আইএমএফের ঋণের দুই কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার পাচ্ছে বাংলাদেশ
Published: 13th, May 2025 GMT
আইএমএফের শর্ত মেনে গভীল রাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি বিভাগ করার পর ডলারের বিনিময় হারে নমনীয়তা আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রা বেচা-কেনায় ‘ক্রলিং পেগ’র করিডোর আড়াই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হতে পারে। এতে করে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির প্রায় ১৩০ কোটি ডলার পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বুধবার গভর্নর ড.
দুবাইয়ে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে বিভিন্ন পক্ষের আলোচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন। আগামী ১৭ মে তার দেশে ফেরার কথা। এর মধ্যে আজ বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাকা সংবাদ সম্মেলন গভর্নর ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেবেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময়হার নির্ধারণে আরও নমনীয় করতে সম্মত হয়েছে। বিদ্যমান ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে এ নমনীয়তা দেখানো হবে। এক্ষেত্রে ডলারের মধ্যবর্তী দর বর্তমানের ১১৯ টাকার সঙ্গে চার শতাংশ করিডোর দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে যা আড়াই শতাংশ রয়েছে। এই করিডোর মানে হলো– ডলারের মধ্যবর্তী দরের সঙ্গে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উঠানামার সীমা। এর ফলে ডলারের দর সামান্য বাড়তে পারে।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির তিন কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন শর্তের কারণে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। ঋণ ছাড়ের আগে আইএমএফের শর্তের অগ্রগতি যাচাইয়ে গত মাসে একটি মিশন ঢাকা সফর করে। কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই তারা ঢাকা ছাড়ে। মূলত, বিনিময় হার নিয়েই দুই পক্ষ সমঝোতায় আসতে পারেনি। যে কারণে আলোচনা গড়ায় ওয়াশিংটনে। গত মাসের শেষ দিকে আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকের ফাঁকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সাইডলাইনে আলাদা বৈঠক হয়। সেখানেও সমঝোতায় পৌঁছাতে না পেরে গত ৫ ও ৬ এপ্রিল দুই পক্ষ ভার্চুয়াল বৈঠক করে। এসব বৈঠকের ভিত্তিতে অবশেষে দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছেছে। সে আলোকে শিগগিরই স্টাফ লেভেল চুক্তি হতে পারে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আইএমএফ আইএমএফ র সমঝ ত
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের ঋণের কিস্তি কি পাব না?
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তি পায়নি বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তি পেয়েছিল বিগত সরকারের আমলের শেষদিকে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছিল। রিজার্ভে বড় অবনতি এবং এটা ঘিরে শঙ্কা থেকেই মূলত আইএমএফের শরণাপন্ন হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ লাভের চুক্তি হয়েছিল। শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে এটা পাওয়ার কথা। বিগত শাসনামলে এ ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হলেও কিস্তি পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। ইতোমধ্যে ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আশা, আগামী জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একযোগে পাওয়া যাবে।
মাঝে আইএমএফ মিশন ঘুরে যাওয়ার সময়ই বোঝা গিয়েছিল, ঋণ কর্মসূচিতে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। পরে অর্থ উপদেষ্টা, গভর্নর ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর বক্তব্যেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তাদের বক্তব্যের সারকথা হলো– আইএমএফের পরবর্তী কিস্তি পাওয়া নাও যেতে পারে; কিন্তু এতে তেমন অসুবিধার সৃষ্টি হবে না। সংস্থাটি শর্ত পরিপালন ঘিরে চাপ সৃষ্টি করলে বাংলাদেশ তা মানতে নারাজ। আইএমএফের শর্তাবলি নিয়ে দুনিয়াজুড়েই সমালোচনা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কর্মসূচিতে তারা ক্রমে আরও বেশি ‘শর্তের জালে’ জড়িয়ে ফেলে বলে অভিযোগ নতুন নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায়ও মনে হচ্ছে, শর্ত নিয়ে এখন বেশি চাপাচাপি করছে সংস্থাটি। এ ঋণ চুক্তিতে মোট ৩৮টি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এখন নাকি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে চারটি শর্ত (মতান্তরে দুটি) পরিপালন নিয়ে। এর মধ্যে বেশি আলোচিত ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি।
গত বছরের মে মাসের শুরুতে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে গিয়েই ডলারের দাম নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। দামের উল্লম্ফন রোধে একটি নির্দিষ্ট সীমায় ওঠা-নামার সুযোগ করে দেওয়া হয় ডলারের দামকে। তা সত্ত্বেও পদ্ধতিটি চালুর পরপরই ডলারের দাম ৭ টাকা বেড়ে যায়। ডলারের দাম বাড়লে প্রবাসে উপার্জনকারী আর রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তারা খুশি হলেও আমদানিকাররা চিন্তিত হন। কারণ বেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানি করতে হয় তাদের। সরকারি খাতে আমদানিও তখন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। এর পরিণতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে উঠতে দেখা যায়। আর মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির প্রভাবের কথা তো সবারই জানা।
শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়টার মতো এখনও মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে। কোনো কোনো মাসে সামান্য কমলেও আবার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ার শঙ্কাতেও ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারে ছাড়তে নারাজ।
আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার অবশ্য এ মুহূর্তে ইতিবাচক। জ্বালানিসহ যেসব পণ্য আমরা আমদানি করে থাকি, সেগুলোর দাম কমতির দিকে। বিশ্ববাজারে চালের দাম হ্রাসও বড় খবর। হালে আমরা কিছু চালও আমদানি করছি। সরকারের দাবি, ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকায় আমদানি কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে পণ্যসামগ্রীর দাম কমে এলে এ অবস্থায় আরও বেশি সুফল মিলবে।
এ যুক্তিতেই কেউ কেউ বলছেন, এটাই ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। কেননা, এতে দাম কিছুটা লাফিয়ে বাড়লেও বিশ্ববাজার কমতির দিকে থাকায় আমদানি ব্যয় পুষিয়ে যাবে। আইএমএফ হয়তো এটাই বলতে চাইবে। কিন্তু সরকার এখনই ডলারকে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছাড়তে নারাজ। হালে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে রিজার্ভে এক ধরনের স্বস্তি এলেও সরকার মনে করছে, উল্লিখিত সংস্কারের সময় এখনও আসেনি।
সরকারের বক্তব্যে মনে হতে পারে, আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে যেতে হলেও পরোয়া নেই। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে স্থবিরতা চললেও তারা হয়তো দেখছেন, প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি রপ্তানি আয় পরিস্থিতি ইতিবাচক। ট্রাম্প প্রশাসন মাঝে অনেক বেশি শুল্ক বাড়ালেও তা একযোগে প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি করে প্রযোজ্য বলে বাংলাদেশ বরং এ থেকে সুবিধা পাবে। এ অবস্থায় আইএমএফের প্রতিশ্রুত বিদেশি মুদ্রা না পেলেও চলবে। কিন্তু বিষয়টা কেবল বিদেশি মুদ্রাবাজার বা রিজার্ভ ঠিকঠাক রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অর্থনীতি গতি হারানোয় আমদানি চাহিদা বেশি না হওয়াতেও সরকার হয়তো ডলারের প্রবাহ নিয়ে স্বস্তিতে আছে। সে কারণে কমেছে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার তীব্র চাহিদা। তবে এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা রাখা-না রাখার বিষয়ও এখানে সম্পর্কিত। এ ঋণের অঙ্ক তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও চুক্তি অনুযায়ী সেটি পেতে থাকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
প্রায় একই সময়ে শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তানও আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তিতে গিয়েছিল। শ্রীলঙ্কা তো নজিরবিহীন সংকটে পড়েই শরণাপন্ন হয় আইএমএফের। তখন বাংলাদেশও অব্যাহত রিজার্ভ ক্ষয়ের ঘটনায় পড়ে শঙ্কার মধ্যে। আমদানি হ্রাসেও তখন বাধ্য হয় সরকার। ওই অবস্থায় আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তি ‘বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ’ বলেই বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু হালে কর্মসূচিটি জটিলতায় নিপতিত বললে ভুল হবে না। এর কারণ কি রাজনৈতিক?
এনবিআরের নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগকে আলাদা করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা নিয়ে জটিলতা নাকি রয়েই গেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে এমনটি যে অস্বাভাবিক নয়– সেটা তো আইএমএফের বোঝার কথা। মূল্যস্ফীতি কমাতেও সরকার কম সচেষ্ট নয়। আইএমএফ প্রস্তাবিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিও কিন্তু অনুসৃত হচ্ছে। ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা আনতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম উদ্যোগী নয়। তাহলে?
অতিসম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের মধ্যেও পাকিস্তানের জন্য ঋণের কিস্তি ছাড় করেছে আইএমএফ। ভারতের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এ ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। একই সময়ে আবার আইএমএফের প্রভাবশালী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতিতে এসেছে অগ্রগতি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পাকিস্তান ভালো করছে বলেই মনে করে আইএমএফ।
তবে কি বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দাবির সঙ্গে আইএমএফ একমত নয়? বাংলাদেশ কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বর্ধিত সহায়তাও চেয়ে বসে আছে সংস্থাটির কাছে। বাড়তি অর্থ সহায়তা চেয়ে তেমন সাড়া পাচ্ছে না বিশ্বব্যাংক, জাইকার কাছ থেকেও। বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি এবং অর্থ ছাড় হালে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলেও
খবরে প্রকাশ। সরকার অবশ্য বিদেশি দায়দেনা পরিশোধে বড় অগ্রগতি এনেছে। এতে বাংলাদেশের ওপর আস্থা বাড়বে।
ঋণের একটি-দুটি কিস্তি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পর সেটা অবশ্য কেটে যেতেও দেখা যায়। শ্রীলঙ্কার বেলায় এমনটি ঘটেছে। আমাদের ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে পারে।
হতে পারে গণতন্ত্রে উত্তরণের সঙ্গে বিষয়টি অনেকখানি সম্পর্কিত। এ বিষয়ে সরকারের এক ধরনের রোডম্যাপও রয়েছে। এমনও হতে পারে, জুনের শুরুতে বাজেট ঘোষণার আগে-পরে কিস্তিবিষয়ক সুখবরটি ঠিকই পাব আমরা। সবচেয়ে বড় কথা, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক