জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের এনএসসি সিস্টেম জালিয়াতি করে অর্থ তুলে নিয়েছে একটি চক্র। অন্যের সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির আগেই ভাঙিয়ে ওই চক্র নিজ ব্যাংক হিসাবে টাকা স্থানান্তর করেছে। সব মিলিয়ে ২৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। এভাবে আরও প্রায় ৫০ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে তা আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় থেকে কেনা সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে এই জালিয়াতি ধরা পড়েছে। মতিঝিল কার্যালয়ের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই এই সঞ্চয়পত্র জালিয়াতি হয় বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী আজ বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, যাঁদের হিসাবে অর্থ গেছে এবং যাঁরা জালিয়াতিতে জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করে মামলা করা হবে। সঞ্চয়পত্রের সিস্টেম যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের কারও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এই জালিয়াতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ নিয়ে মতিঝিল থানায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কীভাবে এই জালিয়াতি

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো গ্রাহক সঞ্চয়পত্র কেনার সময় যে ব্যাংক হিসাবের তথ্য দেবেন, সেই হিসাবেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ও আসল টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া যে অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা হয়, কোনো তথ্য পরিবর্তন, সুদ বা আসল নেওয়ার জন্য অবশ্যই সেই অফিসে আবেদন করতে হয়। আবেদন পাওয়ার পর গ্রাহকের দেওয়া মোবাইল নম্বরে একটি ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) যায়। উপস্থিত গ্রাহক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মীকে তৎক্ষণাৎ সেই ওটিপি দেখানোর পর তা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে তথ্য পরিবর্তন করা হয়। তবে সব ক্ষেত্রে সার্ভারে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা প্রমাণ থাকে।

তবে দেড় বছর ধরে অনেক ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন গ্রাহকেরা। এসব ব্যাংকে প্রবাসী আয় বা সঞ্চয়পত্রের টাকা এলেও গ্রাহকেরা উত্তোলন করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক পরিবর্তনের আবেদন করছেন অনেকে। গ্রাহকের সমস্যা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে ব্যাংক পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই কেউ জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

যা ঘটেছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় থেকে গত বৃহস্পতিবার ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন এক ব্যক্তি। তাঁর ব্যাংক হিসাবটি আছে অগ্রণী ব্যাংকের জাতীয় প্রেসক্লাব শাখায়। চার দিনের মাথায় গত সোমবার এই সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হয় এবং টাকা নেওয়া হয় এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুর উপশাখার অন্য এক ব্যক্তির হিসাবে। ওই টাকা জমা হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির রাজধানীর শ্যামলী শাখা থেকে তুলে নেওয়া হয়।

একই প্রক্রিয়ায় একই দিনে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে ৩০ লাখ ও এনআরবি ব্যাংকের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে তা আটকে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি ঘটনায় সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে। গ্রাহকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর জন্য আবেদন করেননি। ফলে তাঁদের মোবাইল ফোনে কোনো ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ডও (ওটিপি) যায়নি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তিন কর্মকর্তার কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পাসওয়ার্ড ছিল, তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নতুন করে অন্য তিনজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই এই জালিয়াতি করা হয়েছে। ফলে যাঁদের কাছে পাসওয়ার্ড ছিল, তাঁরা নজরদারিতে আছেন। এ ছাড়া বাইরের আরও কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকসহ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের তিন লাখ ৪০ হাজার ৭১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তর ও পোস্ট অফিস মিলে প্রায় ১২ হাজার শাখা থেকে এসব সঞ্চয়পত্র কেনা ও ভাঙানো হয়।

এনআরবিসি ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনার পর আমরা ডিএমডির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। সেই কমিটি কাজ শুরু করেছে। এরপরই বিস্তারিত জানা যাবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত র এই জ ল য় ত গ র হক র

এছাড়াও পড়ুন:

জরুরি প্রয়োজনে খরচ, কী প্রস্তুতি থাকা দরকার

জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সময় মানুষের টাকার প্রয়োজন হতে পারে। এ নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। এটাই নির্জলা বাস্তবতা। কিন্তু সমস্যা হলো দেশের অনেক মানুষ এই জরুরি পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে কোনো সঞ্চয়ের পরিকল্পনা করেন না। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো পরিকল্পনাও থাকে না। তাই হঠাৎই যখন এমন বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন মানুষ খেই হারিয়ে ফেলেন।

বিশেষ পরিস্থিতি কী? ধরা যাক, পরিবারের কোনো সদস্য হঠাৎই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন কিংবা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার জন্য ভালো পরিমাণের টাকার প্রয়োজন হয়। আবার পরিবারের কোনো সদস্য বিদেশে পড়াশোনা করতে পারেন, তখন এক ধাক্কায় অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। আবার এমন হতে পারে, আপনি ব্যবসা করতে চাচ্ছেন, তখন হঠাৎ একটা বিনিয়োগের সুযোগ চলে এল। ওই সময় হাতে টাকা থাকলে সেই বিনিয়োগটা করা যায়। এভাবেই জরুরি প্রয়োজনে টাকা খরচের বাস্তবতা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটু পরিকল্পনা করলেই হয়।

এবার দেখা যাক, কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে

১. মাসিক সঞ্চয়

মাসিক আয়ের একটি অংশ শুরুতেই সরিয়ে রাখুন। বেতন অল্প হলে এ ধরনের সঞ্চয় প্রকল্প খুব কার্যকর। ব্যাংকে ডিপিএস করতে পারেন। কিংবা কিছু টাকা জমলে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখতে পারেন।

২. আয়-ব্যয়ের হিসাব

সঞ্চয়ের অন্যতম শর্ত হলো নিজের আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখা। যেমন ব্যাংক হিসাবে কত টাকা আছে, তার সুদ কত আসছে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার। আবার কোথায় কত টাকা খরচ হচ্ছে, এর সঠিক হিসাব রাখা। সংসারের অপ্রয়োজনীয় খরচ হচ্ছে, তা নজরে রাখতে হবে।

৩. সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ

উচ্চমাধ্যমিক পাসের সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ নিয়ে অনেক পরিবার বিপাকে পড়ে যান। বহু পরিবারের সন্তান অর্থের অভাবে নিজের পছন্দমতো বিষয়ে বা পছন্দ মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন না। সেই সময়ে তার পড়াশোনার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার দরকার হতে পারে। সেই সময় খেয়াল করে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করুন, যাতে প্রয়োজনের সময়ে হাতে টাকা পাওয়া যায়। এর জন্য কার্যকর মাধ্যম হতে পারে দেশের প্রচলিত শিক্ষাবিমা। চাইলে অনেকে সঞ্চয়পত্রও করতে পারেন, যদি একসঙ্গে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করার সক্ষমতা থাকে।

৪. চিকিৎসার খরচ

হঠাৎ পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ হতে পারেন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার দরকার হয়। হঠাৎ বিপাকে পড়া এমন পরিবারের প্রধান অবলম্বন হতে পারে স্বাস্থ্যবিমা। এ ছাড়া অনেক পরিবারের সদস্যের ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এমন জরুরি খরচও বিমা থেকে করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন কয়েক বছর আগে থেকে বিমা পরিকল্পনা করা।

৫. ভরসা যখন ক্রেডিট কার্ড

বিপদের সময় ক্রেডিট কার্ডও ভরসা হয়ে ওঠে। তাই প্রয়োজন মতো ক্রেডিট কার্ড রাখুন। এ ক্ষেত্রে কোন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড নিলে সুদের অঙ্ক কম হবে, তা বুঝে নিতে হবে। অনেক সময় আচমকা টাকার দরকার হলে ক্রেডিট কার্ড কাজে লাগতে পারে। তবে সময় মতো সেই ধার শোধ করা জরুরি। একই সঙ্গে দেশের এমএফএস সেবা বিকাশও এখন অ্যাপ থেকে গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকঋণের সুদের হারেই এই সুদ নেওয়া হয়। ফলে স্বল্পকালীন ছোট খরচ মেটানোর জন্য এই ঋণ হতে পারে খুবই কার্যকর মাধ্যম। ঋণের অঙ্ক নির্ভর করে গ্রাহকের লেনদেনের অঙ্কের ওপর।

সঞ্চয়ের কার্যকর তিন ধরন

জরুরি পরিস্থিতির জন্য কার্যকর সঞ্চয় পরিকল্পনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সময়ভিত্তিক সঞ্চয়ের ভারসাম্য তৈরি করা। অর্থাৎ সব টাকা এক জায়গায় না রেখে আয় ও প্রয়োজন অনুযায়ী স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি—এই তিন ধরনের সঞ্চয়ের ব্যবস্থা রাখা।

হঠাৎ চিকিৎসা, ভ্রমণ বা অপ্রত্যাশিত খরচের জন্য নগদ ব্যবহারযোগ্য সঞ্চয় রাখুন। এটি হতে পারে ব্যাংক হিসাব, মোবাইল ওয়ালেট বা সঞ্চয়পত্র। সাধারণত তিন থেকে ছয় মাসের খরচের সমপরিমাণ অর্থ এখানে রাখা নিরাপদ।

যেসব লক্ষ্য দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পূরণ করতে চান। যেমন সন্তানের স্কুল-কলেজ ফি, বাড়ি সংস্কার ইত্যাদি। এ জন্য মধ্যমেয়াদি সঞ্চয় দরকার। এ জন্য ব্যাংকে এফডিআই বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

অবসরজীবন, সন্তানের উচ্চশিক্ষা বা বড় সম্পদ গঠনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ জরুরি। এটি হতে পারে সরকারঘোষিত পেনশন প্রকল্প, জীবনবিমা বা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়পত্র। এতে মূলধন অক্ষুণ্ন রেখে নিয়মিত আয় পাওয়া সম্ভব।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাসওয়ার্ড জালিয়াতি করে সঞ্চয়পত্রের টাকা আত্মসাৎ
  • সম্মোহন
  • জরুরি প্রয়োজনে খরচ, কী প্রস্তুতি থাকা দরকার