যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি কতটা কমল
Published: 12th, May 2025 GMT
ভারত ও পাকিস্তান আবারও যুদ্ধের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের এবারের চার দিনের বিশৃঙ্খল সংঘর্ষে অনেক নতুনত্ব ছিল এবং অভ্যন্তরীণ উত্তেজনার নানা বিষয় এখনো অস্থিতিশীল রয়ে গেছে। এসব কারণে চলমান যুদ্ধবিরতি পর দুই দেশের পুরোনো ‘আত্মসংযমের’ ধাঁচে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
এবারের যুদ্ধে নতুন প্রজন্মের সামরিক প্রযুক্তির ব্যবহার আকাশপথের সংঘাতকে চমকে দেওয়ার মতো উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ধারাবাহিক বিমান হামলা ও যুদ্ধবিমান বিধ্বংসী পাল্টা আঘাত এবারের সংঘর্ষের মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। এই সংঘাতে প্রথমবারের মতো কাশ্মীরের পুরোনো নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ব্যাপকহারে অস্ত্রসজ্জিত ড্রোন ব্যবহার করা হয়। কোনো পাইলটকে ঝুঁকিতে না ফেলে উভয় দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং নিশানায় আঘাত হানতে একযোগে মোতায়েন করা হয় শত শত ড্রোন।
এরপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। সরাসরি আঘাত হানে বিমানঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা স্থাপনায়। এতে দুই পক্ষ থেকেই ভয়াবহ হুমকি উচ্চারিত হয় এবং সামরিক বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে চলে যায়।
যখন বিপর্যয়ের চূড়ান্ত মুহূর্ত চলে আসল, তখন আন্তর্জাতিক কূটনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করে। অতীতেও যা ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে এবারের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বিপজ্জনক সংঘাতে ঘেরা নতুন বৈশ্বিক অধ্যায়ে উদাসীন নেতৃত্ব এবং শান্তিরক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ববোধের ঘাটতির ভেতরে বিশ্বকূটনীতির রক্ষাকবচ এতটা দুর্বল আগে দেখা যায়নি।
সামরিক ইতিহাসবিদ ও কৌশলগত বিশ্লেষক শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, ‘ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের অনেকগুলোই শেষ পর্যন্ত থেমেছে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপে।’
রাঘবন আরও বলেন, ভারত বা পাকিস্তান কোনো দেশেই উল্লেখযোগ্য সামরিক শিল্পকাঠামো নেই। ফলে বিদেশি অস্ত্র সরবরাহের ওপর দুই দেশের নির্ভরশীলতা থাকে, যাতে অনেক সময় আন্তর্জাতিক চাপ কার্যকর হয়।
তবে এবার দুই পক্ষের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর বলেই মনে হয়েছে। বিশেষ করে ভারত যেন দেখতে চাইছে, পূর্ববর্তী সংঘাতগুলোর চেয়ে ভিন্ন কোনো ফলাফল আদায় করা সম্ভব কি না।
শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, ‘ভারত সরকারের মধ্যে এবার প্রবলভাবে একটি মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো তারা নিশ্চিত করতে চায়, পাকিস্তান যেন এমন না মনে করে যে, তারা সহজে পার পেয়ে যাবে বা পাল্টা জবাব দিতে পারবে। এটা নিঃসন্দেহে উত্তেজনা বৃদ্ধির একটি কারণ। দুই পক্ষই মনে করছে, সংঘাত এমনভাবে শেষ হতে দেওয়া যাবে না, যাতে অন্য পক্ষ ভাবতে পারে তারা কোনোভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছেছে।’
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জালে আবদ্ধ ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এই সংঘাতের পর অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। আর এটা সম্ভবত এমন এক সংঘর্ষের সম্ভাবনা তৈরি করছে, যা আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
পাকিস্তান এখনো সামরিক কর্তৃত্বে পরিচালিত একটি রাষ্ট্র যেখানে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরেই দমনের শিকার হয়ে আসছে। এমন শাসনব্যবস্থার নেতৃত্বে রয়েছেন কট্টরপন্থী একজন জেনারেল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিন ধরে বয়ে আসা ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার ফসল তিনি।
অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জয়োল্লাস দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে ক্রমে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করছে। ফলে পাকিস্তান ইস্যুতে ভারতের নরম হওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না।
গতকাল রোববার পর্যন্ত এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি যে পাকিস্তান ও ভারত তাদের ইতিমধ্যে শীতল হয়ে পড়া কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে, কিংবা পরস্পরের নাগরিকদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভারতের পক্ষ থেকেও দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সিন্ধু পানিচুক্তি মেনে চলার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামাবাদ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, নদীর পানি আটকে দেওয়ার যেকোনো পদক্ষেপকে তারা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে বিবেচনা করবে।
যুদ্ধবিরতির খবরে সড়কে পাকিস্তানিদের উল্লাস। সিন্ধু প্রদেশের হায়দরাবাদে, ১০ মে সন্ধ্যায়.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরে যেসব বিষয় গুরুত্ব পাবে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ মঙ্গলবার চার দিনের মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশ সফরে যাচ্ছেন। এই সফরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে একাধিক বৈঠকে যোগ দেবেন তিনি। ট্রাম্প এমন সময় এই সফর করছেন, যখন মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই সফরে গাজায় যুদ্ধবিরতি, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, বাণিজ্য ও তেলের দাম কমানো নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এসব দেশে তাঁর সন্তানদের একাধিক ব্যবসা ও আবাসন প্রকল্প আছে। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে দুটি দেশ সৌদি আরবে বৈঠকে বসেছে। এ কারণে সৌদি আরব ওয়াশিংটনের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় সংক্রান্ত আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে কাতার।
ট্রাম্পের সফরের প্রথম দিনেই সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ ফোরাম অনুষ্ঠিত হবে। চলতি সপ্তাহেই এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এতে অতিথি হিসেবে থাকার কথা রয়েছে ব্ল্যাকরকের সিইও ল্যারি ফিঙ্ক, প্যালান্টিয়রের সিইও অ্যালেক্স কার্প এবং সিটি গ্রুপ, আইবিএম, কোয়ালকম, অ্যালফাবেট ও ফ্রাঙ্কলিন টেম্পলটনের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা। এ ছাড়া হোয়াইট হাউসের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ক্রিপ্টোবিষয়ক উপদেষ্টা ডেভিড স্যাকসও এই ফোরামে অংশ নেবেন।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তিকে ঘিরে বৈশ্বিক কেন্দ্র হতে চাইছে। এ জন্য তারা এআই অবকাঠামোতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এ কারণে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেমিকন্ডাক্টর কিনতে চাইছে। বাইডেনের আমলে এ বিষয়ে আইনি জটিলতা থাকলও ট্রাম্প প্রশাসন সে বিষয়টি সহজ করতে চাইছে।
পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। অন্যদিকে সৌদি আরব নিজস্ব বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করতে চায়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন ও সহায়তা চেয়েছে দেশটি।
ইসরায়েল-গাজা আলোচনাট্রাম্পের সফরের আরেকটি প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো গাজা উপত্যকার ভবিষ্যৎ। তিনি এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে গাজা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যও করেছেন তিনি। সম্প্রতি বলেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, তিনি গাজাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ আবাসন প্রকল্প’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।’
তেলের দাম এবং অর্থনীতিসিরিয়ার নতুন সরকারের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয় নিয়েও এই সফরে আলোচনা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ব্রাঞ্চ। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন পারস্য উপসাগরের নাম পাল্টে ‘আরব উপসাগর’ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। আরব দেশগুলো নতুন নাম উত্সাহের সঙ্গে গ্রহণ করলেও ইরান কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
তেলের দাম নিয়ে আলোচনাও গুরুত্ব পাবে। ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে (ওপেক) তেলের উৎপাদন বাড়াতে চাপ দিয়ে আসছিলেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের জন্য দাম কমানো যায়। তাই এই সফরে তেলের উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে।