রাজশাহীতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। জেলা সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী রাশেদুল ইসলাম দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে জেলার ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলামকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

১৮ জুন জেলা সমন্বয় কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আট দিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান সমন্বয়কারী পদত্যাগপত্র পাঠান। পরদিন গতকাল শুক্রবার আরেক নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

ইংরেজিতে লেখা পদত্যাগপত্রে জেলার প্রধান সমন্বয়কারী রাশেদুল লেখেন, ‘যথাযথ শ্রদ্ধা এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি এনসিপির রাজশাহী জেলার প্রধান সমন্বয়কারীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিচ্ছি।’ তিনি লেখেন, ‘এনসিপির ব্যানারে দলের সেবা করা এবং দেশের উন্নতির জন্য কাজ করা আমার জন্য সম্মানের এবং সৌভাগ্যের। জেলা ইউনিটের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে যে আস্থা, সমর্থন ও সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে ব্যক্তিগত কারণে আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এই মুহূর্তে আমাকে আমার ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে।’

জেলা এনসিপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমন্বয় কমিটি গঠনের পর থেকেই নানা কারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। জেলা ও মহানগর সমন্বয় কমিটির মধ্যেও আছে দূরত্ব। এ কারণে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেনের ওপর ককটেল নিক্ষেপের ঘটনায় রাজশাহীতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে নেতা-কর্মীর সংকট দেখা দেয়। জেলা ও মহানগর কমিটিতে পদধারী নেতাই যেখানে ৪৩ জন, সেখানে ওই বিক্ষোভে অংশ নেন মাত্র ২৭ জন। জেলা ও মহানগরের ব্যানারে ওই কর্মসূচি ডাকা হলেও সেদিন নগরের বেশির ভাগ নেতাকে দেখা যায়নি। যদিও জেলার সঙ্গে দূরত্ব অস্বীকার করেছে নগর কমিটি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাতে একটি রেস্তোরাঁয় বসেছিলেন জেলা কমিটির নেতারা। এ রেস্তোরাঁর মালিক পদত্যাগপত্র পাঠানো প্রধান সমন্বয়কারী রাশেদুল ইসলাম। সেখানে তাঁর সামনেই ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলাম আরেক যুগ্ম সমন্বয়কারী ফিরোজ আলমের বুকে লাথি মারেন। তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের অভিযোগ তুলেছিলেন। এ ঘটনার পর আহত অবস্থায় ফিরোজ আলমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বিষয়টি জানাজানি হলে জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলামকে শুক্রবার সাময়িক অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। একই সঙ্গে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কেন তাঁকে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না, তা তিন কার্য দিবসের মধ্যে মধ্যে জানাতে বলা হয়।

শুক্রবার বিকেলে এক ভিডিও বার্তায় নাহিদুল ইসলাম নিজেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী জেলার আহ্বায়ক পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘এনসিপির জেলা কমিটিতে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি আছে, যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন। এর কিছু তথ্য-প্রমাণ সামনে আসায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। তার কোনো সুরাহা না হওয়ায় এটি শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি করার শামিল। রাজশাহীতে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার ধুম চলছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এনসিপিকে জেলায় অবাঞ্ছিত করা হবে।’

এর আগেই রাতে পদত্যাগপত্র পাঠান জেলার প্রধান সমন্বয়কারী। দলের ভেতর এমন বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে শুক্রবার রাজশাহীতে এসেছেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন।

পদত্যাগের বিষয়ে রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি পদত্যাগপত্র কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়েছে কি না, তা আমি জানি না। আমি কোনো দিন রাজনীতি করিনি। হঠাৎ করে এসে মনে হচ্ছে, এত বড় পদ আমার জন্য না। তবে আমি এখনো এনসিপির সঙ্গে আছি। এনসিপির ভালোটাই চাই। একান্তই ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি।’

পদত্যাগের সঙ্গে বুধবার রাতের ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘এটাই মূল কারণ নয়। তবে ঘটনাটি আমাকে পদত্যাগে প্রভাবিত করেছে।’

কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রাজশাহী এসেছি। ইতিমধ্যে সবার সঙ্গে কথা বলেছি। রাতেও বসব। সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছি। রাজশাহীতে এনসিপির কার্যক্রম আছে, সবাই মিলেই কাজ করব। জেলার প্রধান সমন্বয়কারী পদত্যাগপত্র পাঠালেও সেটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি এখন বিবেচনাধীন আছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পদত য গপত র প ঠ য গ ম সমন বয়ক র ক ন দ র য় কম ট র র শ দ ল ইসল ম ন হ দ ল ইসল ম শ ক রব র এনস প র পদত য গ র জন য আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ

কিস্তি: ১
১৯২০ সালের কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহ্‌মদ যখন এ কে ফজলুল হকের কাছে পত্রিকা করার নিয়ত নিয়ে সলা-পরামর্শ করতে গেলেন, হক চাইলেন পত্রিকার নামটি হোক মুসলমানি শব্দে। ‘হিন্দুরা তোমাদের কাগজ কিনবেন না। পক্ষান্তরে মুসলমানরাও বুঝতে পারবেন না যে কাগজখানা মুসলমানদের।’ মুজফ্ফর ও নজরুলের বুঝ ছিল ভিন্ন। তাঁরা পত্রিকার নামে আলাদা করে মুসলমানি চিহ্ন প্রকটিত না করে, এমন নাম দিতে চাইলেন যেন দুই সম্প্রদায়ের গ্রাহকই পত্রিকা কেনেন। অগত্যা পত্রিকার নাম হলো ‘নবযুগ’।

এভাবে ১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। এই পত্রিকা চালুর আলোচনায় মুজফ্ফর ও নজরুল বাদেও ছিলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোজাম্মেল হক, নবনূর পত্রিকার সাবেক ম্যানেজার উমেদ আলী মিয়া, নূর লাইব্রেরির মালিক মঈনুদ্দীন হুসয়ন, সিলেট নিবাসী ফযলুল হক সেলবর্সী প্রমুখ। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। খুবই চিত্তাকর্ষক এই সমাবেশ? কেন? সেটাই এই লেখার প্রতিপাদ্য। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।

বিশ শতকের শুরুর দিকে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রবল নড়াচড়া শুরু হয়। উপনিবেশি-আধুনিক শিক্ষায় বিপুল সংখ্যায় শরিক হয় তারা। নতুন ধরনের যে শাসন সংশ্রয়; অর্থাৎ কলোনিয়াল প্রশাসন, মুদ্রণমাধ্যম ও লোকজমায়েত—তাতে তারা শামিল হয়। আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার আল-এসলাম (১৯১৪-১৯১৯), নাসিরউদ্দীনের মাসিকসওগাত আর ত্রৈমাসিকবঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার মতো পত্রিকা নতুন ধরনের মধ্যস্থতা বা মেডিয়েশন সম্ভব করল। আরও এল ‘মোসলেম ভারত’, ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘মোসলেম’, ‘মোহম্মদী’ ইত্যাদি। মতামত ও চিন্তার এই বিপুল উৎপাদন ও সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গেই এই সমাজের ভেতর নানা প্রবণতা আলাদা হয়ে প্রকটিত হলো। ভেদরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।

১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।

বর্তমান লেখার চলতি অনুমান হলো, পশ্চিমকেন্দ্রিক আধুনিক দুনিয়ায় ফরাসি বিপ্লবের সিলসিলায় ভাবাদর্শিক দুই মেরু হিসেবে যে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী ভাগ করা হয়, সেটা বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রথম স্পষ্ট হয় বিশের দশকে। বাম-ডানের এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতা বুঝতে ১৯২০ সালের নবযুগপত্রিকার দুই তরুণ সহকর্মী কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ও ফযলুল হক সেলবর্সী (১৮৯৫-১৯৬৮)—এই দুজনকে নিয়ে সংক্ষেপে এ প্রবন্ধের আলাপ। ১৯২০ সালে যখন দুজনে সহকর্মী হলেন, একজনের বয়স ২৫, আরেকজনের ২১। কলকাতার বুকে কর্মরত এই দুই তরুণ বুদ্ধিজীবীর নিয়ত ও নিয়তিতে পরের ১০ বছর যে মেরুকরণ ঘটে, তার হদিস নিলে বাঙালি মুসলমান সমাজে উদীয়মান ভাবাদর্শিক মেরুকরণের কুলুজিটা ভালোই বোঝা যাবে।

নজরুল আর সেলবর্সী—এ দুজনের মধ্যে তুলনা হয় না, আবার হয়ও। নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র। তবু উপনিবেশি বাস্তবতায় বাঙালি মুসলমান সমাজে আধুনিক সংশ্রয়ের উন্মেষে এই দুই ‘সাংবাদিক’ যুক্ত ও শরিক ছিলেন। দুটি পরস্পরবিরোধী প্রবণতার স্বর হিসেবে তাঁদের তুলনা করলে সেকালের সামাজিক মুখর বাহাসের পরিচয় পাওয়া যায়, তাই এই বিসদৃশ তুলনা।

তুর্কি-আফগান সমাচার

কৃষক অধ্যুষিত বাঙালি মুসলমান সমাজে উনিশ শতকের ফরায়েজি, তরিকায়ে মুহম্মদিয়া ইত্যাদি আন্দোলনের ফলে এই সমাজের বিশ্ববীক্ষা প্রসারিত হয়েছিল। বিশ শতকে এসে প্রথম মহাযুদ্ধ ও খেলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সমাজের উদীয়মান মধ্যবিত্ত অংশের চিন্তা ও তৎপরতার একটা নতুন পর্যায় শুরু হয়। উপনিবেশি সংশ্রয়ে ভদ্রলোক হিসেবে নিজের সংস্থান করা এবং প্রাধান্যশীল হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের সঙ্গে অনুকরণ, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা—এই ত্রিবিধ সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যে বিম্ব-বিড়ম্বনার (মাইমেটিক কনফ্লিক্ট) জন্ম হলো, তা থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজে স্বাতন্ত্র্যের বোধ প্রবলতর হলো। এই সময়ে মুসলমান সমাজের বিশ্ববীক্ষার কল্পিত ভূগোলে দুটি অঞ্চলের স্থান উল্লেখযোগ্য: তুরস্ক ও আফগানিস্তান। বাংলা, তথা উপমহাদেশে মুসলমান রাজবংশগুলো জাতিগতভাবে তুর্কি ও আফগান বলেই বিবেচিত। ফলে কাকতাল নয় যে নজরুল ও সেলবর্সী নিয়ে আমাদের আলাপের সূচনাও তুরস্ক ও আফগানিস্তানকে ঘিরে।

নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র।ফযলুল হক সেলবর্সী (১৮৯৫-১৯৬৮)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