শক্তি দেখাতে গিয়ে ভারতের দুর্বলতা বেরিয়ে এল কি?
Published: 13th, May 2025 GMT
১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ‘পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক’ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে সংঘাতের তীব্রতা বাড়বে। এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ স্যুজি ওয়াইলস জরুরি ভিত্তিতে মধ্যস্থতায় এগিয়ে যান।
ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং ভারত-পাকিস্তানের সরাসরি আলোচনার ব্যাপারে উৎসাহ দেন।
এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা বিশ্বজুড়ে স্বস্তির নিশ্বাস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দুই দেশের মধ্য পারমাণবিক যুদ্ধ হলে এক সপ্তাহের মধ্যে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ মারা যেতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই অঞ্চলজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে, যুক্তরাষ্ট্র তার কূটনৈতিক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসে।
আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান আরও বিপজ্জনক এক যুগে ঢুকে পড়েছে১১ মে ২০২৫ট্রাম্পের ঘোষণা ভারতে কারও কারও দিক থেকে ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ভেদ প্রকাশ মালিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘১০ মে ২০২৫-এর যুদ্ধবিরতি: ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস একদিন সেই প্রশ্ন তুলবে, আমাদের সামরিক ও বেসামরিক পদক্ষেপের পর কোন রাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধা অর্জিত হয়েছিল।’
এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, ‘বিদেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নয়, আমি আশা করেছিলাম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেবেন। সিমলা চুক্তির (১৯৭২) পর থেকে আমরা সব সময় তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছি। তাহলে এবার কেন তা গ্রহণ করলাম? আমি আশা করি, কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে না। কারণ, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
ওয়াইসির পরের মন্তব্যটি সম্ভবত ট্রাম্পের একটি বিবৃতিকে কেন্দ্র করে। ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার হাজার বছরের সংঘাতের সমাধানের ব্যাপারে তিনি আগ্রহী।
আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি: মোদির ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি হিতে বিপরীত হলো১১ মে ২০২৫বহু বছর ধরে কিছু ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বলে আসছিলনে, চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভারত যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। কেউ কেউ আবার চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করেন। গত কয়েক দিনের ঘটনায় ভারতের কৌশলগত সীমাবদ্ধতাকে খোলাসা করে দিয়েছে।মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধবিরিতির ঘোষণাকে ভারতের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মোদির পিছু হটার ঘটনা হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে কাশ্মীর ইস্যুতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে ভারত দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের যে বিরোধিতা করে আসছিল, সেই অবস্থানকে খাটো করবে বলেও তাঁরা মনে করছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাস্তবতা যতক্ষণ পর্যন্ত এসে কামড় না দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্যানধারণা বাস্তবতাকে ছাপিয়ে যায়। অর্থনৈতিক বিকাশ ও পারমাণবিক শক্তির জোরে ভারতকে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু ২২ এপ্রিল পেহেলগামে টিআরএফের হামলার পর দেশটি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে বরং তার দুর্বলতাই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ভারত শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলেই সেটি লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়, পাকিস্তানের আঞ্চলিক অবস্থান জোরালো হয়। কূটনৈতিকভাবে মোদি সরকারকে দুর্বল অবস্থানে ফেলে দেয়।
৭ মে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল টিআরএফের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়। ভারতের অভিযোগ হলো এই গোষ্ঠীগুলোকে পাকিস্তান পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।
এই অভিযানে ফ্রান্সের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দেশের ভেতরে যে চরম ক্ষোভের আবহ, সেটিকে ব্যবহার করে মোদি নিজের শক্তিশালী নেতার ভাবমূর্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু এই অভিযানের সফলতার বয়ান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। ভারত দাবি করেছে, কেবল সন্ত্রাসীদের অবস্থানেই আক্রমণ করা হয়েছে।
পাকিস্তান নিজেদের যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে হামলা প্রতিহত করে। পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এর মধ্যে তিনটি রাফাল বিমানও রয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দুজন মার্কিন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন যে চীনের তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমান অন্তত দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। এতে চীন গোয়েন্দা ও নজরদারি সমর্থন দেয়। ভারত যদিও এখন পর্যন্ত স্বীকার করেনি তাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কি না।
ভারতের সংবাদমাধ্যম প্রথমে করাচির সমুদ্রবন্দরসহ পাকিস্তানের শহরগুলোতে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে; কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়, এসব প্রতিবেদন পরিপূর্ণভাবে প্রোপাগান্ডা প্রচেষ্টার অংশ।
আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তান: যুদ্ধে সবার আগে জেতে মিথ্যা ১১ মে ২০২৫৯ মে পাকিস্তান দাবি করে, ভারত তাদের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে ইসলামাবাদের কাছে একটি ঘাঁটিও ছিল। এর পাল্টা জবাবে পাকিস্তান স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে ভারতের উদমপুর, পাঠানকোট, আদমপুর ও ভুজ বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানে। ভারতীয় কর্মকর্তা স্বীকার করেন, পাকিস্তানি ড্রোন ও গোলা বেসামরিক ও সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।
এবারের সংঘাতে আঞ্চলিক অধিপতি হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তিতে চিড় ধরে। ভারত রাফাল যুদ্ধবিমানের ক্ষমতা নিয়ে অতি ভাবনা ভেবেছিল আর চীনের যুদ্ধবিমানের সক্ষমতা বুঝতে ভুল করেছিল।
গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের প্রতি চীনের সামরিক সহায়তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২০ সালের পর সামরিক খাতে পাকিস্তানের মোট আমদানির ৮১ শতাংশই এসেছে চীন থেকে।
বহু বছর ধরে কিছু ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বলে আসছিলনে, চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভারত যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। কেউ কেউ আবার চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করেন।
গত কয়েক দিনের ঘটনায় ভারতের কৌশলগত সীমাবদ্ধতাকে খোলাসা করে দিয়েছে।
ইউসুফ নজর পাকিস্তানের বিশ্লেষক ও লেখক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দোকানিদের ভবনে ফেরাতে পদক্ষেপ নিন
চট্টগ্রাম নগরীতে কাঁচাবাজারের জন্য খ্যাত চকবাজারের ধনির পুল এলাকায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে ছয় কোটি টাকায় একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছিল সিটি করপোরেশন। কয়েক দফা পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিক্রেতা বা দোকানদারেরা ভবনটিতে দোকান নিয়ে বসছেন না। ফুটপাতে বাজার বসার কারণে ওই এলাকায় যানজট লেগেই আছে, ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে পাশের খালেও জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। অথচ ভবন নির্মাণে পরিকল্পনায় ভুল থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়ে ভবনটিকে কাজে লাগাতে হবে।
চকবাজারের এই কাঁচাবাজার নিয়ে প্রথম আলো আগেও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সম্ভাব্যতা যাচাই করা ছাড়া বা পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বাস্তব উদাহরণ এটি। জনগণের অর্থে নির্মিত ভবনটি জনগণের কোনো উপকারেই আসছে না। দোকানদার বা বিক্রেতারা এখানে সুফল পাওয়ার কথা থাকলেও তা থেকে পুরোপুরিই বঞ্চিত তাঁরা। অন্যদিকে ফুটপাতে দোকান বসার কারণে নানাভাবে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়ে গেছে, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা শাহাদাত হোসেন ভবনটিকে চালু করার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফুটপাতে দোকানদারদের ভবনের দোতলায় পুনর্বাসন করেন তিনি। এ জন্য তাঁদের কোনো দোকানভাড়া দিতে হচ্ছিল না। শুধু বাজারের ইজারাদারের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছিল। ফুটপাতে থাকার সময়ও এই অর্থ দিতে হতো। এরপরও দোকানিরা ভবনে থাকেননি। দু-তিন মাস না যেতেই আবার ফুটপাত ও সড়ক দখল করে ব্যবসা শুরু করেন সবজি বিক্রেতারা। গত শুক্রবার ফুটপাত ও সড়কে দোকান দেখে ক্ষুব্ধ হন মেয়র শাহাদাত হোসেন।
তার মানে, শুধু দোকানিদের পুনর্বাসনই যথেষ্ট নয়। কাঁচাবাজারটি যখন পুরোনো ভবনে ছিল, তখন দোকানের বিন্যাস যেমন ছিল নতুন ভবনে সেটি হয়নি। আগের ভবনে সবজি, পেঁয়াজ, রসুনের বাজার ছিল নিচতলায়। দোতলায় ছিল মাছ-মাংসের বাজার। নতুন ভবনে হয়েছে উল্টো। মানুষ নিচতলা থেকে মাছ-মাংস কিনে সবজির জন্য আর দোতলায় উঠতে চান না। ফলে দোতলায় থাকা দোকানিরা বলছেন, ক্রেতারা না আসায় তাঁদের পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা ফুটপাতে বসছেন। ফুটপাতে যেখানে তাঁদের দৈনিক বিক্রি ৪০-৫০ হাজার টাকা ছিল, নতুন ভবনে তা কমে ৮-১০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।
ভবনটিকে যেভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া। পুরোনো ভবনে যেভাবে বাজারের দোকানগুলো বরাদ্দ করা ছিল, নতুন ভবনেও সে অনুসারে করা যায় কি না, বিবেচনা করা হোক। তা ছাড়া ক্রেতাদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। ফুটপাতে দোকান বসানো ও খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।