ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর চীনের শক্তি নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
Published: 28th, June 2025 GMT
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্প্রতি ১২ দিন ধরে ব্যাপক সংঘাত হয়। ক্রমবর্ধমান এই আঞ্চলিক সংকটের মধ্যে চীন দ্রুত নিজেদের শক্তিশালী মধ্যস্থতাকারী ও যুক্তিসংগত কণ্ঠস্বর হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করতে থাকে।
ইসরায়েল ১৩ জুন কোনো উসকানি ছাড়াই ইরানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পরদিনই উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে মধ্যস্থতার মাধ্যমে এ সংকট সমাধানের আগ্রহ প্রকাশ করে চীন। অবশ্য একই সময়ে দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসরায়েলের এমন হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানান।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি’র দাবি তোলে চীন।
ইরান যখন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালি অবরোধের হুমকি দেয়, তখনো বেইজিং দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। এই প্রণালি দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল পরিবহন হয়ে থাকে।
সংঘাত প্রশমন এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর আঞ্চলিক অস্থিরতার প্রভাব রুখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি সংঘাতে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে আসছে চীন। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতজুড়েও দেশটি এই নীতিতে অটল ছিল।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই নীতি চীনের মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে খুব একটা সহায়তা করেনি। বরং ওই অঞ্চলে দেশটির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে তুলেছে।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষক ইভানজেলিন চেং বলেন, চীন সাধারণত পররাষ্ট্রনীতিকে ‘আদর্শগত ঐক্যের চেয়ে কৌশলগত বাস্তবতার চোখে দেখে।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশ এর একেবারে উল্টো পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে।
ইভানজেলিন চেং আরও বলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ হচ্ছে, চীন সব সময় তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করাকে গুরুত্ব দেবে। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের এ রকম বহু স্বার্থ রয়েছে।
ইসরায়েলের দ্রুত বর্ধনশীল প্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে এবং তার বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো প্রকল্প ইরান, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, ইরাক, মিসর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিস্তৃত।
গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, চীন তার অর্ধেকের বেশি অপরিশোধিত তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল। দেশটি ইরানি তেলের শীর্ষ ক্রেতাও বটে।
দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চীনের তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাত, যেমনটা ঘটত ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলেও। ইরানের পার্লামেন্ট এই প্রণালি বন্ধের হুমকিও দিয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইরান অধ্যয়নের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আলম সালেহ বলেন, ‘যুদ্ধ ও নিরাপত্তাজনিত অস্থিরতা শুধু চীনা বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং ব্যবসাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামসহ সামগ্রিক জ্বালানি নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল।’
আলম সালেহ বলেন, চীন তাই স্থিতিশীলতা চায় এবং যেকোনো পক্ষের সঙ্গে যেকোনো ধরনের সংঘর্ষে সামরিক সমাধানের বিরোধিতা করে।
বেইজিংয়ের ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের অর্থনীতির অধ্যাপক জন গং আল–জাজিরাকে বলেন, এই সংঘাতে চীনের প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল ‘তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া’ ঠেকানো, যা তাদের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলতে পারত।
ইরানের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক শঙ্কার ব্যাপারে অবগত আছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। চলতি সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলাকালে হরমুজ প্রণালি বন্ধ না করতে ইরানকে বোঝাতে তিনি বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানান।
রুবিওর এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিজেদের প্রভাবের স্বীকৃতি পেয়েছিল বেইজিং। তবে বিশ্লেষকদের মতে, চীনের সামগ্রিক কূটনৈতিক প্রভাব এখনো সীমিত।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষক ইভানজেলিন চেং বলেন, চীনের মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব তাদের দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষকে স্পষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রভাব সীমিতই থেকে গেছে। এই অঞ্চলে সামরিক সক্ষমতা বা গভীর রাজনৈতিক প্রভাব না থাকায় এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক নিয়ে ইসরায়েল সতর্ক হওয়ায় চীনের ভূমিকা বাধাগ্রস্ত হওয়াই স্বাভাবিক।
চীন অবশ্যই এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে বড় কূটনৈতিক সমঝোতা করার সক্ষমতা দেখিয়েছে। ২০২৩ সালে দেশটি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে মধ্যস্থতা করেছিল।
ওই মধ্যস্থতাকে চীনের একটি বিশাল কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখা হলেও বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে ওমান ও ইরাকের বড় ভূমিকা ছিল।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে চীন হামাস ও ফাতাহসহ ফিলিস্তিনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে একটি চুক্তির মধ্যস্থতাও করে। এ চুক্তির আওতায় গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ শেষ হলে সেখানে সম্মিলিতভাবে শাসনব্যবস্থা চালাতে সম্মত হয় গোষ্ঠীগুলো।
তবে ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের উত্তর-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক উইলিয়াম ইয়াং বলেন, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে চীনের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ থাকায় সাম্প্রতিক সংঘাতের শুরু থেকেই চীনের জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূল ছিল।
২০২১ সালে চীন ও ইরান ২৫ বছরের একটি ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইরান চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে সক্রিয় অংশীদার।
চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায়ও যোগ দিয়েছে ইরান। চলতি বছর দেশটি চীনের ‘মেরিটাইম সিকিউরিটি বেল্ট’ নৌ মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
উইলিয়াম ইয়াং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইরানের ‘দৃঢ় অবস্থান’ চীনের বৃহত্তর কূটনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে ভালোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই ঘটনাটি চীনের মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা আরও দৃঢ় করে। চীন চায়, তারা একটি বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হোক, যারা বড় বৈশ্বিক সংঘাতে মধ্যস্থতা করতে পারে। কিন্তু চলমান কিছু সংঘাতে নির্দিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে বেইজিংয়ের সেই ভূমিকা পালনের ক্ষমতা কমে যায়।
উইলিয়াম ইয়াং আরও বলেন, বর্তমানে বেইজিং মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তার নিশ্চয়তাদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই নির্ভর করবে। এটা স্পষ্ট যে চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা আরও গভীর করতে চায় এবং একই সঙ্গে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিকে কাজে লাগাতে চায়।
ইয়াং বলছিলেন, অন্যদিকে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়া—বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার ফলে চীনের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। চীন এখন কূটনীতির পরিমণ্ডলে নিজেকে নীতিগতভাবে উচ্চ স্থানে রাখতে পারছে। একই সঙ্গে তারা দেখাতে পারছে, তারা অনেক বেশি সংযত, শান্ত ও দায়িত্বশীল বড় শক্তি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইউন ভ র স ট ইসর য় ল র পরর ষ ট র ক টন ত ক র অর থ র জন য আহ ব ন ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে হুতিদের হামলা
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। হাইফা বন্দর, নেগেভ, উম্ম আল-রশরাশ ও বিরসেবায় এ হামলা চালানো হয়েছে।
হুতির সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি বলেছেন, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস কর্মকান্ডের জবাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। হামলায় ছয়টি ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রোনগুলো সফলভাবে লক্ষবস্তুতে আঘাত হেনেছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধ না করলে এবং অবরোধ তুলে না নেওয়া পর্যন্ত এ ধরনের হামলা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে হুতি।
তবে হামলার বিষয়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় গাজায় অন্তত ৮৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩১ জন ছিলেন ত্রাণপ্রত্যাশী। এ সময় ৫১৩ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, অনাহারের কারণে গাজায় আরও পাঁচ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে দুটি শিশু রয়েছে। এ নিয়ে উপত্যকাটিতে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা ২২৭–এ পৌঁছাল, যাদের মধ্যে ১০৩টি শিশু।