মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অবসর নেওয়ায় ওয়ানডে দলে পরিবর্তনটা অনিবার্যই ছিল। মিডলঅর্ডারে জাকের আলী ও শামীম হোসেন পাটোয়ারি আগে থেকেই দুই সিনিয়রের জায়গা ‘বুকিং’ দিয়ে রেখেছিলেন। তারা দু’জনই আছেন শ্রীলঙ্কা সফরের দলে। 

তবে ওলটপালট হয়েছে ওপেনিং স্লটে। চোট ও ইনটেন্টের কথা বলে নেওয়া হয়নি সৌম্য সরকারকে। তাঁর জায়গায় সুযোগ দেওয়া হয়েছে ঢাকা লিগে ভালো করা নাঈম শেখকে। প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর ভাষায় নাঈমের ‘ইনটেন্ট’ দেখে ভালো লেগেছে তাদের। যদিও নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে সিলেটে খেলা তিনটি ৫০ ওভারের ম্যাচে ১৮, ৪০ ও ৪ রান করা নাঈমের ব্যাটিংয়ের ইনটেন্ট ও ইমপ্যাক্টের ব্যাখ্যা দিতে পারেননি লিপু। 

সোমবার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ঘোষিত ১৬ জনের স্কোয়াডের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রধান নির্বাচক মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের জাতীয় দলে ক্যারিয়ারের শেষই বলে দেন পরোক্ষে। ঢাকা লিগের সেরা খেলোয়াড় মোসাদ্দেক সব্যসাচী পারফরমার। মিডলঅর্ডারে ফিনিশার রোলে ভালো করা ২৯ বছর বয়সী এ ক্রিকেটারের বোলিংটাও কার্যকর। চার টেস্ট, ৪৩ ওয়ানডে ও ৩৩টি টি২০ খেলা মোসাদ্দেক ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দলে থাকার দাবি জোরালো করলেও নির্বাচক প্যানেলের কাছে উপেক্ষিত। 

অথচ তিনি মাহমুদউল্লাহর জায়গায় ভালোভাবেই বিবেচনায় থাকতে পারতেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁকে না নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিপু বলেন, ‘আপনার কথার সরাসরি উত্তর দিতে চাই। আপনি আপনার সাংবাদিকতার আলোকে মনে করছেন যে মোসাদ্দেক হোসেন এই মুহূর্তে জাতীয় দলে খেলা উচিত। আমি ঠিক সেই জিনিসটা মনে করছি না। পরিষ্কারভাবে বলতে চাচ্ছি, যতক্ষণ মেহেদী হাসান মিরাজ আছে, মোসাদ্দেকের কোনো সুযোগ নেই। কোনো জিনিস খুব স্পষ্টভাবে হওয়া উচিত। আপনারা বুঝে অনেক সময় না বোঝার ভান করে কথা বলেন, এটা পীড়াদায়ক।’ 

মিরাজ-মোসাদ্দেক একই ঘরানার বোলিং অলরাউন্ডার। তবে ওয়ানডে দলে যোগ হওয়ার পর থেকে নিজেকে শানিত করতে পেরেছেন মিরাজ। বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিং ভালো করে প্রমোশন পেয়েছেন চার নম্বরে। সেক্ষেত্রে সাত নম্বরে মোসাদ্দেককে নেওয়া হলে ব্যাটিংয়ের সঙ্গে বোলিংটা দলের জন্য বোনাস হতে পারত। সেখানে লিপু স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন মোসাদ্দেকের ঠিকানা জাতীয় দল নয়। প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় দলে না নিলে বাংলাদেশ টাইগার্স বা ‘এ’ দলে নেওয়া কেন? নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে কেন তাঁকে রাখা হয়েছে? 

একজনের লিগের পারফরম্যান্স জাতীয় দলের জন্য বিবেচিত না হলেও অন্যজনেরটা গ্রহণীয়। তিনি হলেন ওপেনিং ব্যাটার নাঈম শেখ। লিগ ম্যাচে তাঁর ইনটেন্ট দেখে মুগ্ধ প্রধান নির্বাচক। যদিও ‘এ’ দলের সিরিজে ইনটেন্ট ব্যাটিং করতে পারেননি তিনি। 

বাঁহাতি এ ওপেনারকে নেওয়ার পেছনে লিপুর ব্যাখ্যা, ‘দল নির্বাচনের আগে এই মুহূর্তে আমরা নির্বাচকরা একটা বেস্ট পসিবল কম্বিনেশনের কথা ভাবি। সেটা ভাবার সময় ওপেনারের জায়গা তো একটা স্পেশালিস্ট জায়গা। তখন একজন বিকল্প ওপেনারের কথা চিন্তা করতে হয়। দলে তো ওপেনার তিনজন সাধারণত থাকে। সেই আলোকে আমাদের যখন চিন্তা করতে হয়েছে, এই মুহূর্তে আমাদের তৃতীয় ওপেনার হিসেবে সবচেয়ে ভালো এবং অ্যাভেইলেবল আছে, সেই আলোকেই নাঈম শেখ এসেছে দলে।’ 

সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে সুযোগ দেওয়ায় সৌম্য সরকারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পুনর্জীবন পায় ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সফর দিয়ে। গত বছর গ্লোবাল টি২০ লিগে রংপুর রাইডার্সের হয়ে ভালো খেলে জায়গা করে নেন টি২০ দলে। চোটের কারণে সম্প্রতি নিয়মিত খেলতে না পারা সৌম্যকে নেওয়া হয়নি। নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে ভালো খেলেও নির্বাচকদের মন জয় করতে পারেননি নুরুল হাসান সোহান। 

জাতীয় দলে সুযোগ না পাওয়া সৌম্য-সোহান খেলবেন গ্লোবাল টি২০ লিগে। পরিবর্তনের স্কোয়াডে প্রথম সুযোগ পেয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম। বাদ পড়েছেন আরেক বাঁহাতি নাসুম আহমেদ। গোড়ালির চোট পুনর্বাসন করে দলে ফিরেছেন পেসার তাসকিন আহমেদ। ওয়ানডে দলের ক্রিকেটাররা শ্রীলঙ্কা যাবেন ২৭ জুন। ২, ৫ ও ৮ জুলাই কলম্বো ও ক্যান্ডিতে হবে তিন ম্যাচের সিরিজ।  

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য় দল ইনট ন ট

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে 

পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।

শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্‌ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।

১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। 

একনজরে জয়দেব

চারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।

ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। 

পাহাড় আর ঝিরির পথে পথে

খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।

জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে। 

সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে। 

জয়দেব রোয়াজা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে