ইসরায়েলি সেনাসদস্য ও কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ত্রাণ নিতে আসা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে তাঁদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ত্রাণ নিতে আসা লোকজন যাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান, সে জন্য তাঁদের ওপর গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

ইসরায়েলের প্রভাবশালী হারেৎজ পত্রিকা কয়েকজন সেনাসদস্য ও কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) দাবি করে আসছে, ত্রাণ নিতে এসে কেউ নিহত হননি বা তাঁদের ওপর হামলার ঘটনা খুব কমই ঘটেছে।

এক মাস ধরে গাজায় ত্রাণ বিতরণ করছে বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফ। ত্রাণ নিতে গিয়ে গত এক মাসে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৫৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

গাজার মানুষ বলছেন, জিএইচএফের এসব ত্রাণকেন্দ্র এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।

ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে, ফিলিস্তিনিদের সামনে এখন দুটি পথ—হয় না খেয়ে মরবে, না হয় খাবার আনতে গিয়ে মারবে।

জিএইচএফ নিয়ে শুরু থেকেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সন্দেহ প্রকাশ করছিল। কারা এই সংস্থা চালায়, কারা অর্থ দেয়, কেন চালায়—কোনো কিছুই পরিষ্কার নয়।

অনেকেই বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েলই এই ত্রাণ সংস্থা চালাচ্ছে, যাতে তারা ত্রাণের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখে গাজার ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়।

হারেৎজের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ত্রাণকেন্দ্রে নিহত ব্যক্তিদের সবাইকে গুলি করেছেন ইসরায়েলি সেনারা। আর এই গুলি চালাতে সেনাদের সরাসরি আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

হারেৎজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে যুদ্ধাপরাধ ঘটেছে কি না, তা তদন্ত করতে সেনাবাহিনীর কৌঁসুলি অফিস ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে ইসরায়েলি সেনাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ত্রাণ নিতে আসা মানুষ যাতে এগোতে না পারেন বা তাঁরা যেন ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান, সে জন্য তাঁদের ওপর গুলি চালিয়েছেন সেনারা। অথচ ত্রাণ নিতে আসা জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাণনাশী নয়, এমন কোনো অস্ত্র বা উপায় ব্যবহার করা হয়নি।

এক ইসরায়েলি সেনা বলেন, ‘এটি যেন একটা হত্যার জায়গা। আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে প্রতিদিন এক থেকে পাঁচজন মারা যেতেন।’

ওই সেনাসদস্য আরও বলেন, ‘ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর এমনভাবে গুলি চালানো হয়, যেন তাঁরা আমাদের আক্রমণ করছেন। আমরা দাঙ্গা দমন করার অস্ত্র ব্যবহার করি না, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ি না। আমরা শুধু ভারী মেশিনগান থেকে গুলি করি, গ্রেনেড বা মর্টার ছুড়ি।’

ওই ইসরায়েলি সেনা আরও যোগ করেন, ‘আমরা ওদের সঙ্গে কথা বলি গুলির মাধ্যমে।’

এমন পরিস্থিতিতেও যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফের জন্য তিন কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা অনুমোদন দিয়েছে। অথচ ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

মানবাধিকার আইনজীবীরা সতর্ক করেছেন, এই সংস্থার কর্মীরা যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ওপর গ ল জ এইচএফ ইসর য় ল জন য ত

এছাড়াও পড়ুন:

জাতিসংঘে তীব্র সমালোচনার মুখে ইসরায়েল, গাজা–পরিকল্পনার পক্ষে সাফাই নেতানিয়াহুর

ফিলিস্তিনির গাজা সিটির ‘নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার’ ইসরায়েলি পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা।

তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, এ পরিকল্পনাই যুদ্ধ শেষ করার ‘সবচেয়ে ভালো উপায়’।

এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন, পরিকল্পিত সামরিক অভিযান দ্রুত শুরু করা হবে। হামাসের হাত থেকে গাজাকে মুক্ত করা হবে।

ইসরায়েল গাজাবাসীকে অনাহারে রেখেছে—এ অভিযোগ অস্বীকার করেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, বরং গাজায় থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদেরই ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে’ রাখা হচ্ছে।

এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে ইসরায়েল তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। বৈঠকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ অন্য দেশ সতর্ক করে বলে, ইসরায়েলের পরিকল্পনাটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ‘লঙ্ঘনের ঝুঁকি’ তৈরি করছে।

পরিকল্পনাটি প্রত্যাহারের আহ্বান জানায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, গ্রিস ও স্লোভেনিয়া। দেশগুলো বলেছে, এ পরিকল্পনা ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির ক্ষেত্রে কোনো সহায়তা করবে না; বরং তাঁদের জীবনকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।

নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্যও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীন বলেছে, গাজার জনগণের ওপর ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ অগ্রহণযোগ্য। আর রাশিয়া বিচার-বিবেচনাহীনভাবে সংঘাত বৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক করেছে।

জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ ইয়েনচা বৈঠকে বলেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে গাজায় নতুন একটি বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, যা পুরো অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে। আরও বাস্তুচ্যুতি, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হবে।

জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা রমেশ রাজাসিংহাম বলেন, গাজার খাদ্যসংকট এখন আর শুধু হুমকি নয়, এটি সরাসরি অনাহারে রূপ নিয়েছে।

তবে বৈঠকে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডরোথি শিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিরলসভাবে জিম্মিদের মুক্তি ও যুদ্ধের অবসানে কাজ করছে। এ বৈঠক সেই প্রচেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, হামাস যদি জিম্মিদের ছেড়ে দেয়, তাহলে যুদ্ধ আজই শেষ হতে পারে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তারা এ বৈঠককে ব্যবহার করে ইসরায়েলকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করছে। তিনি গণহত্যার বিষয়টিকে স্পষ্টত মিথ্যা বলে দাবি করেন।

গতকাল রোববার নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানায়, তিনি পরিকল্পনাটি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন।

আরও পড়ুনগাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র নিন্দা ০৮ আগস্ট ২০২৫

অন্যদিকে ইসরায়েলজুড়ে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে সরকারের এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখিয়েছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এ পরিকল্পনা জিম্মিদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে গাজা সিটির অবশিষ্ট দুটি হামাস ঘাঁটি ও আল-মাওয়াসি এলাকার ঘাঁটি ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি গাজায় সাহায্য বাড়াতে তিন দফা পরিকল্পনার কথা জানান নেতানিয়াহু। এর মধ্যে রয়েছে নিরাপদ করিডর স্থাপন, আকাশপথে সাহায্য পাঠানো বৃদ্ধি এবং বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত বিতরণকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো।

চলতি মাসের শুরুতে জাতিসংঘ জানায়, মে মাসের শেষ দিকে গাজায় জিএইচএফ ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র স্থাপনের পর ত্রাণ নিতে গিয়ে ১ হাজার ৩৭৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

আরও পড়ুনগাজা দখলের পরিকল্পনা অবিলম্বে বাদ দিন: জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধান০৮ আগস্ট ২০২৫

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত শনিবার থেকে এ পর্যন্ত উপত্যকায় অনাহার ও অপুষ্টিতে আরও পাঁচজন মারা গেছেন। ফলে অনাহারে মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৭।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

আরও পড়ুনগাজা সিটি ‘ছেড়ে যাব না’, ইসরায়েলি হুমকির মুখে বলছেন বাসিন্দারা০৯ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাতিসংঘে তীব্র সমালোচনার মুখে ইসরায়েল, গাজা–পরিকল্পনার পক্ষে সাফাই নেতানিয়াহুর