আজ আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস, অর্থাৎ মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ তারিখে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতিবছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস (মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস) পালন করা হবে। ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমস (ইউএনওডিসি) জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় অবৈধ মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেয়।

ইউএনওডিসি ১৯৯৭ সালে গঠিত হয়েছিল এবং সারা বিশ্বে এর অফিস রয়েছে। ২০১৬ সালে সাধারণ পরিষদে মাদকসংক্রান্ত একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাদকের অপব্যবহার এবং আসক্তি মানুষের জীবনে এবং সামাজিক শান্তি, উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধির ওপর যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, তা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ২৬ জুন দিবসটি পালিত হয়। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বকে মাদকমুক্ত করে তোলা।

এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো:

১.

সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সহযোগিতা: জাতিসংঘ বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্রকে মাদক সমস্যা মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে।

২. সচেতনতা বৃদ্ধি: জাতিসংঘ বিভিন্ন প্রচার ও শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করে।

৩. মাদকবিরোধী তহবিল: মাদক সমস্যা মোকাবিলায় জাতিসংঘ একটি তহবিল গঠন করেছে, যা মাদকবিরোধী কার্যক্রম এবং গবেষণার জন্য অর্থায়ন করে।

জাতিসংঘের এই উদ্যোগগুলো মাদক সমস্যা সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করে। মাদক বা নেশা উদ্রেককারী পদার্থগুলোকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

১. অবসাদকারক (ডিপ্রেশান্ট): মরফিন, হেরোইন।

২. উদ্দীপনকারক (স্টিমুল্যান্ট) : অ্যাম্পেটামিন, ক্যাফেইন।

নেশা উদ্রেককারী পদার্থগুলো স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকলাপ ব্যাহত করে। ফলে মানবদেহে নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে। যার ফলাফল দাঁড়ায় অকালমৃত্যু।

বাংলাদেশে মাদকের প্রচলন আলোচনা করতে হলে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত গাঁজাসহ বিভিন্ন রকমের মদ ছিল সাধারণ মাদক। রাজস্ব আদায়ে সরকারি নিবন্ধিত দোকানেও বিক্রি হতো গাঁজা ও আফিম।

আশির দশকের শেষ দিকে গাঁজা নিষিদ্ধ হলে এর জায়গা দখল করে হেরোইন। তবে নিষিদ্ধ হওয়ার পর গাঁজার বাজার আরও বড় হয়। কয়েক বছর পর কাশির ওষুধ হিসেবে পরিচিত ফেনসিডিল বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পায়, যা ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। ২০০০ সাল পর্যন্ত ফেনসিডিল ছিল সবচেয়ে প্রচলিত মাদক। পরবর্তী সময়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। ফেনসিডিল ও হেরোইনের জায়গা নেয় ইনজেকশন জাতীয় মাদক।

২০০০ সালের পর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে সিনথেটিক ড্রাগ। ২০০৫ সালের পর তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সস্তা মাদক হিসেবে ড্যান্ডির প্রচলন বাড়ে। এটি বেশি সেবন করে পথশিশুরা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিস্টাল মেথ, এলএসডি, ডিওবি, এমডিএমের মতো মাদক শহরের তরুণেরা সেবন করছে। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম এসব মাদকের বিস্তার সহজ করেছে। এখন কিশোর ও শিশুদের মধ্যেও মাদক সেবনের প্রবণতা বেড়েছে।

২০২২ সালে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) একটি গবেষণায় বলা হয়, দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকে আসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশু ১০ বছর বয়সের আগেই মাদক সেবন করে। তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১.৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে। ড্যান্ডিতে আসক্ত ১৫.২ শতাংশ শিশু।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। এই শিশু–কিশোর ছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় ৭ মিলিয়নের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে যুক্ত। ৮০ শতাংশ মাদকাসক্ত কিশোর ও তরুণ বয়সী মানুষ।

বাংলাদেশে অবৈধভাবে মাদক প্রবেশের অঞ্চল ও রুটগুলো ছক আকারে দেওয়া হলো: (মাদক অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যমতে)

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলার ছকে বর্ণিত স্থানগুলো হতে মাদক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে এবং সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রির জন্য ছড়িয়ে দেয়। চাহিদা অনুযায়ী একেক ধরনের মাদক দেশের একেক স্থানে কমবেশি পাওয়া যায়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক মে ২০২৫ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে দেখা যায়, উত্তর–পূর্ব সীমান্তবর্তী জেলা এবং ত্রিপুরা সীমান্ত–সংলগ্ন জেলাগুলোতে ফেনসিডিলের চাহিদা সর্বোচ্চ। উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মাদকের তেমন চাহিদা না থাকলেও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী জেলাগুলোতে ইয়াবার চাহিদা রয়েছে।

রাজধানীসহ বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং অন্যান্য মাদকের চাহিদা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অনেক বেশি।

