ফারাক্কা বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের ৬ কোটি মানুষ
Published: 15th, May 2025 GMT
পদ্মার উজানে ভারতের নির্মাণ করা ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৬ কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে আছেন উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২ কোটি এবং দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের ৪ কোটি মানুষ।
১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) রাজশাহীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
রাজশাহী মহানগরীর একটি রেস্তোরাঁয় এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির আহ্বায়ক ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। এ সময় ফারাক্কা লং মার্চের অংশগ্রহণকারী মাহমুদ জামাল কাদেরী উপস্থিত ছিলেন।
মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার প্রভাবে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টে পানিস্বল্পতার কারণে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে। এর ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে আসছে। বরেন্দ্র অঞ্চল, বিশেষ করে উচ্চ বরেন্দ্রের প্রায় শতভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। স্বাদু পানির অভাবে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ ষোল আনা সফল হয়েছিল। ফলে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফারাক্কা রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। দেশে জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি হয় এ ইস্যুকে ভিত্তি করে। এদিকে, ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে তৎকালীন ভারতীয় শাসকরা ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ উপযুক্ত পরিমাণ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল, যা সঠিকভাবেই কার্যকর ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী বছরের সব থেকে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কার প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। অপরদিকে ভারত পাবে ২০ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। কোনো কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে এলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লস।
১৯৭৭ সালের এ চুক্তির ফলে ভারত গঙ্গা নদীর আন্তর্জাতিক চরিত্রকে স্বীকার করে নেয়। ৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তিটি জাতিসংঘে অভিনন্দিত হয়েছিল। এরপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক বসেছে। বাংলাদেশ চেয়েছে এই যৌথ কমিশনে নেপালকে সম্পৃক্ত করতে। কিন্তু, ভারতীয় পক্ষের বৈরিতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবারই। ১৯৮২ সালে সেই ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি শেষ হলে বাংলাদেশ সেটি নবায়ন করতে চাইলেও ভারতের আপত্তির কারণে সম্ভব হয়নি। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর নয়াদিল্লীতে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে চুক্তি নবায়ন না হয়ে একটি সমঝোতা স্মারকপত্র সাক্ষরিত হয়। এ সমঝোতায় ১৯৭৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী পানি বণ্টনের ব্যবস্থা বহাল থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে ৮০ ভাগ পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ক্লস বাদ দেওয়া হয়। এর ফলে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৭ সালে চুক্তি নিয়ে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে নদী কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করে যৌথ নদী কমিশন গঠনের। কিন্তু, ১৯৮২ সালের সমঝোতা স্মারকে সেটিও বাদ দেওয়া হয়।
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, যতই দিন গড়াচ্ছে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলছে, আতঙ্কিত করছে। প্রতি বছরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার নিয়মিত ঘটনা। এর পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় শতাধিক নদ-নদী ক্রমান্বয়ে মৃত খালের রূপ নিচ্ছে। ইদানিং শুষ্ক মৌসুম শুরু হতে না হতেই গঙ্গা-পদ্মার প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমতে দেখা যাচ্ছে। গঙ্গা একটি মরা গাঙের রূপ নিয়েছে। গঙ্গার বুক চিরে চলাচল করছে বালুবাহী ট্রাক, গরু-মহিষের গাড়ি। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত গঙ্গা-পদ্মাসহ এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখার প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার নাব্য নৌপথ বন্ধ এবং অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যে সেচের জন্য গঙ্গার প্রায় ৪০০ পয়েন্ট থেকে অন্যায়ভাবে পানি সরিয়ে নিয়ে তাদের সেচ কাজে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে বৃহদাকারের তিনটি ক্যানাল প্রজেক্ট ভারত ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে। সেগুলো হলো-’আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ এবং ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’। গঙ্গার উজানে হরিদ্বারের সামান্য ভাটি থেকে উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, বিহার, ঝাড়খণ্ডের কিছু এলাকাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিশাল এলাকা জুড়ে গঙ্গা সিস্টেমের প্রবাহ থেকে এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে অন্যায়ভাবে ভাটির বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর শতভাগ দায় ভারতের।
রাজশাহীর মানুষ ফারাক্কার নেতিবাচক প্রভাবের সরাসরি শিকার, উল্লেখ করে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ৪০ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় গঙ্গার আয়তন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। পানির প্রবাহ কম থাকায় নদীর তলদেশ ক্রমান্বয়ে ভরাট হচ্ছে। জলজ প্রাণী, বিশেষ করে কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গঙ্গার ডলফিন ও ঘড়িয়াল আর দেখা যায় না। আগের মতো পদ্মায় ইলিশের ঝাঁক আর আসে না। মহাবিপর্যয়কর অবস্থায় গঙ্গা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য। নদীকেন্দ্রিক নানা ধরনের পেশা হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশের গঙ্গায় আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। দক্ষিণের সুন্দরবনে মিঠাপানির সরবরাহ কমেছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারিতে গঙ্গায় পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারিতে পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গঙ্গায় পানি প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক। যদিও সে বছর গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কম।
