ভারতে ৮০ লাখ পুরুষকে বন্ধ্যাকরণ: ৫০ বছর পর এক গ্রামের কথা
Published: 26th, June 2025 GMT
যখন সবাই দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গলের দিকে, পাশের গ্রামগুলোতে বা নিজেদের আড়াল করতে পাতকুয়ায় ঝাঁপ দিচ্ছিল, তখন মোহাম্মদ দীনু বাড়িতে থেকে যান।
নভেম্বরের তীব্র শীতের রাতে পুলিশ ঘিরে ফেলে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের উত্তাওয়ার গ্রামটি। এটা রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে। পুলিশের কাছে আদেশ ছিল, সন্তান জন্মদানের উপযোগী সব পুরুষকে গ্রামের মাঠে জড়ো করতে হবে।
ভারত তখন প্রায় ১৭ মাস ধরে এক প্রকার স্বৈরশাসনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থার মধ্যে ছিল দেশ; নাগরিক স্বাধীনতা ছিল স্থগিত। হাজার হাজার রাজনৈতিক বিরোধীকে বিচার ছাড়াই বন্দি করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তায় ভারত জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণের এক ব্যাপক কর্মসূচিতে হাত দেয়।
ওই সময় দীনু ও তার ১৪ জন বন্ধু এই কর্মসূচির লক্ষ্য হয়ে ওঠেন। তাদের জোর করে বাহিনীর গাড়িতে তোলা হয় এবং নিয়ে যাওয়া হয় অব্যবস্থাপনায় চালিত বন্ধ্যাকরণ (খোঁজাকরণ বা নসবন্দি) ক্যাম্পে। দীনুর কাছে এটি ছিল একটি ‘ত্যাগ’।
মোহাম্মদ দীনু এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। বয়স ৯০ এর কোঠায়। একটা পায়া ভাঙা খাটে বসে দীনু স্মৃতিচারণ করে আলজাজিরাকে বলেন, “যখন সবাই নিজেদের বাঁচাতে পালাচ্ছিল, তখন গ্রামের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ বুঝতে পারেন, যদি কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে সেটা আরো বড় বা দীর্ঘমেয়াদি বিপদের কারণ হবে। তাই গ্রামের কিছু পুরুষকে জড়ো করে তুলে দেওয়া হয়।”
তিনি বলেন, “আমরা ত্যাগের মাধ্যমে এই গ্রামকে রক্ষা করেছি। চারদিকে দেখুন, এখন এই গ্রাম শিশুদের কোলাহলে ভরে আছে।”
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র যখন ২৫ জুন জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পূর্তি পালন করছে, তখন উত্তাওয়ারে সেই জোরপূর্বক খোঁজাকরণ বা নসবন্দি প্রকল্পের টার্গেট হওয়া দীনুই একমাত্র বেঁচে আছেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের অধীনে নেওয়া ওই পদক্ষেপ ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়।
ওই সময় জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত ৮০ লাখের বেশি পুরুষকে জোরপূর্বক নসবন্দি করা হয়। যার মধ্যে শুধু ১৯৭৬ সালেই ছিল ৬ লাখ। বন্ধ্যাকরণ অস্ত্রোপচারে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা যান। পাঁচ দশক পরও সেই ক্ষত উত্তাওয়ার গ্রাম তার বুকে আজও বয়ে চলছে।
‘একটি কবরস্থান, শুধুই নিস্তব্ধতা’
ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৫২ সালে ভারত বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে একটি জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করে। ওই প্রকল্পটি ছিল একটি উৎসাহমূলক প্রচেষ্টা। পরিবারগুলোকে দুটির বেশি সন্তান না নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতো।
তবে ১৯৬০ এর দশকে যখন প্রতি নারীর গড় সন্তান সংখ্যা প্রায় ৬ জনে দাঁড়ায়, তখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আরো আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। ভারতের দ্রুত বেড়ে চলা জনসংখ্যাকে অর্থনীতির জন্য বোঝা হিসেবে দেখা হয়।
পশ্চিমা বিশ্বের ভাবনাও একই ছিল। বিশ্বব্যাংক ভারতকে পুরুষ বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচির জন্য ৬৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের খাদ্য সহায়তা বজায় রাখার শর্ত বানায় ভারত সরকার তার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কতটা সফল হচ্ছে, সেটির ওপর।
জরুরি অবস্থার সময় সব গণতান্ত্রিক কাঠামো নিষ্ক্রিয় করা হয়। তখন সরকারি কর্মীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ও সাধারণ মানুষকে শাস্তির ভয়ে বাধ্য করে এই বন্ধ্যাকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট কোটা দেওয়া হয়েছিল, কতজনকে তারা বন্ধ্যাকরণ করাবে। যারা লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হতো, তাদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হতো কিংবা চাকরিচ্যুতির হুমকি দেওয়া হতো। যেসব গ্রাম এই কর্মসূচিতে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানাত, তাদের সেচের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হতো।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রতিরোধকারী জনগণের বিরুদ্ধে, যেমন উত্তাওয়ার গ্রামে, যেখানে অধিকাংশই মুসলিম। তখন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্মহার তুলনামূলক বেশি ছিল, ফলে তারা এই দমনমূলক বন্ধ্যাকরণ অভিযানের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
দীনুর বাড়ির পাশের গলিতে থাকেন মোহাম্মদ নূর। ওই সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর। ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে নূর জানান, একদিন ঘরের বাইরে পাতা চৌকিতে বাবার বাহুতে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিলেন। এমন সময় ঘোড়ায় চড়ে কিছু পুলিশ তাদের বাড়িতে হানা দেয়। তখন তার বাবা পাশের জঙ্গলের দিকে দৌড়ে পালান, আর নূর ঘরের ভেতরে যান।
নূর বলেন, “তারা দরজা ভেঙে ফেলল, যা কিছু সামনে পেল তা গুঁড়িয়ে দিল। আমাদের কষ্ট আরো বাড়াতে তারা ময়দায় বালি মিশিয়ে দিল। গ্রামে এমন একটি ঘরও ছিল না, যেখানে পরবর্তী চার দিন কোনো রান্না করা সম্ভব হয়েছিল।”
নূরকে সেই অভিযানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, থানায় মারধর করা হয় এবং পরে ছেড়ে দেওয়া হয়—কারণ তার বয়স ছিল ১৫ বছরের নিচে; যা বন্ধ্যাকরণের জন্য কম বয়স।
ভয়ের সেই রাত গ্রামের মানুষ এখনো স্মরণ করে। তারা ভোলেননি ওই সময় গ্রাম-প্রধান আবদুর রহমানের নেওয়া উদ্যোগকে।
নূরের শৈশবসাথী তাজামূল মোহাম্মদ এই বিষয়ে বলেন, “আমাদের গ্রামের বাইরে কেউ হয়তো তার (আবদুর রহমান) নাম জানে না কিন্তু আমরা জানি।”
তাজামূল বলেন, “উত্তাওয়ারে অভিযানের আগে বেশ কিছু কর্মকর্তা রহমানের কাছে এসে কিছু পুরুষকে ‘দিয়ে দিতে’ বলেন। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, ‘আমি কোনো পরিবারকে বিপদের মুখে ফেলতে পারি না।’ রহমান এমনকি আশেপাশের গ্রাম থেকে আশ্রয় নিতে আসা পুরুষদেরও তুলে দিতে রাজি হননি।”
“রহমান কর্মকর্তাদের বলেন, আমি আমার এলাকা থেকে একটি কুকুরও দেব না, আর তোমরা মানুষের দাবি করছো? কখনো না!”
তামাকের হুঁকায় টান দিতে দিতে নূর বলেন, “কিন্তু রহমানের এই দৃঢ়তা গ্রামকে রক্ষা করতে পারেনি। পুলিশি অভিযানের পর উত্তাওয়ার হয়ে পড়ে এক শোকগ্রস্ত গ্রাম। যারা পালিয়ে গিয়েছিল, কিংবা যাদের পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারা বহু দিনেও গ্রামে ফেরেনি।”
“উত্তাওয়ার হয়ে যায় কবরস্থান, শুধুই নিস্তব্ধতা।”
পরবর্তী বছরগুলোতে এর প্রভাব আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। আশেপাশের গ্রামগুলো উত্তাওারের পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। এমনকি যাদের বন্ধ্যাকরণ হয়নি, তাদের সঙ্গেও। এমনকি কিছু বিয়ে বাতিলও হয়ে যায়।
স্থানীয় সমাজকর্মী কাসেম বলেন, “কিছু মানুষ কখনোই মানসিকভাবে সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি, তারা বছরের পর বছর উদ্বিগ্ন বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় কাটিয়েছে। সামাজিক ট্যাবু আর চাপ তাদের শেষ করে দিয়েছে।”
আজকের ভারতেও সেই প্রতিধ্বনি
ভারতে এখন আর কোনো জোরপূর্বক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেই। দেশে গড় প্রজনন হার এখন নারীপ্রতি দুজনের একটু বেশি। তবু বিশেষজ্ঞদের মতে, জরুরি অবস্থার সময় যে ভয়ের পরিবেশ ও দমনমূলক মনোভাব গড়ে উঠেছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে তা আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনে জালিয়াতি ও সরকারি যন্ত্রের অপব্যবহার করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেন। ফলে তাকে ছয় বছরের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এই রায়ে তার প্রধানমন্ত্রীত্ব হুমকির মুখে পড়ে। ফলে নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
৭৫ বছর বয়সি খ্যাতনামা ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথনের মতে, জরুরি অবস্থা জারি হয় এক ধরনের কর্তৃত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যম।
বিশ্বনাথন বলেন, “এই জরুরি অবস্থাই ছিল কর্তৃত্ববাদের সাধারণীকরণ। আসলে এই জরুরি অবস্থাই আজকের ভারতের বিভিন্ন ‘জরুরি অবস্থার’ ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। এটা ছিল উত্তর-আধুনিক ভারতের ভিত্তি।”
ইন্দিরা গান্ধীর অনুগামীরা তাকে হিন্দু দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করতেন। এমনকি তারা বলতেন, দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’র উচ্চারণের সঙ্গেও মিল রয়েছে । ঠিক তেমন করে মোদির অনুগামীরা তাকে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গে তুলনা করেন।
বিশ্বনাথনের মতে, ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি ইন্দিরা গান্ধীর সময় যেভাবে বেড়েছিল, তাতে দেশের বিচারবোধ হারিয়ে যায়।
তিনি বলেন, “যদিও জরুরি অবস্থা ১৯৭৭ সালে প্রত্যাহার করা হয়, তবু দেশটি ধীরে ধীরে ছদ্মবেশী গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের দিকে এগিয়ে গেছে। ইন্দিরা গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদি- প্রত্যেকেই গণতন্ত্রের মুখোশ পরে কর্তৃত্ববাদী সমাজ গড়ে তুলেছেন।”
২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের গণতন্ত্র এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে অবনতি হয়েছে। রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ও সাংবাদিকদের কারাবন্দি করা, বাকস্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ, এসবই উদ্বেগের কারণ।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষাকারী সংগঠন ফ্রি স্পিচ কালেকটিভ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গীতা সেশু বলেন, “জরুরি অবস্থার সময় ও বর্তমান ভারতের মধ্যে একটি বড় মিল হলো, মূলধারার সংবাদমাধ্যমের মাথা নত করা।”
তিনি বলেন, “তখন এবং এখন— দুই সময়েই সাধারণ মানুষকে তথ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তখন নাগরিক অধিকার আইন দিয়ে স্থগিত হয়েছিল, আর এখন আইনকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভয় আর আত্মনিয়ন্ত্রণ তখন যেমন ছিল, আজও তা বিদ্যমান; যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অসীম আলী বলেন, “জরুরি অবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, ‘একটি শক্তিশালী ও দৃঢ় নেতৃত্বের মুখে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহজেই গলে যায়।”
ওই সময়ে জরুরি অবস্থার ফল ছিল ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় জনগণ।
অসীম আলী বলেন, “৭০ দশকের মতো মোদির শাসনামলের পর ভারতীয় গণতন্ত্র কী আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, তা এখনো দেখার বিষয়।”
সাত পুরুষ!
১৯৭৬ সালের নভেম্বরে পুলিশ যখন দীনুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি শুধু তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সেলিমার কথাই ভাবছিলেন। তিনি তখন বাড়িতেই ছিলেন।
ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করে দীনু বলেন, “অনেক অবিবাহিত বা নিঃসন্তান পুরুষ সেদিন পুলিশের কাছে কাকুতি-মিনতি করছিল মুক্তি দেওয়ার জন্য। আমার ১৪ জন বন্ধুর কাউকেই ছাড়া হয়নি সেদিন।”
তিনি বলেন, “নসবন্দি এমন এক অভিশাপ, যা উত্তাওয়ারকে তখন থেকে প্রতিটি রাত তাড়া করে বেড়াচ্ছে।”
পুলিশ হেফাজতে আট দিন থাকার পর দীনুকে নেওয়া হয় উত্তাওয়ারের কাছের শহর পালওয়ালের এক বন্ধ্যাকরণ ক্যাম্পে। যেখানে তার অস্ত্রোপচার করা হয়। নসবন্দি শেষে এক মাস পর তিনি বাড়ি ফেরেন। তখন সেলিমা তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান জন্ম দেন। এখন দীনুর তিন নাতি এবং বেশ কয়েকজন পুতনি রয়েছে।
হাসতে হাসতে দীনু বলেন, “এই গ্রামটাকে আমরাই রক্ষা করেছি। না হলে ইন্দিরা তো এই গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিতেন!”
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২০২৪ সালে দীনুর স্ত্রী মারা যান। আর দীনু শেষ জীবনে নাতি-পুতিদের সঙ্গে ভালোই আছেন।
প্লাস্টিকের পানির কাপে চুমুক দিতে দিতে তিনি বলেন, “সাত পুরুষ! তুমি এমন কয়জন মানুষ দেখেছ, যারা এই সৌভাগ্য উপভোগ করে?”
[লেখক পরিচিতি: যশরাজ শর্মা একজন তরুণ ও নির্ভীক সাংবাদিক, যিনি কাশ্মীরের বাস্তবতা ও প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ তুলে ধরতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি দ্য কাশ্মীর ওয়াল্লা-এর অন্তর্বর্তী সম্পাদক। স্বাধীন সাংবাদিকতায় সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০২২ সালে থমসন ফাউন্ডেশনের ইয়াং জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। যশরাজ শর্মার বিশেষ লেখাটি আলজাজিরা প্রকাশ করেছে ২৫ জুন। লেখাটি অনুবাদ করেছেন তানজিনা ইভা।]
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণতন ত র স ব ধ নত এই গ র ম র জন ত ক ম হ ম মদ অবস থ র ব যবস থ হয় ছ ল ইন দ র র জন য সরক র র সময় ই সময় রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বের সেরা কর্মস্থল হিলটন হোটেল, সেরা তালিকায় আছে মেটলাইফ
আধুনিক মানুষের দিনের বড় একটা সময় যায় কর্মস্থলে। ফলে সেই কর্মস্থলের পরিবেশ কেমন, কর্তৃপক্ষ কর্মীদের কথা কতটা ভাবছে—এ সবকিছু এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।
সম্মান, নিরাপত্তা, উন্নতির সুযোগ ও কাজের অর্থবহতা আছে—মানুষ সাধারণত এমন কর্মস্থলই চায়। এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। তারা মূলত বিশ্বের সেরা ২৫ কর্মস্থলের তালিকা করে। সেই তালিকায় সবার ওপরে আছে হিলটন হোটেল। মূলত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এই জরিপ ও তালিকা করা হয়েছে।
এবারের তালিকায় ২৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টি যুক্তরাষ্ট্রের। অন্যগুলো বিভিন্ন দেশের, মূলত ইউরোপের। কোম্পানিগুলোর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে—২৫টি কোম্পানির মধ্যে ৮টি এই খাতের। এ ছাড়া নির্মাণ, জৈব ওষুধ, উৎপাদন, কুরিয়ার, আর্থিক ও পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানিগুলোও তালিকায় আছে।
সেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি কোম্পানি হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জীবনবিমা কোম্পানি মেটলাইফ। ২০২৫ সালে দশম স্থান অর্জন করে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো এই মর্যাদাপূর্ণ বৈশ্বিক স্বীকৃতি ধরে রাখল কোম্পানিটি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪০টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম রয়েছে।
৯০ লাখের বেশি উত্তরের ওপর ভিত্তি করে ফরচুনের সেরা ২৫টি কর্মক্ষেত্রের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী আড়াই কোটি কর্মীর কাজের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে মেটলাইফের প্রেসিডেন্ট ও সিইও মিশেল খালাফ বলেন, ‘টানা দ্বিতীয় বছরের মতো বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকায় স্থান পাওয়া কর্মীদের নিষ্ঠা ও উদ্যোগের প্রমাণ।’
কারা আছে তালিকায়দেখে নেওয়া যাক এবারের তালিকায় কোন কোন দেশের কোম্পানি আছে। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে কুরিয়ার ও যাতায়াত খাতের কোম্পানি ডিএইচএল। তৃতীয় স্থানে আছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সিসকো। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রে। চতুর্থ স্থানে আছে পেশাদার সেবা দেওয়া আইরিশ কোম্পানি অ্যাক্সেনচিউর, পঞ্চম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বিশ্বখ্যাত হোটেল ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল। ষষ্ঠ স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি অ্যাব ভিয়ে, সপ্তম স্থানে আছে ফ্রান্সের পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানি টিপি। অষ্টম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনভিত্তিক কোম্পানি স্ট্রাইকার, নবম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি সেলস ফোর্স।
দশম স্থানে আছে মার্কিন বিমা কোম্পানি মেটলাইফ, ১১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সার্ভিস নাউ। ১২তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি স্পেকসেভার্স। ১৩তম স্থানে আছে জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি সিমেন্স হেলদিনেস; ১৪তম স্থানে আছে আইরিশ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এক্সপেরিয়েন। ১৫তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এনভিডিয়া, ১৬তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি কেডেন্স। ১৭তম স্থানে আছে জার্মানির বিমা ও আর্থিক কোম্পানি আলিয়াঞ্জ এবং ১৮তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতের কোম্পানি ডাও।
১৯ থেকে ২১তম স্থানে আছে তিনটি মার্কিন কোম্পানি। ১৯তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি ভিয়াট্রিস, ২০তম স্থানে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাডোবি, ২১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ক্রাউডস্ট্রাইক।
২২ ও ২৩তম স্থানেও আছে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি কোম্পানি—উৎপাদন খাতের এসসি জনসন ও খুচরা বিক্রয় খাতের ট্রেক বাইসাইকেল। ২৪তম স্থানে আছে লিচেনস্টাইনের নির্মাণ কোম্পানি হিলতি ও ২৫তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের বিমা ও আর্থিক খাতের কোম্পানি অ্যাডমিরাল গ্রুপ।
কীভাবে এই মূল্যায়ন৩০ বছর ধরে এই জরিপ পরিচালনা করছে ফরচুন ম্যাগাজিন। সারা বিশ্বের কর্মীদের কাছ থেকে তারা জানতে চায়, কর্মস্থলে তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কিছু মানদণ্ড তৈরি করে। সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতে বোঝা যায়, কোনো কর্মস্থল প্রকৃত অর্থেই ‘দারুণ’ কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা সে প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান কি না, প্রতিষ্ঠান কত দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ও তার সামগ্রিক ব্যবসায়িক সাফল্য কতটা মিলবে—এসব বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায় জরিপে।
ফরচুন ম্যাগাজিন নিজস্ব ট্রাস্ট ইনডেক্স বা আস্থাসূচক তৈরি করেছে। ব্যবস্থাপনার প্রতি কর্মীদের আস্থা কতটা, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ও কোম্পানির প্রতি কর্মীদের আনুগত্য কতটা—এসব আস্থাসূচকের মাধ্যমে এসব বিষয় পরিমাপ করা হয়।
এ জরিপে কর্মীরা গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁদের মতামত জানাতে পারেন। ৬০টি বিষয়ের ওপর ৫ পয়েন্টের ভিত্তিতে উত্তর দিতে হয়, সঙ্গে থাকে ২টি উন্মুক্ত প্রশ্ন।
কর্মীদের কাছ থেকে যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয়, সেগুলো হলো নেতৃত্বের কাছে কি সহজে যাওয়া যায়, নেতৃত্ব সততা ও স্বচ্চতার সঙ্গে কথা বলেন ও কাজ করেন কি না, নেতৃত্বের কথা ও কাজে মিল আছে কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে সম্মানিত বোধ করেন কি না এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কতটা। নেতৃত্ব কর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানান কি না এবং কর্মীদের সুস্থতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না। এ ছাড়া কর্মীদের অবদান রাখার সুযোগ আছে কি না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়।
জরিপে কর্মীদের কাছে আরও যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয় সেগুলো হলো:বেতন, মুনাফা, পদোন্নতি, স্বীকৃতি ও সুযোগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কতটা ন্যায়সংগত;
কর্মীরা নিজেদের কাজ, কর্মদল ও প্রতিষ্ঠানের জন্য গর্ব বোধ করেন;
কাজ অর্থবহ এবং তা পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে;
সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগে;
কর্মীরা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারেন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অভিজ্ঞতার ভিন্নতা কতটা, তা–ও জরিপে পরিমাপ করা হয়। কর্মীদের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা ও গুণগত মানও মূল্যায়ন করা হয়। এভাবে প্রতিটি ধাপে কঠোর মানদণ্ড মেনে এই তালিকা করা হয় বলে জানিয়েছে ফরচুন ম্যাগাজিন।