টানা কয়েক দিন ধরে প্রাণঘাতী সংঘাতের পর অস্ত্রবিরতিতে পৌঁছে ভারত-পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান শনিবার একটি অস্ত্রবিরতিতে উপনীত হয়। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এ উত্তেজনার শুরু হয় ২২ এপ্রিল, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার পর। ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হন। 

এই হামলা ঘিরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। শুক্রবার সকালে তাঁদের কাছে একটি ‘উদ্বেগজনক’ গোয়েন্দা তথ্য আসে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা পর্যবেক্ষণ করা মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে জেডি ভ্যান্স ছাড়াও ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও এবং হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ সুসি ওয়াইলস। তবে উদ্বেগজনক ওই তথ্য স্পর্শকাতর হওয়ায় তা সিএনএনের কাছে পরিষ্কার করা হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, এ তথ্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে আরও সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখার বিষয়ে একমত হন ভ্যান্স, রুবিও ও ওয়াইলস। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ভ্যান্স নিজেই মোদিকে ফোন করবেন।

গোয়েন্দা সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর নিজেদের পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানান জেডি ভ্যান্স। তারপর স্থানীয় সময় দুপুরে মোদিকে ফোন করেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট করে ভ্যান্স বলেন, হোয়াইট হাউস বিশ্বাস করে যে নাটকীয়ভাবে উত্তেজনা বৃদ্ধির উচ্চ আশঙ্কা রয়েছে। ভারতকে সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য ফোনকলে মোদির প্রতি আহ্বান জানান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি উত্তেজনা হ্রাসে সম্ভাব্য বিকল্প বিবেচনা করার পরামর্শও দেন তিনি। ফোনকলে মোদির কাছে সমঝোতার এমন একটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়, যা পাকিস্তান গ্রহণ করতে পারে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে সিএনএনকে বিস্তারিত জানাননি মার্কিন কর্মকর্তারা।

সিএনএনের প্রতিবেদন বলছে, ভ্যান্স-মোদির ফোনালাপের পরপরই শুক্রবার রাতভর রুবিওসহ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অন্য কর্মকর্তারা ভারত ও পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ চালিয়ে যান। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি সমঝোতার খসড়া তৈরিতে সরাসরি যুক্ত ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। দুই পক্ষকে আলোচনায় বসানোর ওপরই গুরুত্ব দিয়েছিল তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হলেও এর কয়েক ঘণ্টা পরেই পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে। ভারতের অভিযোগ, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে পাকিস্তান। অন্যদিকে পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ভারতীয় এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটি বলছে, তারা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একইসঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে পাকিস্তান।

পাকিস্তান রোববার ভোরে এক বিবৃতিতে জানায়, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নে তারা পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে এবং জানায়, পাকিস্তানি বাহিনী দায়িত্বশীল ও সংযমীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুদ্ধবিরতির সফল বাস্তবায়নে যেকোনো জটিলতা সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। একইসঙ্গে সীমান্তে অবস্থানরত সৈন্যদেরও সংযম প্রদর্শন করা জরুরি।

এর আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফের উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে আন্তর্জাতিক সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে ভারত।

গভীর রাতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এর তীব্র নিন্দা জানান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি দাবি করেন, যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান ফের গোলাগুলি শুরু করেছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তবে ভারতীয় সেনারাও এর সমুচিত জবাব দিচ্ছে এবং পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। 

একইসঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনো ধরনের অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের মোকাবিলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র পরর ষ ট র কর মকর ত

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্কের উদ্বেগজনক ধারা চলছে

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যে অশুল্ক বাধার ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কের দুই দেশের জন্য একটি উদ্বেগজনক ধারা চলছে। সম্প্রতি ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চার ধরনের পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির পরিবর্তে শুধু মুম্বাইয়ের নাভোসেভা বন্দরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।

এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের প্রবাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ৯৯ শতাংশের বেশি রপ্তানি স্থলপথেই ভারতে যায়। এই নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু খরচ বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য বড় ধরনের লজিস্টিক জটিলতাও তৈরি করবে। যদিও ভারত এসব সিদ্ধান্তকে নিয়মকানুন বা গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে দেখাতে পারে। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞার হঠাৎ প্রয়োগ ও পুনরাবৃত্তি একটি কৌশলগত উদ্দেশ্যের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি করে।

তবে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও একই পথে হাঁটছে। ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতীয় সুতা ও কয়েকটি পণ্যের আমদানিতে স্থলবন্দর দিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তবর্তী তিনটি স্থলবন্দর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, অবকাঠামোর অভাব ও সীমিত বাণিজ্য কার্যক্রম। এসব পদক্ষেপকে দুই দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনা ও নিয়ন্ত্রণমূলক প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এসবই একধরনের রক্ষণশীল অর্থনৈতিক নীতির ইঙ্গিত দেয়, যা পারস্পরিক আস্থা ও দ্বিপক্ষীয় স্থিতিশীল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটায়।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এত দিন ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে পরিচিত ভারত ও বাংলাদেশ এখন বাণিজ্য সমস্যা সমাধানে স্বচ্ছ সংলাপের পরিবর্তে একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও অশুল্ক বাধার দিকে ঝুঁকছে। এসব পদক্ষেপ শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষতি করছে না (যেখানে ভারতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারসাম্যহীনভাবে বেশি রপ্তানি হয়। ভারত থেকে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি হয় মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের মতো), বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতির সম্ভাবনাও ধ্বংস করছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা যখন বাড়ছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উচিত পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা দরকার। এর পাশাপাশি সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ না করা। এসব সরবরাহ চেইন ভেঙে দেয় এবং শিল্পোন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।

বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করা উচিত, যা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে মুক্ত। বাণিজ্যকে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহনশীলতার মাধ্যম হিসেবে দেখা, চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার নয়। দুই সরকারকেই কাঠামোগত আলোচনায় অগ্রাধিকার দিতে হবে, অশুল্ক বাধা–সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সহজতর করতে প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক মতভেদ যেন বৃহত্তর অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুফলকে ছাপিয়ে না যায়। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অনেকটাই এ সহযোগিতার ওপর নির্ভর করছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারত-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্কের উদ্বেগজনক ধারা চলছে
  • সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের হত্যার ঘটনায় আর্টিকেল নাইনটিনের উদ্বেগ
  • নারীর ভোটাধিকার বাতিল চেয়ে যাজকদের মন্তব্যে হেগসেথের সমর্থন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট