দুর্নীতি: শেখ হাসিনা থেকে টিউলিপ সিদ্দিক
Published: 16th, January 2025 GMT
সরদার ফজলুল করিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাহানারা ইমাম বলেছিলেন– “আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ মুজিবের কিছু পারিবারিক ব্যাপারে দুর্বলতা ছিল। নিজের ছেলে, নিজের ভাগ্নেকে তিনি কনট্রোল করতে পারতেন না।... তাঁর যে ভাই খুলনায় মারা গিয়েছিলেন, আমি শুনেছি লোকের মুখে, সেখানকার লোকেরা নাকি আনন্দে মিলাদ পড়িয়েছে। তিনি এতোই অত্যাচারী ছিলেন। এসব বলতে খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটেছে তো!.
সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন ব্রিটেনের বহুল বিতর্কিত সিটি মিনিস্টার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবিরোধী দায়িত্বে থাকা টিউলিপ সিদ্দিক। টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে। শেখ হাসিনার পতনের পর টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর বোমার মতো ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ ওঠে, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একজন আওয়ামী লীগ নেতা উপহার হিসেবে ব্রিটেনের কিংস ক্রসে একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিককে। তাঁর বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তির নামে আরও একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন আইনজীবী মঈন গণি। প্রকারান্তরে সেই ফ্ল্যাটও টিউলিপকে উপহার দেওয়া হয়েছে। কারণ, রূপন্তি ওই ফ্ল্যাট টিউলিপকে পরিবারসহ ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এর বাইরে রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা, টিউলিপ, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় প্রমুখ ৫০০ কোটি ডলার মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। তদন্ত চলছে ব্রিটেনে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুদকের দুর্নীতিবিষয়ক তদন্তে ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে পদত্যাগ করেছেন ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ৩০ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন মার্কিন ব্যাংকে স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক, সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে নতুন তদন্ত শুরু করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ ৯টি প্রকল্প থেকে এসব দুর্নীতি করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা প্রায়ই সভা-সমাবেশে বলতেন, দেশ থেকে তাদের পরিবারের নেওয়ার কিছু নেই। ঘটনা দেখা গেল উল্টো। নিজ পরিবারের সদস্যদের নামে নিয়েছেন একাধিক সরকারি প্লট। পরিকল্পিত শহর গড়তে পূর্বাচলকে বেছে নেয় রাজউক। আবেদনকারীদের মধ্যে লটারি করে প্লট বরাদ্দ দেয় সংস্থাটি। সবার জন্য একই পদ্ধতি নয়। সরকারি সিদ্ধান্তে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে প্লট বরাদ্দ দিতে আইনে একটি ধারা যোগ করা হয়। এই ধারা ব্যবহার করে নানা সময়ে বিভিন্নজনকে দেওয়া হয়েছে পূর্বাচলের প্লট। এ তালিকায় ছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের ৫ সদস্য। প্রত্যেকের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১০ কাঠার মোট ছয়টি প্লট।
বালু নদির পাড়ে পূর্বাচল প্রকল্পের ডিপ্লোম্যাটিক জোনের ২৭ নম্বর সেক্টরে ২০৩ নম্বর রোডের একটি প্লট শেখ হাসিনাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাশেই শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির প্লট। পরের প্লটটি নেন শেখ রেহানা। পরের দুটি প্লট শেখ হাসিনার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের। সবশেষ প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয় শেখ রেহানার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের নামে। বরাদ্দ দেওয়ার পরপরই প্রাচীর দিয়ে পুরো ৬০ কাঠা প্লটের চারপাশ ঘিরে ফেলা হয়। এসবের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন আনসার সদস্যরা। সরকার পতনের পর নিরাপত্তা উঠে গেলে উত্তেজিত জনতা প্রাচীরের মূল ফটক ভেঙে ফেলে।
এখন অবশ্য কেবল সীমানা প্রাচীরের ফটকের মধ্যেই শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি আটকে নেই। এমনকি শেখ হাসিনার কর্মচারীরাও শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি নিজেই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন– ‘আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক (সমকাল, ১৪ জুলাই ২০২৪)।’ এই সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেছিলেন– ঘরের কর্মচারীর ৪০০ কোটি টাকা হলে মালিকের কত আছে?
ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মিশেলে আওয়ামী লীগ যে ভিত্তি তৈরি করেছিল, ৫ আগস্টের (২০২৪) সূর্য মধ্যগগন স্পর্শ করার আগেই তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কথায় কথায় পরিবারতন্ত্র নিয়ে চটকদারি আলোচনা যারা করেন, তারা কি অনুগ্রহ করে শেখ হাসিনা পরিবারের ৭০ বছরের দুর্নীতির ধারাবাহিক তালিকা তৈরিতে উদ্যোগী হবেন?
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে যাওয়ার পরে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা থেকে মন্ত্রী, অনেককেই আটক করা হলো। শেখ পরিবারের কাউকে এখনও আটক করা গেল না কেন? তাদের নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ কারা তৈরি করল? বাংলাদেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা যারা বিদেশে পাচার করল, সেই তালিকায় প্রথম দিকে অবস্থান করা শেখ পরিবারের একজন সদস্যকে এখনও কেন দৃশ্যমান আইনের আওতায় আনা গেল না?
ইতিহাস তা-ই সাক্ষ্য দেয় যে, পরিবারটি যখনই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তখনই রাষ্ট্রীয় অর্থ নিজেদের মনে করেছে। আমরা গল্প-উপন্যাসে আরব শেখদের কিস্সা পড়ি, সিনেমা দেখি। বাংলার শেখদের এমন দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে কি সিনেমা বানাতে আগ্রহী হবো না?
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ষমত চ য ত পর ব র র য গ কর সরক র আওয় ম তদন ত সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল
তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।
যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।
ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।
এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।
বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।
টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।
একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুরাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
এত মৃত্যুর কারণ কীএই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।
যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।
গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।
গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।
মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।
শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:
এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।
দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)
তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।
চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।
পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।
এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।
পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।
গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
লেখক গবেষক: [email protected]