বিজয়া দশমীতে আজ শেষ হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব
Published: 2nd, October 2025 GMT
মহা ধুমধামে অঞ্জলি, আরতি, পূজা–অর্চনায় শারদীয় দুর্গোৎসবের বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার শেষ হচ্ছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আজ সকালে শুরু হবে দেবীর দশমী বিহিত পূজা। এরপর দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী উৎসবের সমাপ্তি হবে। গত রোববার দেবীর পূজা শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ প্রথম আলোকে জানালেন, রাজধানীতে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে দশমীর পূজা শুরু হবে ৯টা ৫৭ মিনিটে। দর্পণ বিসর্জনের পরে ১২টায় শুরু হবে স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচি। প্রতিবছরই বিজয়ার দিনে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে স্বেচ্ছা রক্তদানের আয়োজন থাকে।
বিজয়ার শোভাযাত্রা শুরু হবে বেলা তিনটা থেকে। এর আগে মহানগরীর অনেক স্থানের মণ্ডপ থেকে প্রতিমা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আনা হবে। বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন ঘাটে (ওয়াইজঘাট) নিরঞ্জন হবে সন্ধ্যা নাগাদ। এবার দেবীর আগমন ছিল গজে, আর দোলায় গমন।
সিঁদুরখেলাআজ বিজয়া দশমীতে অনেক মন্দিরেই দশমী বিহিত পূজা ও দর্পণ বিসর্জনের পরে সিঁদুরখেলার আয়োজন থাকবে। সাধারণত এ আয়োজনে বিবাহিত নারীরা দেবীর চরণে সিঁদুর দান করে তা কৌটায় ধারণ করেন সারা বছর ব্যবহারের জন্য। এ সময় তাঁরা একে অন্যের কপাল ও চিবুকে দেবীর চরণ স্পর্শ করা সিঁদুর লাগিয়ে দেন। সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, বনানী মণ্ডপ, ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মণ্ডপে সিঁদুরখেলার আয়োজন থাকবে বলে এসব মণ্ডপের পূজা আয়োজকেরা জানিয়েছেন।
ঢাকের বাদ্যতে মুখর মণ্ডপগতকাল বুধবার শারদীয় দুর্গাপূজার মহানবমীতে ঢাকঢোলের বাদ্যতে মুখর হয়ে উঠেছিল রাজধানীর পূজামণ্ডপগুলো; ছিল আলোর রোশনাই, অঞ্জলি। নবমীতেই দেবী দুর্গা তীব্র লড়াইয়ের মাধ্যমে অসুর বিনাশ করেন। মহিষাসুর বধের এই বিজয় দিবসটি তাই দেবীভক্তদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেবী এই দিনে ভক্তদের মনোবাসনা পূরণ করেন। নবমীর প্রধান ধর্মীয় আচার হলো অসুরবিনাশী দেবীকে অঞ্জলি নিবেদন। রাজধানীর বিভিন্ন মণ্ডপে ভক্তরা ফুল হাতে দেবীপদে এই অঞ্জলি নিবেদন করেন।
বনানী পূজামণ্ডপে সকাল থেকেই ছিল ভক্তদের বিপুল সমাগম। বনানী পূজা উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক চন্দন লোধ প্রথম আলোকে বললেন, সকাল নয়টা থেকে নবমী বিহিত যজ্ঞ ও পূজা শুরু হয়েছিল। অঞ্জলি প্রদান শুরু হয় দুপুর সোয়া ১২টা থেকে। এ সময় ভক্তরা করজোড়ে পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্রপাঠ করে দেবীকে প্রণাম করেন। অঞ্জলি নিবেদন শেষে তাঁরা চরণামৃত ও যজ্ঞের ফোঁটা সংগ্রহ করেন।
মানিকগঞ্জের বেতিলা থেকে যাদব চন্দ্র ঘোষ, স্ত্রী অর্চনা রানি ঘোষকে নিয়ে বনানী মণ্ডপে এসেছিলেন অঞ্জলি দিতে। তাঁরা প্রথম আলোকে বললেন, বনানীর পূজার আয়োজন অনেক বড়। জাঁকজমক, সাজসজ্জাও বর্ণাঢ্য। তাঁদের গ্রামেও পূজা হচ্ছে। তবে গ্রামের পূজার সঙ্গে বনানীর আয়োজনের তুলনা চলে না। প্রতিবছরই তাঁরা নবমীতে এখানে অঞ্জলি দিতে আসেন।
অঞ্জলি দিয়ে দেবী প্রণাম জানালেন অসীম গুহ ও রুপা গুহ দম্পতি। তাঁরা থাকেন গুলশানে। অসীম গুহ জানালেন, এরই মধ্যে তাঁরা ঢাকার অধিকাংশ মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন করেছেন। উত্তরার দিয়াবাড়ির মণ্ডপের সাজসজ্জা তাঁর কাছে বেশ ব্যতিক্রম লেগেছে। তবে পরিসর আর বর্ণাঢ্যতার দিক থেকে বনানীর মণ্ডপকেই এগিয়ে রাখবেন। এখনে ভক্তদের বসার জন্য অনেক বড় জায়গা ও অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। নিরাপত্তাও খুব ভালো। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আর্থিক মন্দাভাব রয়েছে। এ কারণে হাত খুলে খরচ করে উৎসব নিয়ে আনন্দ–উচ্ছ্বাস করায় কিছুটা ঘাটতি আছে বলে তাঁর মনে হয়েছে।
এবার বনানী পূজামণ্ডপের সাজসজ্জায় সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানালেন কমিটির আহ্বায়ক চন্দন দত্ত ও গুলশান সর্বজনীন পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাঞ্চন কুমার দত্ত। দেবী প্রতিমায় কোনো কৃত্রিম বস্ত্র বা অলংকার ব্যবহার করা হয়নি। সম্পূর্ণই মাটির তৈরি। প্রতিমায় প্রধানত সাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হালকা গোলাপি আভা। অস্ত্র আর অলংকার উজ্জ্বল রুপালি রঙের। ফলে সাদা ও রুপালি মিলিয়ে প্রতিমায় বিশেষ স্নিগ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে। এ ছাড়া ফটক ও ভেতরের সাজসজ্জায় পাটি, পাটকাঠি, বাঁশ, বেত—এমন উপকরণ ব্যবহার করে লোকজ ঐতিহ্যবাহী নকশায় অলংকরণ করা হয়েছে। তাঁরা জানালেন, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত মণ্ডপ খেলা থাকে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো ভক্ত বনানী মণ্ডপে দেবীদর্শনে এসেছেন।
আয়োজকেরা জানালেন, ষষ্ঠীপূজার দিন থেকেই বনানী মণ্ডপে প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার জনের জন্য প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
নবমীর বিকেলে পাঁচটা থেকে শুরু হয় পূজা ও শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ। সন্ধ্যার পর ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আরতি দেওয়া হয়েছে রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত।
আয়োজকেরা জানালেন, বনানী, গুলশান, উত্তরা এলাকার প্রায় ৩০টি প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে আশুলিয়ায়। সকালে দশমীর পূজা শেষে বিজয়ার যাত্রা শুরু হবে বেলা তিনটার পর থেকে।
মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে দেবীদর্শনফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মাঠে ৩৪ বছর ধরে শারদীয় দুর্গাপূজা হচ্ছে সনাতন সমাজকল্যাণ সংঘের আয়োজনে। এখানেও নবমী পূজায় অনেক ভক্তের সমাগম হয়েছিল। সংঘের সভাপতি মনোতোষ কুমার রায় প্রথম আলোকে বললেন, প্রায় ১০ হাজার ভক্ত নবমীর সকালে দেবীকে অঞ্জলি দিয়েছেন। এখানেও প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ হাজার জনকে প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছে। পার্থ ভৌমিক স্ত্রী সুবর্ণা ভৌমিক ও দুই মেয়ে প্রকৃতি ভৌমিক ও স্পৃহা ভৌমিককে নিয়ে এখানে দেবীকে নবমীর অঞ্জলি দিয়েছেন। তাঁরা থাকেন মণিপুরি পাড়ায়। সারা দিন তাঁরা বিভিন্ন মণ্ডপে ঘুরে দেবীদর্শন করবেন বলে জানালেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ব যবহ র কর স জসজ জ মন দ র র জন র নবম র
এছাড়াও পড়ুন:
রবীন্দ্রসরোবরে সুরে–ছন্দে জমজমাট নবান্ন উৎসব
অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে নবান্ন উৎসব হলো রাজধানীতে। নাচ, গান, আবৃত্তি, আলোচনায় রোববার ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে উদ্যাপন করা হলো ঋতুভিত্তিক এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব।
হেমন্তের বেলা শেষে ষড়ঋতু উদ্যাপন জাতীয় পর্ষদ আয়োজিত নবান্ন উৎসবের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এরপর ছিল ফারহানা করিমের নেতৃত্বে সমবেত নৃত্য।
নবান্নকথনে অংশ নেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি এহসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আবহমানকাল থেকে আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে অগ্রহায়ণে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠে। নতুন ধান তাঁদের জীবনে নিয়ে আসে সচ্ছলতা। নিয়ে আসে আনন্দ। তবে নবান্ন কেবল ফসলের আনন্দই নয়, আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি শক্তিশালী উপাদান। নাগরিক পরিবেশে ঋতুভিত্তিক এই উৎসবকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বসন্ত, বর্ষা, শরৎসহ ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো আয়োজন করা হবে।’
নবান্ন উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ ও মঞ্চের চারপাশের স্থান বর্ণাঢ্যভাবে সাজিয়ে তোলা হয়। এর সঙ্গে ছিল ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলির স্টল।
আলোচনার পরে শুরু হয় গানের পালা। সাগর বাউল শুরু করেছিলেন ভবা পাগলার গান ‘বারে বারে আসা হবে না’ গেয়ে। এরপর তিনি পরিবেশন করেন লালন সাঁইয়ের গান ‘লোকে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে’ এবং রাধারমণ দত্তের গান ‘অবলারে কান্দাইয়া’। ঢোল, একতারার বাজনা, বাঁশির সুর আর লোকসাধকদের এসব মরমি গানে গানে সাগর বাউল শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন।
অনুষ্ঠানে নজরুলসংগীত পরিবেশনের কথা ছিল শিল্পী ফেরদৌস আরার। তবে তিনি অসুস্থতার জন্য সংগীত পরিবেশন করতে পারেননি। এই চমৎকার অনুষ্ঠানের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ ও শ্রোতাদের শুভেচ্ছা জানান।
লোকশিল্পী আলেয়া বেগম পরিবেশন করেন ‘মালা কার লাগিয়া গাঁথি’সহ বেশ কয়েকটি গান। গানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল আবৃত্তি ও কবিদের কবিতা পাঠ। এই পর্বে অংশ নেন কবি রাসেল রায়হান, রিক্তা রিনি, সানাউল্লাহ সাগর, জব্বার আল নাইম, ইসমত শিল্পীসহ অনেকে।
সংগীতশিল্পীদের মধ্যে কোহিনূর আক্তার পরিবেশন করেন লালন সাঁইয়ের গান ‘তিন পাগলের হইল মেলা’। ডলি মণ্ডল পরিবেশন করেন ‘সব লোক কয় লালন কী জাত সংসারে’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ষড়ঋতু উদ্যাপন জাতীয় পর্ষদের সদস্যসচিব দীপান্ত রায়হান।
শীতের মৃদু পরশ লেগেছে রাজধানীর হাওয়ায়। হালকা কুয়াশাও জমছে আকাশে। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে সুরে-ছন্দে বেশ খানিকটা রাত অবধি জমজমাট হয়ে উঠেছিল এই নাগরিক নবান্ন উৎসব।