অনেকটা আকস্মিকভাবে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত সোমবার রাতে কাতার ও ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি এ ঘোষণা দেন। তবে ঘোষণার পরপরই ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তোলে। ইসরায়েল হামলা চালিয়ে ইরানের একজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে সপরিবারে হত্যা করে। জবাবে ইরান ইসরায়েলের টেক সিটি বিরশেবাতে হামলা চালায়। এতে নিহত হন চারজন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে জানান, ‘যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর হয়েছে। দয়া করে কেউ এটি লঙ্ঘন করবেন না।’ বিবিসির খবরে বলা হয়, এর আগে ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি জানান, সামরিক অভিযান বন্ধে কোনো চুক্তি হয়নি। তবে ইসরায়েল ইরানের জনগণের বিরুদ্ধে তাদের অবৈধ হামলা বন্ধ রাখলে পাল্টা হামলা চালানোর কোনো ইচ্ছা নেই। পরে একই কথা বলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। 

পরে ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে আবারও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্মানের। সমস্ত পারমাণবিক স্থাপনা ও সক্ষমতা ধ্বংস করা আমার জন্য বিরাট সম্মানের ছিল। তারপরও যুদ্ধ বন্ধ করুন। গতকাল হেগে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়ার পথে তিনি ওই পোস্ট করেন। তাতে তিনি আবারও বলেন, ইসরায়েল-ইরান উভয়েই সমানভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিল।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বস্তি নিয়ে এলেও এক ধরনের সন্দেহ-উদ্বেগ রয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সংঘাতে যুদ্ধবিরতি ভেঙে হামলা চালানোর নজির আছে তেল আবিবের।

বিরশেবায় ইরানের হামলায় হতাহতের ঘটনার পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ কঠোর হামলার হুঁশিয়ারি দেন। তবে ট্রাম্প তাঁকে হামলা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। যুদ্ধবিরতি মানার পক্ষে কথা বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান কাজা কালাস দুই পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। আলজাজিরা জানায়, গতকাল মঙ্গলবার ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় ব্যাবোলসার শহরে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। ইরানের প্রেস টিভি জানায়, যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। একই তথ্য দিয়েছে ইসরায়েলের চ্যানেল টুয়েলভ ও ওয়াইনেট।

ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির তাঁর বাহিনীকে সতর্ক করেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান এখনও শেষ হয়নি। তিনি বলেন, আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ করেছি, কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান এখনও শেষ হয়নি। 

ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কি আদৌ ইসরায়েল মেনে নেবে– এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। কাতারের হামাদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটির গণনীতিবিষয়ক অধ্যাপক সুলতান বারাকাত বলেন, তিনি মনে করেন, ট্রাম্পকে তাঁর হিসাবনিকাশ আবার ঠিক করতে হবে। ট্রাম্প হয়তো মনে করছেন, দু’পক্ষকেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। পরিস্থিতিকে নিজ স্বার্থে অন্যদিকে নেওয়ার সামর্থ্য আছে নেতানিয়াহুর। বারাকাত বলেন, ইরানের শাসন ক্ষমতার পরিবর্তনে বড় চেষ্টা ছাড়াই শত্রুতার সমাপ্তি ঘটাবে ইসরায়েল– এমন সম্ভাবনা তিনি কম দেখছেন।

এদিকে, ইরানে ট্রাম্পের হামলার বিপক্ষে অধিকাংশ মার্কিনি। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত সিএনএনের এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৪৪ থেকে ৫৬ শতাংশ মার্কিনি এ হামলার বিরুদ্ধে বলেছেন। যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়ে রাশিয়া বলেছে, তাদের প্রত্যাশা, এটি ‘টেকসই’ হবে।

এদিকে কাতার ও ইরাকের ঘাঁটিতে হামলার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ট্রাম্প। সিএনএন জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইরানের সরকারি প্রেস টিভি জানিয়েছে, ইরানিরা গণসমাবেশের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি উদযাপন করেছে। রাজধানী তেহরানে গতকাল হাজার হাজার মানুষ বিজয় সমাবেশে জড়ো হয়। দেশজুড়ে সর্বস্তরের মানুষ উদযাপনে যোগ দেয়। 

ইরানের হামলা

নতুন করে গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলের টেক সিটি বা প্রযুক্তির শহর বিরশেবাতে হামলা চালায় ইরান। এতে একটি আবাসিক ভবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, হামলায় এক সেনাসহ চারজন নিহত হয়েছেন। এর আগে ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে ২৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। এতে নিহত বেড়ে ২৮-এ পৌঁছেছে। আহত হয়েছে আট শতাধিক নাগরিক। 

ইসরায়েলের হামলা

ইরানে গতকাল মঙ্গলবারও হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে এক পরমাণু বিজ্ঞানী ও তাঁর পরিবারের সাত সদস্য নিহত হয়েছেন। ইরানের রাজধানী তেহরানে সড়কের পাশে হামলায় পরমাণু বিজ্ঞানী সেদিঘ সাবের নিহত হন। আলজাজিরা জানায়, আগের দিন সোমবার ইসরায়েলের হামলায় ইরানের এক পুলিশ কর্মকর্তা ও আইআরজিসির গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে মোট নিহতের সংখ্যা ৬১০ বলে জানানো হয়েছে। আহত হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৬ জন। 

ইসরায়েল আগে হামলা না করলে ইরানও করবে না: পেজেশকিয়ান

ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি মানলে ইরানও তা মেনে চলবে বলে জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। ইরানের সংবাদমাধ্যম নুর নিউজকে তিনি বলেন, ইরান যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে, যতক্ষণ ইসরায়েল তা মেনে চলে। ইরান সংলাপের জন্য প্রস্তুত। তেহরান আলোচনার টেবিলে বসেই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে।

সব লক্ষ্য পূরণের পরই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত ইসরায়েল: সরকারের বিবৃতি 

ইসরায়েলের সরকার বলেছে, ইরানে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে নিজেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন হওয়ার পরই দেশটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে এমন দাবি করেছে ইসরায়েল সরকার। বিবিসি জানায়, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ‘দ্বিমুখী হুমকি’ দূর করেছে বলে ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়। ইসরায়েল ইরানের সামরিক নেতৃত্বকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দেশটির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা ধ্বংস করেছে। প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা ও ইরানের পারমাণবিক হুমকি থামাতে সহযোগিতার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানায় ইসরায়েল। 

বিবৃতির বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানায়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও মোসাদের প্রধানের সঙ্গে সোমবার রাতে আলোচনা করেন। মন্ত্রিসভার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে তাঁর। সেখানে বলা হয়, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এ সব লক্ষ্য পূরণ হয়েছে ইসরায়েলের। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি কিছু অর্জন হয়েছে। বিবৃতিতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী তেহরানের আকাশসীমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে দাবি করে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনে উপযুক্ত জবাবের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

ইসরায়েল, ওই বোমাগুলো ফেলো না: ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে বোমা ফেলতে ইসরায়েলকে নিষেধ করেছেন। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। এএফপি জানায়, এ উত্তেজনা নিরসনে ইসরায়েলকে ইরানে বোমা হামলা থেকে বিরত থাকতে বলেন ট্রাম্প। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, ‘ইসরায়েল, ওই বোমাগুলো ফেলো না। তুমি যদি এটা করো, তা হবে (যুদ্ধবিরতি) বড় ধরনের লঙ্ঘন। পাইলটদের এখনই ঘরে ফেরাও!’

পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর ফোনালাপ হয়েছে। এর পরই তিনি ‘নতুন করে কোনো হামলা চালানো থেকে বিরত আছেন’।

এর আগে আলজাজিরার যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি ফিল লাভেল জানান, ইরানে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ‘অত্যন্ত বিরক্ত’ হন। সম্ভবত তিনি মনে করছেন, নেতানিয়াহু ‘বিশ্বাস ভঙ্গ’ করছেন। ইউরোপে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প জানান, যুদ্ধবিরতির শর্ত ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা লঙ্ঘন করায় তিনি ইসরায়েল ও ইরান– উভয় পক্ষের প্রতিই ক্ষুব্ধ। লাভেল বলেন, ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইরান– উভয়ের ওপরেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তবে তাঁর অতিরিক্ত রাগটা যে ইসরায়েলের দিকে ছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।

মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক ৬

ইসরায়েলের মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি সন্দেহে ইরানে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। দেশটির পশ্চিমাঞ্চল হামেদান প্রদেশে তাদের আটক করা হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) স্থানীয় কর্মকর্তা আলী আকবর করিমপোর বলেন, হামেদান, রেজান ও নাহাভান্দ থেকে ‘বিশ্বাসঘাতকদের’ আটক করা হয়েছে। তারা অনলাইনে বিভিন্নজনকে লক্ষ্যবস্তু করে কাজ করতেন। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, ইরানের শাসন ব্যবস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। 
 


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র র সরক র আলজ জ র সরক র র মন ত র লক ষ য র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

শুল্ক থেকে কত রাজস্ব পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কী হবে সেই অর্থ দিয়ে

এমন কোনো দিন নেই, যেদিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গর্ব করে বলেন না—তিনি প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় করছে।

প্রচুর অর্থ আসছে—দেশের ইতিহাসে এত অর্থ আগে কখনো আসেনি, শুক্রবার শুল্ক রাজস্বের প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

সিএনএনের সংবাদে বলা হয়েছে, ট্রাম্প ভুল বলছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই মাসে মার্কিন সরকার প্রায় ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার শুল্ক রাজস্ব সংগ্রহ করেছে; গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় যা ২৪২ শতাংশ বেশি।

এপ্রিল মাসে প্রায় সব ধরনের পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। পাশাপাশি পরবর্তী মাসগুলোতে আরও কিছু উচ্চ শুল্ক কার্যকর হয়। বাস্তবতা হলো, তখন থেকে জুলাই পর্যন্ত সরকার মোট ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার শুল্ক রাজস্ব সংগ্রহ করেছে—গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি। প্রশ্ন হলো—এই বিপুল অর্থ সরকার কোথায় ব্যয় করছে?

ট্রাম্প দুটি সম্ভাবনার কথা বলেছেন। প্রথমত, সরকারের লাখ লাখ কোটি ডলারের ঋণ শোধ করা ও আমেরিকানদের হাতে ‘ট্যারিফ রিবেট চেক’ বা শুল্কছাড়ের চেক (শুল্ক রাজস্ব সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া) তুলে দেওয়া।

গত মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেন, তিনি যা করছেন তার মূল উদ্দেশ্য ঋণ শোধ করা; অঙ্কের দিক থেকে তা বেশ বড়ই হবে। কিন্তু তাঁর মনে হয়, এত বেশি অর্থ আসছে যে মানুষকে হয়তো লভ্যাংশ দেওয়া যাবে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত দুটোর কোনোটি-ই ঘটেনি। অনেক আমেরিকানের মনে হতে পারে, বিদেশি পণ্য আমদানির প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে গিয়ে যে অর্থ মূলত মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর পকেট থেকে বেরোচ্ছে, সেই শত শত কোটি ডলার শুল্ক রাজস্বের গায়ে হয়তো শুধু ধুলো জমছে।

সরকার যে রাজস্ব সংগ্রহ করে—তা হোক সাধারণ কর থেকে কিংবা শুল্ক থেকে—সবই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগের নিয়ন্ত্রিত সাধারণ তহবিলে জমা হয়। তারা এই তহবিলকে বলে ‘আমেরিকার চেকবই’, কারণ, সেখান থেকেই সরকারের খরচ মেটানো হয়, যেমন কর ফেরত দেওয়া।

যখন রাজস্বের পরিমাণ সরকারের খরচের চেয়ে কম হয়, অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সরকার ঋণ নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে। বর্তমান সরকারের ওপর মোট ঋণের পরিমাণ ৩৬ ট্রিলিয়ন বা ৩৬ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি। এই ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে বলছেন, এই ঋণের বোঝা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দিচ্ছে।

যেভাবে একজন সাধারণ আমেরিকান ঋণ নিলে সুদ দেন, সেভাবে সরকারকেও ঋণের ওপর সুদ দিতে হয়। যত বেশি ঋণ, তত বেশি সুদ। ফলে মহাসড়ক উন্নয়ন বা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার মতেো অর্থে টান পড়ে।

বর্তমান অর্থবছরে মার্কিন সরকারের ১ দশশিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে এই শুল্ক রাজস্ব যথেষ্ট নয়। তবে এটাও সত্য, শুল্ক বাবদ প্রাপ্ত অর্থের কারণে ঘাটতির অঙ্ক কিছুটা কমেছে। অর্থাৎ শুল্ক রাজস্ব না থাকলে যতটা ঋণ নিতে হতো, এখন সরকারকে ততটা নিতে হচ্ছে না।

ডয়েচে ব্যাংকের সিনিয়র মার্কিন অর্থনীতিবিদ ব্রেট রায়ান বলেন, এই অর্থের আরও ভালো ব্যবহারের সুযোগ আছে, বিষয়টি এমন নয়। বাজেট ল্যাব অ্যাট ইয়েলের পরিচালক ও বাইডেনের হোয়াইট হাউসের সাবেক অর্থনীতিবিদ আর্নি টেডেস্কির মতে, যদি কংগ্রেস ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে শুল্ক রাজস্ব ‘রিবেট চেক’ আকারে জনগণকে ফেরত দেয়, তাহলে ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে।

বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে রিপাবলিকান সিনেটর জশ হাওলি বিল পেশ করেছেন। তিনি বলেন, এটা এখন অনুসরণ করার মতো নীতি নয়, বরং এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ বিষয়ে সিএনএনের প্রশ্নের জবাব দেয়নি হোয়াইট হাউস।

বুমেরাং হতে পারে

কাগজে-কলমে শুল্ক রাজস্বের কল্যাণে সরকারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলেও এর প্রভাব সব সময় ভালো হয় না। বেশির ভাগ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এখনো বাড়তি খরচ নিজেরা বহন করছে, দাম বাড়াচ্ছে না। সব ব্যবসার ক্ষেত্রে তা আবার প্রযোজ্য নয়। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি, খেলনা, ভোক্তা ইলেকট্রনিকসের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতিবিষয়ক মার্কিন সরকারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে তা দেখা গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন ওয়ালমার্ট ও প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, আরও দাম বৃদ্ধির সতর্কতা দিয়েছে।

শুল্কসংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। ফলে চাকরির সুযোগ কমছে—এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে বেশ কিছু অর্থনৈতিক জরিপ।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ‘শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ ইয়েল বাজেট ল্যাবের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাবে এ বছর ও আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আধা শতাংশ কমে যাবে।

এতে শুল্ক রাজস্বের একটি অংশ হারিয়ে যাবে; কেননা, যদি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কম গতিতে হয়, তাহলে শুল্ক রাজস্ব থাকলেও আয়কর ও বেতন কর থেকে পাওয়া অর্থ কমে যাবে।

ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখছে। তাঁদের যুক্তি, সদ্য কার্যকর হওয়া বিশাল কর ছাড় ও ব্যয় বিলের সঙ্গে শুল্ক রাজস্ব মিলিয়ে মার্কিন অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সময়ের পরিক্রমায় তা হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