের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। এখানে এসে মিষ্টি স্বাদের এক খিলি পান না খেলে ভ্রমণই বৃথা। তাই তিনি স্পিডবোটে ওঠার আগে দুটি মিষ্টি পান কিনেছেন।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা রাজীব দাশ (৫২) বলেন, ‘আগুন পান ভিডিওতে অনেকবার দেখেছি। খাওয়ারও ইচ্ছা ছিল অনেক। তবে একধরনের আতঙ্ক থেকে খেতাম না। খাওয়ার পর অন্য রকম স্বাদ পেলাম।’

মহেশখালীর পানের খ্যাতি

‘যদি সুন্দর একটা মন পাইতাম; মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম।’ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রানি খ্যাত শেফালী ঘোষের কণ্ঠের এ গান এখনো ঘরে ঘরে শোনা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে গানটি এখন আরও ‘ভাইরাল’। উৎসব-পার্বণে সব জায়গায় মহেশখালীর পানের কদর রয়েছে।

উপজেলার পান দোকানিরা জানান, মিষ্টি পান শুধু দ্বীপটিতে চাষ হয়। এ কারণে এর নামডাকও বেশি। বাজারগুলোতে আকারভেদে বিভিন্ন নামে এ পান বিক্রি হয়। এর কোনোটির নাম ‘হানিমুন পান’, ‘জামাই-বউ পান’, আবার কোনোটির নাম ‘ভালোবাসার পান’, ‘শাহী পান’ ইত্যাদি।

জানতে চাইলে মহেশখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.

আবদুল গাফফার বলেন, মহেশখালীতে বর্তমানে দেড় হাজার হেক্টর জমিতে মিষ্টি পানের চাষ হচ্ছে। প্রতি হেক্টরে পান উৎপাদিত হয় ১৮ থেকে ২০ মেট্রিক টন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই পান সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দুবাই, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দ্বীপের লবণাক্ত আবহাওয়া ও মাটি পান চাষের জন্য উপযোগী।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর যটক র আগ ন প ন

এছাড়াও পড়ুন:

৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম

গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।

এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।

আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’

দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’

ব্যবসার শুরু

রহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।

রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।

হকার থেকে এজেন্ট

কয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।

আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’

পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাস ধুয়েমুছে চালকের সহকারী ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন, ফিরে দেখেন আগুন জ্বলছে
  • ‘বাসটির সঙ্গে একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে, এরপর আর কিছু মনে নেই’
  • রেলের ৭ লাখ টাকার যন্ত্র ২৭ হাজারে বানালেন তিনি
  • রাতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে সাভার-ধামরাইয়ে দুই বাসে আগুন
  • জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণাই তাঁর নেশা 
  • ইডেনে স্পিন বিষ, ১৫ উইকেটের দিনে উড়ছে ভারত
  • বিচারকের ছেলে হত্যা মামলার আসামি লিমন পাঁচ দিনের রিমান্ডে
  • বিচারকের ছেলে হত্যা: লিমন ৫ দিনের রিমান্ডে
  • ‘তোকে গুলি করে মারব না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব’
  • ৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম