১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ‘পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক’ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে সংঘাতের তীব্রতা বাড়বে। এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ স্যুজি ওয়াইলস জরুরি ভিত্তিতে মধ্যস্থতায় এগিয়ে যান।

ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং ভারত-পাকিস্তানের সরাসরি আলোচনার ব্যাপারে উৎসাহ দেন।

এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা বিশ্বজুড়ে স্বস্তির নিশ্বাস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দুই দেশের মধ্য পারমাণবিক যুদ্ধ হলে এক সপ্তাহের মধ্যে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ মারা যেতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই অঞ্চলজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে, যুক্তরাষ্ট্র তার কূটনৈতিক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসে।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান আরও বিপজ্জনক এক যুগে ঢুকে পড়েছে১১ মে ২০২৫

ট্রাম্পের ঘোষণা ভারতে কারও কারও দিক থেকে ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ভেদ প্রকাশ মালিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘১০ মে ২০২৫-এর যুদ্ধবিরতি: ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস একদিন সেই প্রশ্ন তুলবে, আমাদের সামরিক ও বেসামরিক পদক্ষেপের পর কোন রাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধা অর্জিত হয়েছিল।’

এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, ‘বিদেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নয়, আমি আশা করেছিলাম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেবেন। সিমলা চুক্তির (১৯৭২) পর থেকে আমরা সব সময় তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছি। তাহলে এবার কেন তা গ্রহণ করলাম? আমি আশা করি, কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে না। কারণ, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’

ওয়াইসির পরের মন্তব্যটি সম্ভবত ট্রাম্পের একটি বিবৃতিকে কেন্দ্র করে। ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার হাজার বছরের সংঘাতের সমাধানের ব্যাপারে তিনি আগ্রহী।

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি: মোদির ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি হিতে বিপরীত হলো১১ মে ২০২৫বহু বছর ধরে কিছু ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বলে আসছিলনে, চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভারত যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। কেউ কেউ আবার চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করেন। গত কয়েক দিনের ঘটনায় ভারতের কৌশলগত সীমাবদ্ধতাকে খোলাসা করে দিয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধবিরিতির ঘোষণাকে ভারতের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মোদির পিছু হটার ঘটনা হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে কাশ্মীর ইস্যুতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে ভারত দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের যে বিরোধিতা করে আসছিল, সেই অবস্থানকে খাটো করবে বলেও তাঁরা মনে করছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাস্তবতা যতক্ষণ পর্যন্ত এসে কামড় না দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্যানধারণা বাস্তবতাকে ছাপিয়ে যায়। অর্থনৈতিক বিকাশ ও পারমাণবিক শক্তির জোরে ভারতকে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু ২২ এপ্রিল পেহেলগামে টিআরএফের হামলার পর দেশটি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে বরং তার দুর্বলতাই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ভারত শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলেই সেটি লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়, পাকিস্তানের আঞ্চলিক অবস্থান জোরালো হয়। কূটনৈতিকভাবে মোদি সরকারকে দুর্বল অবস্থানে ফেলে দেয়।

৭ মে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল টিআরএফের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়। ভারতের অভিযোগ হলো এই গোষ্ঠীগুলোকে পাকিস্তান পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।

এই অভিযানে ফ্রান্সের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দেশের ভেতরে যে চরম ক্ষোভের আবহ, সেটিকে ব্যবহার করে মোদি নিজের শক্তিশালী নেতার ভাবমূর্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু এই অভিযানের সফলতার বয়ান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। ভারত দাবি করেছে, কেবল সন্ত্রাসীদের অবস্থানেই আক্রমণ করা হয়েছে।

পাকিস্তান নিজেদের যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে হামলা প্রতিহত করে। পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এর মধ্যে তিনটি রাফাল বিমানও রয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দুজন মার্কিন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন যে চীনের তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমান অন্তত দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। এতে  চীন গোয়েন্দা ও নজরদারি সমর্থন দেয়। ভারত যদিও এখন পর্যন্ত স্বীকার করেনি তাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কি না।

ভারতের সংবাদমাধ্যম প্রথমে করাচির সমুদ্রবন্দরসহ পাকিস্তানের শহরগুলোতে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে; কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, এসব প্রতিবেদন পরিপূর্ণভাবে প্রোপাগান্ডা প্রচেষ্টার অংশ।

আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তান: যুদ্ধে সবার আগে জেতে মিথ্যা ১১ মে ২০২৫

৯ মে পাকিস্তান দাবি করে, ভারত তাদের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে ইসলামাবাদের কাছে একটি ঘাঁটিও ছিল। এর পাল্টা জবাবে পাকিস্তান স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে ভারতের উদমপুর, পাঠানকোট, আদমপুর ও ভুজ বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানে। ভারতীয় কর্মকর্তা স্বীকার করেন, পাকিস্তানি ড্রোন ও গোলা বেসামরিক ও সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।

এবারের সংঘাতে আঞ্চলিক অধিপতি হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তিতে চিড় ধরে। ভারত রাফাল যুদ্ধবিমানের ক্ষমতা নিয়ে অতি ভাবনা ভেবেছিল আর চীনের যুদ্ধবিমানের সক্ষমতা বুঝতে ভুল করেছিল।

গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের প্রতি চীনের সামরিক সহায়তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২০ সালের পর সামরিক খাতে পাকিস্তানের মোট আমদানির ৮১ শতাংশই এসেছে চীন থেকে।

বহু বছর ধরে কিছু ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বলে আসছিলনে, চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভারত যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। কেউ কেউ আবার চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করেন।

গত কয়েক দিনের ঘটনায় ভারতের কৌশলগত সীমাবদ্ধতাকে খোলাসা করে দিয়েছে।

ইউসুফ নজর পাকিস্তানের বিশ্লেষক ও লেখক

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অবস থ ন র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের শুল্ক শাস্তি, মোদির ভারতের সামনে সহজ কোনো পথ নাই

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের ভাবমূর্তি যেভাবে বাজারে প্রচার করতে পারেন, সেটা খুব কম নেতাই পারেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে শক্তিশালী ও আরও আত্মপ্রত্যয়ী ভারতের নির্মাতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছেন। নরেন্দ্র মোদি ভারতের জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নিজের কৃতিত্ব দাবি করে এসেছেন। আর যখন পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, তখন তিনি পূর্বসূরিদের দোষারোপ করেছেন। এক প্রজন্মের ভোটাররা বিশ্বাস করেছেন, বিশ্বমঞ্চে ভারতের মর্যাদা যে বেড়েছে, তার পেছনে রয়েছেন মোদি।

কিন্তু এরপরই দৃশ্যপটে ডোনাল্ড ট্রাম্প চলে এসেছেন। তিনি প্রচলিত নিয়মকানুন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজে অত্যন্ত সিদ্ধ। গত বুধবার তিনি বিশ্বের চতুর্থ অর্থনীতি ভারত থেকে আসা আমদানি পণ্যের ওপর অবিশ্বাস্যভাবে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। এটা কার্যকর হলে ভারতকে যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ শুল্ক দিতে হবে।

দুই ব্যক্তির মধ্যে আগের যে মধুর সম্পর্ক, সেই বিবেচনায় এই ঘোষণাকে চমকজাগানিয়া বলেই মনে হয়। মোদি ও ট্রাম্প দুজনেই আদর্শগত মিলের দিক থেকে জনতুষ্টিবাদী নেতা। এর আগে তাঁরা একে অপরের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন এবং এ বছরের জানুয়ারি মাসে ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর, বিশ্বনেতাদের মধ্যে মোদিই ছিলেন প্রথম দিককার একজন, যিনি হোয়াইট হাউসের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসেই ট্রাম্পকে তিনি ‘মহৎ বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলার থেকে দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেন।

কিন্তু ঝামেলা টগবগ করে ফুটতে শুরু করল জুলাইয়ের শেষ দিকে। সে সময়ে ট্রাম্প ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন, গত বুধবার সেটা দ্বিগুণ করেন। রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল কিনছে, সেটাকেই লক্ষ্যবস্তু করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইউক্রেনের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতির জন্য নির্ধারিত সময়সীমা রাশিয়ার নাকের ডগায় ঝুলছে।

দীর্ঘদিন ধরেই ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে আসছে। কিন্তু এর জন্য যে মূল্য দিতে হয়, সেটা গত সপ্তাহেই দেখা গেল। এই শুল্ক ভারতের কাছে বার্তা দিচ্ছে যে যদিও দেশটির প্রভাব ও অর্থনীতির আকার বেড়েছে, কিন্তু কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা এখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যেখানে দেশটি ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

নতুন শুল্ক ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। বাড়তি এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বা ব্যবসা সুরক্ষিত করবে, বিষয়টা এমনটা নয়। কিন্তু বাড়তি এই শুল্ক সেই দেশকে শাস্তি দেওয়া হবে, যে দেশটি এখন নিজেদের মোট আমদানির ৩৬ শতাংশ জ্বালানি তেলে রাশিয়া থেকে আমদানি করে। অথচ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের আগে সেটি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। সস্তায় কেনা এই তেলের বেশির ভাগটা দেশের ভেতরকার চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করা হয়। ভারতকে তার প্রয়োজনীয় তেলের ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করতে হয়। আর দ্রুত অন্য কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ বা সস্তাও হবে না।

হতে পারে এ কারণেই ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আরোপ করা শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং এটিকে ‘অন্যায়, অবিচার ও অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু এখানে এটাও মনে হতে পারে যে পশ্চিমা দেশগুলো ভণ্ডামি করছে। ভারত খুব দ্রুত উল্লেখ করেছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো রাশিয়ার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যবসা করে চলেছে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল কেনাকে এর আগে সমর্থন করেছিল তার কারণ হলো, এতে বিশ্বে জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখা গিয়েছিল।

বিভিন্ন সূত্রের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের তেল পরিশোধনাগারগুলো রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখবে কি না, তার জন্য এখন দিল্লি সরকারের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছে। একই সময়ে আবার ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মস্কোতে রয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, পুতিন এই বছরের শেষ দিকে ভারত সফর করবেন। মোদি সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের আসন্ন দিনগুলোতে রাশিয়া সফরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু মোদি সরকার যে প্রতিক্রিয়া জানাক না কেন, একটি ব্যাপার এখানে স্পষ্ট। ট্রাম্পের সঙ্গে যে ‘বন্ধুত্বের’ কথা মোদি ভেবেছিলেন, সেটি চূড়ান্ত বিচারে অকার্যকর ও হালকা সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক মোদির অতি উচ্ছ্বাস আর ট্রাম্পের নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়। সেই ব্রোম্যান্সের (ভাইয়ে ভাইয়ে মধুর সম্পর্ক) দিন শেষ। বৈশ্বিক স্বার্থের শীতল অঙ্কের কাছে ব্যক্তিগত রসায়ন কখনোই ছাপিয়ে যেতে পারে না।

রাশিয়ার তেলের বিষয়টিকে এক পাশে সরিয়ে রাখলেও বাণিজ্য, শুল্ক ও ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। ট্রাম্প চান, আমেরিকায় উৎপাদনশিল্প ফিরিয়ে আনতে। আর মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি আংশিকভাবে আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে চীন থেকে ভারতে স্থানান্তর করার আহ্বান। মোদির এই পথ ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন।

পাকিস্তানের প্রতি ট্রাম্পের আকস্মিক ও কৌশলগত ঝোঁক ভারত গভীরভাবে অসন্তুষ্ট। জুনে ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান এবং সম্প্রতি তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে তেল অনুসন্ধানের একটি চুক্তির ঘোষণাও দিয়েছেন। এ ছাড়া মে মাসে চার দিনের সংঘর্ষের পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়, তার কৃতিত্ব দাবি করেন ট্রাম্প। এটিও ভারতের জন্য অনেকটা বিরক্তির জন্ম দেয়।

এসব ঘটনার কোনোটিই এমন একটি দেশের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে না, যে দেশটি পাকিস্তানের সঙ্গে তিক্ত লড়াই করে চলেছে এবং যে দেশটির কর্মকর্তারা দুই দশক ধরে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে উন্নত করার জন্য পরিশ্রম করে চলেছেন। ট্রাম্পের পদক্ষেপ সেই সম্পর্কের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

ট্রাম্পের কথাবার্তা ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীকেও আহত করেছে। ট্রাম্প ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন এবং মোদিকে অভিযুক্ত করেছেন যে তিনি ‘বিশৃঙ্খলা থেকে মুনাফা’ করছেন। ‘বন্ধুত্বের প্রতীককে’ জনলজ্জা ও জবরদস্তির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। ভারতীয় কূটনীতিবিদেরা সাধারণত নীরবে এবং দৃশ্যপটের আড়ালের কূটনীতির সঙ্গে অভ্যস্ত।

কয়েক দিন চুপ থাকার পর বৃহস্পতিবার নরেন্দ্র মোদি এ নিয়ে প্রথম মুখ খোলেন। তিনি বলেন, ভারতীয় কৃষকদের স্বার্থে কোনো আপস করা হবে না। কিন্তু তার সামনে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। যদি তিনি কোনো বিষয়ে আপস করেন, তাহলে দেশে তাঁর ভাবমূর্তি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। কিন্তু যদি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, তাহলে উত্তেজনা আরও তীব্র হবে। তাতে উতোর–চাপানে থাকা ভারতের অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে। কেননা, যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ভারতের অর্থনীতি আরও নিবিড়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের ৮৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। ২৭ আগস্ট থেকে যে শুল্ক ধার্য করা হয়েছে তা যদি কার্যকর হয়, তাহলে এর অনেকটাই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দেশের ভেতরে মোদির রাজনীতিও ঝুঁকিতে পড়বে। বিরোধী দলগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে এবং শুল্ককে ‘অর্থনৈতিক ব্ল্যাকমেল’ ও ‘ভারতকে অন্যায় বাণিজ্যচুক্তিতে’ বাধ্য করার প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজেদের চাপ আরও বাড়িয়েছে।

ভারতের জন্য শিক্ষা হলো, উষ্ণ আলিঙ্গন নয়, কঠোর স্বার্থ দিয়েই নীতি পরিচালিত হতে হবে। ট্রাম্পের কাছে কোনো সম্পর্কই পবিত্র নয়, চুক্তির শিল্পটাই তার কাছে সবকিছু। মোদি হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি ট্রাম্পকে মুগ্ধ করতে পারবেন; ট্রাম্প প্রশংসা পছন্দ করলেও শেষ পর্যন্ত সেটাই যথেষ্ট নয়।

দীর্ঘদিন ধরেই ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে আসছে। কিন্তু এর জন্য যে মূল্য দিতে হয়, সেটা গত সপ্তাহেই দেখা গেল। এই শুল্ক ভারতের কাছে বার্তা দিচ্ছে যে যদিও দেশটির প্রভাব ও অর্থনীতির আকার বেড়েছে, কিন্তু কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা এখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যেখানে দেশটি ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

সলিল ত্রিপাঠী, নিউইয়র্কে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক

দ্য টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ট্রাম্পের শুল্ক শাস্তি, মোদির ভারতের সামনে সহজ কোনো পথ নাই