ফারাক্কা সমস্যা থেকে উত্তরণে কিছু করণীয়ও তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। বলা হয়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি এখনো বলবৎ। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে কি না এবং কতটুকু পানি পাচ্ছে, সেটি জনগণ অবহিত নয়। এখন থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনগণকে তা জানাতে বাধ্য থাকবেন। ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই শক্তিশালী কমিটির দ্বারা এর মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন চুক্তির জন্য হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর হোমওয়ার্ক করে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি। নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের চুক্তির অনরূপ গ্যারান্টি ক্লস অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়ম অনুযায়ী যথাসময়ে বৈঠক করতে হবে। সরকারিভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি, যা মোটেই নির্ভুল নয়। প্রকৃত সংখ্যা এর প্রায় তিন গুণের বেশি। বাংলাদেশের স্বার্থে অনতিবিলম্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে সরেজমিন পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নতুন করে তালিকা করে ভারতকে অবহিত করা সময়ের দাবি।
ভারত ইতোমধ্যেই একতরফাভাবে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করেছে, যার বিরূপ প্রভাব ভাটির বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। পানি প্রত্যাহারে সৃষ্ট প্রভাব নিরূপণে পানিসম্পদ, কৃষি, পরিবেশ, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে একটি দলিল প্রণয়ন করবে। প্রয়োজনে ভারত কর্তৃক নদী আইন লংঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
অভিন্ন নদীর পানি সমস্যা শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক নদীর পানি সুষ্ঠু ব্যবহারের স্বার্থে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, চীন, ভুটান ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম বা নদী কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশন এ অঞ্চলের নদী অববাহিকাতে পানির সুষম বণ্টন, পরিবেশ সংরক্ষণসহ নদী তীরবর্তী জনপদগুলোর আর্থিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সমস্যা সমাধানে ভারতকে প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যেন শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ সচল থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্যের প্রয়োজন। ভারত বাংলাদেশের ন্যায্য আহ্বানে সাড়া না দিলে এ দেশের মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার স্বার্থে শক্তিশালী বন্ধু দেশের পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণে সচেষ্ট হতে হবে। গঙ্গা, তিস্তা ও বরাকসহ সকল অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে এখন অবধি বাংলাদেশের আর্থিক কত ক্ষতি হয়েছে, তা বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা নিরূপণ করে ভারতের কাছে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে।
মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার সমস্যার সমাধানে করণীয় বিষয়ে দ্রুতই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার সঙ্গে বসবেন।
ঢাকা/কেয়া/রফিক
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম হব ব স দ দ ক নদ র প ন র প রব হ র পর ম ণ ত হয় ছ ল ক র যকর ক ত কর অন য য় সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
ফারাক্কা বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের ৬ কোটি মানুষ
পদ্মার উজানে ভারতের নির্মাণ করা ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৬ কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে আছেন উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২ কোটি এবং দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের ৪ কোটি মানুষ।
১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) রাজশাহীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
রাজশাহী মহানগরীর একটি রেস্তোরাঁয় এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির আহ্বায়ক ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। এ সময় ফারাক্কা লং মার্চের অংশগ্রহণকারী মাহমুদ জামাল কাদেরী উপস্থিত ছিলেন।
মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার প্রভাবে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টে পানিস্বল্পতার কারণে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে। এর ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে আসছে। বরেন্দ্র অঞ্চল, বিশেষ করে উচ্চ বরেন্দ্রের প্রায় শতভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। স্বাদু পানির অভাবে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ ষোল আনা সফল হয়েছিল। ফলে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফারাক্কা রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। দেশে জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি হয় এ ইস্যুকে ভিত্তি করে। এদিকে, ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে তৎকালীন ভারতীয় শাসকরা ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ উপযুক্ত পরিমাণ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল, যা সঠিকভাবেই কার্যকর ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী বছরের সব থেকে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কার প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। অপরদিকে ভারত পাবে ২০ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। কোনো কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে এলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লস।
১৯৭৭ সালের এ চুক্তির ফলে ভারত গঙ্গা নদীর আন্তর্জাতিক চরিত্রকে স্বীকার করে নেয়। ৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তিটি জাতিসংঘে অভিনন্দিত হয়েছিল। এরপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক বসেছে। বাংলাদেশ চেয়েছে এই যৌথ কমিশনে নেপালকে সম্পৃক্ত করতে। কিন্তু, ভারতীয় পক্ষের বৈরিতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবারই। ১৯৮২ সালে সেই ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি শেষ হলে বাংলাদেশ সেটি নবায়ন করতে চাইলেও ভারতের আপত্তির কারণে সম্ভব হয়নি। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর নয়াদিল্লীতে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে চুক্তি নবায়ন না হয়ে একটি সমঝোতা স্মারকপত্র সাক্ষরিত হয়। এ সমঝোতায় ১৯৭৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী পানি বণ্টনের ব্যবস্থা বহাল থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে ৮০ ভাগ পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ক্লস বাদ দেওয়া হয়। এর ফলে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৭ সালে চুক্তি নিয়ে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে নদী কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করে যৌথ নদী কমিশন গঠনের। কিন্তু, ১৯৮২ সালের সমঝোতা স্মারকে সেটিও বাদ দেওয়া হয়।
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, যতই দিন গড়াচ্ছে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলছে, আতঙ্কিত করছে। প্রতি বছরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার নিয়মিত ঘটনা। এর পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় শতাধিক নদ-নদী ক্রমান্বয়ে মৃত খালের রূপ নিচ্ছে। ইদানিং শুষ্ক মৌসুম শুরু হতে না হতেই গঙ্গা-পদ্মার প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমতে দেখা যাচ্ছে। গঙ্গা একটি মরা গাঙের রূপ নিয়েছে। গঙ্গার বুক চিরে চলাচল করছে বালুবাহী ট্রাক, গরু-মহিষের গাড়ি। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত গঙ্গা-পদ্মাসহ এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখার প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার নাব্য নৌপথ বন্ধ এবং অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যে সেচের জন্য গঙ্গার প্রায় ৪০০ পয়েন্ট থেকে অন্যায়ভাবে পানি সরিয়ে নিয়ে তাদের সেচ কাজে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে বৃহদাকারের তিনটি ক্যানাল প্রজেক্ট ভারত ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে। সেগুলো হলো-’আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ এবং ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’। গঙ্গার উজানে হরিদ্বারের সামান্য ভাটি থেকে উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, বিহার, ঝাড়খণ্ডের কিছু এলাকাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিশাল এলাকা জুড়ে গঙ্গা সিস্টেমের প্রবাহ থেকে এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে অন্যায়ভাবে ভাটির বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর শতভাগ দায় ভারতের।
রাজশাহীর মানুষ ফারাক্কার নেতিবাচক প্রভাবের সরাসরি শিকার, উল্লেখ করে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ৪০ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় গঙ্গার আয়তন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। পানির প্রবাহ কম থাকায় নদীর তলদেশ ক্রমান্বয়ে ভরাট হচ্ছে। জলজ প্রাণী, বিশেষ করে কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গঙ্গার ডলফিন ও ঘড়িয়াল আর দেখা যায় না। আগের মতো পদ্মায় ইলিশের ঝাঁক আর আসে না। মহাবিপর্যয়কর অবস্থায় গঙ্গা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য। নদীকেন্দ্রিক নানা ধরনের পেশা হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশের গঙ্গায় আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। দক্ষিণের সুন্দরবনে মিঠাপানির সরবরাহ কমেছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারিতে গঙ্গায় পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারিতে পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গঙ্গায় পানি প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক। যদিও সে বছর গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কম।
ফারাক্কা সমস্যা থেকে উত্তরণে কিছু করণীয়ও তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। বলা হয়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি এখনো বলবৎ। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে কি না এবং কতটুকু পানি পাচ্ছে, সেটি জনগণ অবহিত নয়। এখন থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনগণকে তা জানাতে বাধ্য থাকবেন। ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই শক্তিশালী কমিটির দ্বারা এর মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন চুক্তির জন্য হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর হোমওয়ার্ক করে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি। নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের চুক্তির অনরূপ গ্যারান্টি ক্লস অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়ম অনুযায়ী যথাসময়ে বৈঠক করতে হবে। সরকারিভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি, যা মোটেই নির্ভুল নয়। প্রকৃত সংখ্যা এর প্রায় তিন গুণের বেশি। বাংলাদেশের স্বার্থে অনতিবিলম্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে সরেজমিন পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নতুন করে তালিকা করে ভারতকে অবহিত করা সময়ের দাবি।
ভারত ইতোমধ্যেই একতরফাভাবে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করেছে, যার বিরূপ প্রভাব ভাটির বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। পানি প্রত্যাহারে সৃষ্ট প্রভাব নিরূপণে পানিসম্পদ, কৃষি, পরিবেশ, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে একটি দলিল প্রণয়ন করবে। প্রয়োজনে ভারত কর্তৃক নদী আইন লংঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
অভিন্ন নদীর পানি সমস্যা শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক নদীর পানি সুষ্ঠু ব্যবহারের স্বার্থে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, চীন, ভুটান ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম বা নদী কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশন এ অঞ্চলের নদী অববাহিকাতে পানির সুষম বণ্টন, পরিবেশ সংরক্ষণসহ নদী তীরবর্তী জনপদগুলোর আর্থিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সমস্যা সমাধানে ভারতকে প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যেন শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ সচল থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্যের প্রয়োজন। ভারত বাংলাদেশের ন্যায্য আহ্বানে সাড়া না দিলে এ দেশের মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার স্বার্থে শক্তিশালী বন্ধু দেশের পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণে সচেষ্ট হতে হবে। গঙ্গা, তিস্তা ও বরাকসহ সকল অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে এখন অবধি বাংলাদেশের আর্থিক কত ক্ষতি হয়েছে, তা বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা নিরূপণ করে ভারতের কাছে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে।
মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার সমস্যার সমাধানে করণীয় বিষয়ে দ্রুতই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার সঙ্গে বসবেন।
ঢাকা/কেয়া/রফিক