ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের টপ তিন স্কোরার যথাক্রমে এনামুল হক বিজয়, পারভেজ হোসেন ইমন ও নাঈম শেখ। রানের পসরা সাজিয়ে দেন দেশের একমাত্র পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট প্রতিযোগিতায়। এনমুল ৮৭৪, পারভেজ ৭৯৮ ও নাঈম ৬১৮ রান করেন। দ্যুতিময় পারফরম্যান্সে তিনজনই জায়গা করে নেন নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে।

এবার ‘এ’ দলের জার্সিতে তাদের পারফরম্যান্সটা দেখুন। এনামুল ৩ ম্যাচে ৭৯, পারভেজ ২ ম্যাচে ৩২, নাঈম ৩ ম্যাচে ৬২। ঢাকা লিগের গড় রানটাও নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে সিলেটে করতে পারেননি তারা। তাই তো সাবেক সফল এক অধিনায়কের কড়া বক্তব্য, ‘‘ঘরোয়া ক্রিকেটে মুখস্থ বল খেলতে খেলতে রান করে। একটু বল এদিক-সেদিক হলেই আর পারে না।’’

জাতীয় দলের সিনিয়র সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন মিরপুরে আজ সেই কথাটাই বোঝাতে চাইলেন, ‘‘খেলাটা তো আসলে মাথায়। আমাদের সমস্যাটাও আসলে মাথায়।’’

আরো পড়ুন:

মিচেলের পাকিস্তানে না যাওয়ার বক্তব্য নিয়ে ব্যাখা দিলেন রিশাদ

যুদ্ধবিরতির পর ফের মাঠে ফিরছে আইপিএল ও পিএসএল

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর আগে খেলোয়াড়দের নিয়ে এই অভিযোগ আগেও করেছেন সালাহউদ্দিন। ঘরোয়া ক্রিকেটে লম্বা সময় ধরে কাজ করেছেন তিনি। রুট লেভেলেও কাজ করেছেন। একাধিক ক্লাবে পেয়েছেন জাতীয় দলের সব ক্রিকেটারদের। সাকিব, তামিমের মতো ক্রিকেটাররা সমস্যায় পড়লেই ছুটেছেন তার কাছে। ছেলেদের এই ‘মাথার সমস্যা’ শুধরাতে না পারার দায় কোচদের কতটা প্রশ্নটাও উঠছে?

কিন্তু সেদিকে না গিয়ে সালাউদ্দিন হাঁটলেন সহজ পথে। যেখানে কাউকেই দায় দেওয়ার সুযোগ দেখেন না তিনি, ‘‘ছেলেদের স্কিলের উন্নতি নিয়ে কাজ করার খুব বেশি সময় পাই না আমরা। টানা এত সিরিজ থাকে। একটা থেকে আরেকটা সিরিজে যাওয়ার মতো বা স্কিল বাড়ানোর কাজ করার সুযোগ থাকে না।’’

তবে আশার কথাও শোনালেন তিনি, ‘‘এটা কীভাবে উন্নতি করা যায়.

.. এটা যে বললাম আর হয়ে গেল, তা কখনোই হবে না। এর জন্য আসলে অনেক সংস্কৃতির ব্যাপার আছে। এই জিনিসগুলো নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। দায়িত্বের ব্যাপারটা আমরা চেষ্টা করছি ছেলেদের ওপর ছেড়ে দিতে। তাহলে তারা হয়তো দ্রুত শিখবে।”

যে সংস্কৃতি বদলের কথা সালাউদ্দিন বলছেন তা দেশের ক্রিকেটের আদি চাওয়া। সেই পুরোনো সুরটাই নতুন করে ধরলেন তিনি, ‘‘এটা (দল গড়ে তোলা) একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। জাতীয় দলের ওপরেই সব কিছু নির্ভর করে না। যারা ‘এ’ দলে খেলছে, এইচপিতে আছে, টাইগার্সে অনুশীলন করবে, এর সঙ্গে আমাদের কাঠামো কতটা উন্নত হচ্ছে, সংস্কৃতি কত উন্নত হচ্ছে- সব কিছু মিলিয়েই কিন্তু বোঝা যাবে আমরা কোথায় যাচ্ছি। জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা তাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা নিজেদের উন্নতি চাচ্ছে। তবে একটা দেশের ক্রিকেট শুধু এই গুটিকয়েক ক্রিকেটারের ওপর নির্ভর করে না। এর জন্য ভালো কাঠামো প্রয়োজন। ছেলেরা নিজ থেকে কীভাবে তৈরি হয়ে আসবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এটা সবাই মিলেই করতে হবে। প্রতিটি বিভাগের এক হয়ে কাজ করতে হবে। সব কিছু মিলে একটা দেশের ক্রিকেট এগোবে।”

“এটা কোনো নির্দিষ্ট ক্রিকেটারের ওপর নির্ভর করে না। সমষ্টিগতভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। চারটা বিভাগ- গেম ডেভেলপমেন্ট, এইচপি, টাইগার্স, জাতীয় দল এবং এসব জায়গায় যারা কাজ করছে, তাদের সবার লক্ষ্য একই হতে হবে। পরিকল্পনা তাই ভালোভাবে করতে হবে এবং বাস্তবায়ন যদি ভালোভাবে না হয়, সবসময় একই জায়গায় থেকে যাব।” – যোগ করেন তিনি।

সঙ্গে কড়া বার্তাও দিয়ে রাখলেন, ‘‘আমরা একটা সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টা করছি, এটা কারও নিজের দল না, কারও একার সম্পত্তি নয়। এটা দেশের সম্পত্তি। আপনাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হবে, যদি ভালো নাও লাগে, পালন করতে হবে। আপনার ভালো না লাগলে এখানে খেলার দরকার নেই। কৌশলগত জায়গা থেকে ম্যাচের আগে আমরা ঠিক করব কে কখন খেলবে।”

ঢাকা/আমিনুল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ত য় দল র ক জ কর সমস য র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে 

পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।

শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্‌ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।

১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। 

একনজরে জয়দেব

চারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।

ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। 

পাহাড় আর ঝিরির পথে পথে

খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।

জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে। 

সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে। 

জয়দেব রোয়াজা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে