দেশপ্রেমিক নিয়ে বিভ্রান্তিতেই দেশের দুরবস্থা
Published: 12th, May 2025 GMT
দেশপ্রেমিকের সংজ্ঞা কী? বিশ্বের সমষ্টিগত মানুষই অনিবার্যরূপে দেশপ্রেমিক। নিজ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসাই দেশপ্রেমিকের প্রাথমিক শর্ত। রাজনীতিবিদদেরও দেশপ্রেমিক বলা হয়। আমলাতন্ত্রও দেশপ্রেমিক হিসেবে গণ্য। নাগরিক সমাজ, বিত্তবান ব্যবসায়ী, সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণিরাও দেশপ্রেমিকের তক্মা পেয়ে থাকেন। তবে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষ।
কৃষক তার অক্লান্ত পরিশ্রমে খাদ্য উৎপাদন করে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অথচ উৎপাদিত খাদ্য-পণ্যের ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রীত মূল্যের অর্ধেক অর্থও তারা পায় না। মধ্যস্বত্বভোগী চক্র দাদন এবং নানা উপায়ে বাজারদরের বহু কম মূল্যে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য খরিদ করে হাত-বদলে ভোক্তার কাছে যখন ওই খাদ্য-পণ্য পৌঁছায় তখন দর বৃদ্ধির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ কৃষক তার রক্ত-ঘাম-শ্রমে উৎপাদিত খাদ্য-পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাবার ফলে কৃষকের দৈন্যদশার অবসান হয় না। অথচ এই কৃষক খাদ্য উৎপাদন না করলে আমাদের খাদ্য-নিরাপত্তা যে ঝুঁকিতে পড়বে– তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় শিল্প, কল-কারখানা অপ্রতুল। যেগুলো ছিল, বিশেষ করে পাট শিল্প অর্থাৎ পাটকল বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। আদমজীর মতো বৃহৎ পাটকল বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে বন্ধ করে সরকার অমার্জনীয় অপরাধ করেছিল। বিশ্বব্যাংক আমাদের পাটকল বন্ধের নির্দেশনা দেয়, অপরদিকে প্রতিবেশী ভারতকে পাটকল প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দেয়।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক শিল্প-কারখানা মব ভায়োলেন্সের শিকারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। এতে অনেক শ্রমিক জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছে। আমাদের পুঁজিওয়ালারা প্রচুর অর্থ বিনিয়োগে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। কিন্তু উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি শ্রমিকের নিরাপত্তা ও জীবিকার নিশ্চয়তায় সামান্যই ব্যয় করে। শ্রমিকরা কেবল মজুরি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকে। যে কোনো ছুতায় সেই সামান্য মজুরির পথও বন্ধ হয়ে যায়। এই যে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা, সেটাও টিকিয়ে এবং বাঁচিয়ে রাখছে শ্রমিকরা। এই শ্রমিকদের দেশপ্রেমিক না বলার উপায় কোথায়! অথচ কৃষক ও শ্রমিকদের দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই। একই রাষ্ট্র ও সমাজে তারা বসবাস করে প্রায় মানবেতরভাবে। সকল প্রকার শোষণের কবলে তারাই সর্বাধিক আক্রান্ত হয়ে এসেছে। অপরদিকে যাদের দেশপ্রেমিক হিসেবে গণ্য করা হয়, তাদেরই দেশদ্রোহের অনেক নজির রয়েছে। তাদের অনেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনে যেমন পারঙ্গম, তেমনি দেশের স্বার্থকে স্বীয় স্বার্থে বিকিয়ে দিতেও কসুর করে না।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। নির্বাচিত, অনির্বাচিত শাসকরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে রাষ্ট্রের মালিক বনে যায়। আখেরাত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে বলেই মনে করে। ইতিহাসের শিক্ষা কিন্তু তা বলে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা দেশ ও দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহির ধার ধারে না। যেন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজা তারা। মর্জিমাফিক দেশ পরিচালনা করে রাজবেশে। অথচ প্রতিটি সরকারই রাষ্ট্রের ম্যানেজার হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জনরায়ে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়ে থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষেত্রে নির্বাহী ক্ষমতার পরিসর আরও সংকীর্ণ। তাদের কাজই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা। জনপ্রতিনিধিশূন্য সরকারের পরিসর ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অসাংবিধানিক কোনো সরকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের এখতিয়ার রাখে না।
মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতা। ক্ষমতা যে মানুষকে মনুষ্যত্ব এবং জাগতিক জ্ঞানকে উৎপাটিত করে দেয়– তার প্রমাণ বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রেই প্রমাণ পাওয়া যায়। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীনরা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক হতে বিলম্ব করেন না। বাংলাদেশের ক্ষমতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিকতার পথে ফিরিয়ে আনতে এ যাবৎ অনেক রক্তপাত ঘটেছে। মানুষের ত্যাগ-আত্মত্যাগের অজস্র নজির সৃষ্টি হলেও আত্মদানকারীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গের অজস্র নজির আমরা দেখে আসছি। অথচ সরকার তথা শাসক বদল ঘটলেও ব্যবস্থার বদল ঘটে না। তাই আমাদের সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষায় পরিণত হয়েছে। কোনো সংস্কারে দেশবাসীর ভাগ্য বদল হবে না, ব্যবস্থার আমূল বদল ব্যতিরেকে। ব্যবস্থার বদল না হবার ফলে আমাদের অতীত ও বর্তমানজুড়ে কেবলই কানামাছি; কেবলই অন্ধকার।
মযহারুল ইসলাম বাবলা:
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত ব যবস থ আম দ র প টকল ক ষমত উৎপ দ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দেশপ্রেমিক নিয়ে বিভ্রান্তিতেই দেশের দুরবস্থা
দেশপ্রেমিকের সংজ্ঞা কী? বিশ্বের সমষ্টিগত মানুষই অনিবার্যরূপে দেশপ্রেমিক। নিজ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসাই দেশপ্রেমিকের প্রাথমিক শর্ত। রাজনীতিবিদদেরও দেশপ্রেমিক বলা হয়। আমলাতন্ত্রও দেশপ্রেমিক হিসেবে গণ্য। নাগরিক সমাজ, বিত্তবান ব্যবসায়ী, সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণিরাও দেশপ্রেমিকের তক্মা পেয়ে থাকেন। তবে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষ।
কৃষক তার অক্লান্ত পরিশ্রমে খাদ্য উৎপাদন করে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অথচ উৎপাদিত খাদ্য-পণ্যের ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রীত মূল্যের অর্ধেক অর্থও তারা পায় না। মধ্যস্বত্বভোগী চক্র দাদন এবং নানা উপায়ে বাজারদরের বহু কম মূল্যে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য খরিদ করে হাত-বদলে ভোক্তার কাছে যখন ওই খাদ্য-পণ্য পৌঁছায় তখন দর বৃদ্ধির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ কৃষক তার রক্ত-ঘাম-শ্রমে উৎপাদিত খাদ্য-পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাবার ফলে কৃষকের দৈন্যদশার অবসান হয় না। অথচ এই কৃষক খাদ্য উৎপাদন না করলে আমাদের খাদ্য-নিরাপত্তা যে ঝুঁকিতে পড়বে– তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় শিল্প, কল-কারখানা অপ্রতুল। যেগুলো ছিল, বিশেষ করে পাট শিল্প অর্থাৎ পাটকল বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। আদমজীর মতো বৃহৎ পাটকল বিশ্বব্যাংকের নির্দেশে বন্ধ করে সরকার অমার্জনীয় অপরাধ করেছিল। বিশ্বব্যাংক আমাদের পাটকল বন্ধের নির্দেশনা দেয়, অপরদিকে প্রতিবেশী ভারতকে পাটকল প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দেয়।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক শিল্প-কারখানা মব ভায়োলেন্সের শিকারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। এতে অনেক শ্রমিক জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছে। আমাদের পুঁজিওয়ালারা প্রচুর অর্থ বিনিয়োগে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। কিন্তু উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি শ্রমিকের নিরাপত্তা ও জীবিকার নিশ্চয়তায় সামান্যই ব্যয় করে। শ্রমিকরা কেবল মজুরি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকে। যে কোনো ছুতায় সেই সামান্য মজুরির পথও বন্ধ হয়ে যায়। এই যে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা, সেটাও টিকিয়ে এবং বাঁচিয়ে রাখছে শ্রমিকরা। এই শ্রমিকদের দেশপ্রেমিক না বলার উপায় কোথায়! অথচ কৃষক ও শ্রমিকদের দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই। একই রাষ্ট্র ও সমাজে তারা বসবাস করে প্রায় মানবেতরভাবে। সকল প্রকার শোষণের কবলে তারাই সর্বাধিক আক্রান্ত হয়ে এসেছে। অপরদিকে যাদের দেশপ্রেমিক হিসেবে গণ্য করা হয়, তাদেরই দেশদ্রোহের অনেক নজির রয়েছে। তাদের অনেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনে যেমন পারঙ্গম, তেমনি দেশের স্বার্থকে স্বীয় স্বার্থে বিকিয়ে দিতেও কসুর করে না।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। নির্বাচিত, অনির্বাচিত শাসকরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে রাষ্ট্রের মালিক বনে যায়। আখেরাত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে বলেই মনে করে। ইতিহাসের শিক্ষা কিন্তু তা বলে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা দেশ ও দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহির ধার ধারে না। যেন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজা তারা। মর্জিমাফিক দেশ পরিচালনা করে রাজবেশে। অথচ প্রতিটি সরকারই রাষ্ট্রের ম্যানেজার হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জনরায়ে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়ে থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষেত্রে নির্বাহী ক্ষমতার পরিসর আরও সংকীর্ণ। তাদের কাজই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা। জনপ্রতিনিধিশূন্য সরকারের পরিসর ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অসাংবিধানিক কোনো সরকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের এখতিয়ার রাখে না।
মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতা। ক্ষমতা যে মানুষকে মনুষ্যত্ব এবং জাগতিক জ্ঞানকে উৎপাটিত করে দেয়– তার প্রমাণ বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রেই প্রমাণ পাওয়া যায়। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীনরা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক হতে বিলম্ব করেন না। বাংলাদেশের ক্ষমতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিকতার পথে ফিরিয়ে আনতে এ যাবৎ অনেক রক্তপাত ঘটেছে। মানুষের ত্যাগ-আত্মত্যাগের অজস্র নজির সৃষ্টি হলেও আত্মদানকারীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গের অজস্র নজির আমরা দেখে আসছি। অথচ সরকার তথা শাসক বদল ঘটলেও ব্যবস্থার বদল ঘটে না। তাই আমাদের সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষায় পরিণত হয়েছে। কোনো সংস্কারে দেশবাসীর ভাগ্য বদল হবে না, ব্যবস্থার আমূল বদল ব্যতিরেকে। ব্যবস্থার বদল না হবার ফলে আমাদের অতীত ও বর্তমানজুড়ে কেবলই কানামাছি; কেবলই অন্ধকার।
মযহারুল ইসলাম বাবলা:
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত