ফিলিস্তিনের গাজার আট সন্তানের বাবা আতার রিয়াদ। তিনি বেইত হানুন এলাকার বাসিন্দা। ক্ষুধার্ত পরিবারকে বাঁচাতে প্রায়ই তাঁকে দূরদূরান্তের বিভিন্ন খাদ্যকেন্দ্রে যেতে হয়। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় তাঁর পুরো পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা দিতে গিয়ে রিয়াদ আলজাজিরাকে বলেন, আমি প্রায়ই ১৫ কিলোমিটার হেঁটে মধ্য গাজার নেতজারিম করিডোরে যাই। আমি সেখানে দেখেছি, ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় কীভাবে রক্তপাতের দৃশ্যে পরিণত হয়। তিনি বলেন, একদিন সেনারা বলেছিল, ট্রাকে ত্রাণ আছে। ক্ষুধার্তরা ট্রাকের কাছে ছুটে যায়। কিন্তু খাবার না দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট করা হয়। কোনো খাবার বা পানি নয়, সেখানে শুধুই মৃত্যু। এমন দৃশ্য কেবল সিনেমায় দেখা যায়। মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় অন্তত ১৭ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
ইউসিএলএ ল প্রমিজ ইনস্টিটিউট ইউরোপের নির্বাহী পরিচালক কেট ম্যাকিনটোশ মনে করেন, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) খাদ্য বিতরণের নামে যা করছে, তা ফৌজদারি অপরাধ। হত্যা করা হচ্ছে, অথচ স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই। এভাবে মানুষ হত্যা যুদ্ধাপরাধ। অন্যদিকে, জিএইচএফের কার্যক্রম বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে।
গাজার হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সমগ্র ভূখণ্ডজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৭২ জন নিহত হয়েছেন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, গত চার সপ্তাহে মানবিক সহায়তা পেতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ৫৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৪ হাজার ৬৬ জন আহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ২৫৯ জন নিহত ও ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৮ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহত্তর আঞ্চলিক লক্ষ্যের দিকে নজর দিয়েছেন। আলজাজিরা জানায়, নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করেই থেমে নেই। তিনি এখন এই অঞ্চলজুড়ে আরও বড় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন।
শুধু গাজা থেকে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া কিংবা হামাসকে ধ্বংস করা নয়, নেতানিয়াহুর মূল লক্ষ্য ইসরায়েলের ডানপন্থি দলগুলোর মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করা। তিনি আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন, যা তাঁর ডানপন্থি জোটকে আরও বেশি দিন ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে।
জাতিসংঘ মানবিকবিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) জানায়, এক সপ্তাহে ২৩ বার হামলা করেছে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা। এসব হামলায় ফিলিস্তিনিরা হতাহত হচ্ছেন। তারা বাড়িঘর ও সহায়-সম্পদ হারাচ্ছেন। অধিকৃত পশ্চিম তীরজুড়ে ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুনও দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই ত্রাণপ্রত্যাশী ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে বলে স্বীকার করেছে ইসরায়েলি সেনারা। এক সেনা দ্য হারেৎজকে বলেছেন, নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের হত্যাকাণ্ড একান্তই ইচ্ছাকৃত। ওই সেনা বলেন, গাজা এখন একটি ‘হত্যাক্ষেত্র’। যাদের হত্যা করা হয়, তারা কোনো আক্রমণকারী নয়। তাদের ওপর দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র বা কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয় না। শুধু ভারী মেশিনগান আর গাইডেন্স লঞ্চার দিয়ে আমরা তাদের দিকে আগুন ছুড়ে দিই। ‘নিরপরাধ মানুষ হত্যা’ বিষয়টিকে স্বাভাবিক করা হয়েছে।
গতকাল ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী খান ইউনিসের উত্তরে হামাদ শহরে ইসরায়েলি সেনাদল ও তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করেছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা উত্তর গাজায় হামাসের সুড়ঙ্গ ভেঙে দিয়েছে।
ফিলিস্তিনে জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ ইসরায়েলকে গাজার অবরোধ প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ইসরায়েলি অবরোধের ফলে ২ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির জন্য মানবিক সহায়তা বাধা পাচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনি জলপাই গাছ ধ্বংস করে নাবলুসের কাছে অবৈধ ফাঁড়ি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ফেলা ত্রাণের বাক্সের নিচে চাপা পড়ে কিশোর নিহত
গাজা উপত্যকায় উড়োজাহাজ থেকে ফেলা ত্রাণবোঝাই বাক্সের নিচে চাপা পড়ে ১৫ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শনিবার গাজার নেতজারিম করিডরের কাছে এ ঘটনা ঘটে। ওই কিশোরের নাম মুহান্নাদ জাকারিয়া ঈদ।
গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহর দখল করতে ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা চলার মধ্যে এ ঘটনা ঘটল।
গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় বলেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ফেলা ত্রাণের বাক্সের আঘাতে কমপক্ষে ২৩ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন এবং ১২৪ জন আহত হয়েছেন।ভিডিওতে দেখা গেছে, গতকাল গাজার নেতজারিম করিডরের কাছে কিশোর ঈদের চারপাশে কয়েকজন মানুষ জড়ো হয়ে আছেন। কেউ কেউ ছেলেটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। তার মুখ রক্তাক্ত ছিল। ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করেছে আল–জাজিরা।
অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই কিশোরের ভাই তাকে ঘটনাস্থল থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তার বাবা নুসাইরাতের আল-আওদা হাসপাতালে তার মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে আছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ঈদের ভাই বলেন, তাঁর ভাই ত্রাণ নিতে গিয়েছিল। উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলা হচ্ছিল। ওই সময় একটি বাক্স সরাসরি তাঁর ভাইয়ের ওপর পড়লে তার মৃত্যু হয়।
ঈদের ভাই আরও বলেন, ‘তারা (যে দেশগুলো সাহায্য পাঠাচ্ছে) সীমান্ত দিয়ে সরাসরি সাহায্য দিতে পারছে না। তারা ওপর থেকে ত্রাণের বোঝা ফেলছে। এতে আমাদের শিশুরা মারা যাচ্ছে।’
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গাজায় ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে আরও ১১ জন ফিলিস্তিনি অনাহারের কারণে মারা গেছেন। এ নিয়ে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অপুষ্টির কারণে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ২১২–তে দাঁড়িয়েছে।জাতিসংঘ বারবার বলেছে, উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলাটা বিপজ্জনক। এগুলো কার্যকরও নয় এবং এতে খরচও বেশি। গাজায় স্থলসীমান্ত দিয়ে নিয়মিত মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে দেওয়ার জন্য বারবার ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে জাতিসংঘ।
গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় বলেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ফেলা ত্রাণের বাক্সের আঘাতে কমপক্ষে ২৩ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন এবং ১২৪ জন আহত হয়েছেন।
গাজার হাসপাতাল সূত্রগুলো বলেছে, গতকাল গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গাজায় ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে আরও ১১ জন ফিলিস্তিনি অনাহারে মারা গেছেন। এ নিয়ে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অপুষ্টির কারণে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ২১২–তে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৯৮টিই শিশু।