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মাদকের চোরাচালান এবং ব্যবহার পর্যায়ক্রমে নিয়ন্ত্রণ করে বন্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে মাদকবিরোধী গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, পাঠ্যপুস্তকে মাদকবিরোধী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

মাদকের চোরাচালান, পাচার প্রতিরোধ করতে হবে। পুলিশকে এ বিষয়ে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। গ্রাম ও থানা পর্যায়ে গ্রাম পুলিশ এবং আনসারকে মাদক বিক্রেতা ও সেবীদের তালিকা প্রস্তুত করার কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। মাদকবিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।

রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সেবাসমূহের সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিককে অবশ্যই গ্রামের ইউপি চেয়ারম্যান অথবা ক্ষেত্রবিশেষে কাউন্সিলরের নিকট হতে ‘মাদকমুক্ত ব্যক্তি’ সদনপত্র সংগ্রহের বিধান যুক্ত করা যেতে পারে। একইভাবে চারিত্রিক সনদপত্র প্রদানের ক্ষেত্রে সনদপত্র গ্রহণকারীকে অবশ্যই ‘মাদক সেবন এবং মাদকের ক্রয়/বিক্রয়ের সহিত জড়িত নহে’ মর্মে লিখিত প্রত্যয়নযুক্ত চারিত্রিক সনদপত্র প্রদানের বিধান করা যেতে পারে। যিনি এই সনদ প্রদান করবেন তিনি অবশ্যই দায়িত্ব নিয়ে উক্ত সনদপত্র প্রদান করবেন মর্মে প্রচলিত বিধান সংশোধন করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্র: ঢাকা পোস্ট, ২৬ জুলাই ২০২১; মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার–সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মহাসচিবের প্রতিবেদন, বিশ্ব মাদক প্রতিবেদন ২০০৭, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রকাশিত গবেষণাপত্র মে ২০২৫

মো. খালিদুল হক হাওলাদার পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি, র‍্যাবে কর্মরত

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ম ন তবর ত ম দকব র ধ সনদপত র প রক শ ত আসক ত পথশ শ

এছাড়াও পড়ুন:

বৃক্ষরোপণ পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কার পে‌লেন যার

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা ২০২৫ এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২৫ উপলক্ষ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কার ও চেক বিতরণ করা হ‌য়ে‌ছে।

বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পুরস্কার ২০২৫, জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার ২০২৪ এবং সামাজিক বনায়নে সর্বোচ্চ লভ্যাংশপ্রাপ্ত উপকারভোগীদের মাঝে পুরস্কার তু‌লে দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

জাতীয়ভাবে বন, প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে ২০১০ সাল থেকে চালু হওয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কারের ২০২৫ সালের চারজন বিজয়ীর মধ্যে রয়েছেন নাটোরের মো. ফজলে রাব্বী (ব্যক্তি পর্যায়), শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি (প্রতিষ্ঠান পর্যায়), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. মনোয়ার হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। প্রত্যেক পুরস্কারপ্রাপ্তকে ২২ ক্যারেট স্বর্ণপদক (দুই ভরি), এক লক্ষ টাকার চেক ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।

জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪ পেয়েছেন ব্যক্তি পর্যায়ে মো. মাহমুদুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী ও প্রফেসর ড. এম. ফিরোজ আহমেদ এবং প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে স্নোটেক্স আউটারওয়্যার লি:, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিটি পদকের সঙ্গে রয়েছে স্বর্ণের সমমূল্যের নগদ অর্থ, ৫০ হাজার টাকার চেক, একটি ক্রেস্ট ও সনদপত্র।

বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার ২০২৪-এর সাতটি শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারীদের মধ্যে রয়েছেন লালমনিরহাটের দলগ্রাম দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, মিজ দিলরুবা রহমান (টাঙ্গাইল), সোহেল নার্সারী (রংপুর), নাটরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ এবং বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট। পুরস্কারের অংশ হিসেবে প্রদান করা হয় সনদ, ক্রেস্ট ও এক লক্ষ, ৭৫ হাজার এবং ৫০ হাজার টাকার চেক।

এছাড়াও সামাজিক বনায়নে সর্বোচ্চ লভ্যাংশপ্রাপ্ত ১০ জন উপকারভোগীকে সম্মাননা হিসেবে চেক প্রদান করা হয়। এর মধ্যে মো. শাহাজ উদ্দিন পান ৬ লক্ষ ৭ হাজার ৯৫০টাকা, উকিল মুর্মু পান ৫ লক্ষ ৫৭ হাজার ৩২৫টাকা, মোসা: মনোয়ারা বেগম পান ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৭০০টাকা ।

এই সম্মাননা পরিবেশ ও প্রকৃতির সুরক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ ও উৎসাহকে আরও জোরদার করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

এসময় মঞ্চে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো: কামরুজ্জামান এনডিসি এবং বন অধিদপ্তরের সম্মানিত প্রধান বন সংরক্ষক জনাব মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রমুখ।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন// 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বৃক্ষরোপণ পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কার পে‌লেন যার