বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন কি আদৌ সম্ভব
Published: 28th, June 2025 GMT
২০ জুন পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির নেতৃত্বে আছেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। অন্তর্বর্তী সরকারের আরও চারজন উপদেষ্টা এই কমিটির সদস্য। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা কাজ করবেন বলে ধারণা করা যায়।
বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের স্বায়ত্তশাসন বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকা এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা আদৌ সম্ভব কি না, সেটাই একটা প্রশ্ন। কারণ, যখন যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, নিজেদের প্রচারযন্ত্র হিসেবে এ দুটিকে ব্যবহার করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল তাদের ইশতেহারে বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা প্রায় সময়ই বলেছে। তবে নির্বাচিত হওয়ার পর কোনো সরকারই এ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়নি। সুতরাং লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য অরাজনৈতিক বর্তমান সরকারের জন্য এটি একটি দারুণ সুযোগ।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের আগেও বিটিভি ও বেতার ছিল খুবই জনপ্রিয় প্রচারমাধ্যম। তখন কোনো বেসরকারি টেলিভিশন বা রেডিও চ্যানেল ছিল না। বিকল্প মাধ্যম না থাকার কারণে এগুলো জনপ্রিয় ছিল, ব্যাপারটা শুধু তা নয়; বরং ভালো মানের এমন অনেক অনুষ্ঠান ছিল, যেগুলো বিটিভি-বেতারের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করেছে। গত তিন-চার দশকে এই জনপ্রিয়তায় ধীরে ধীরে ধস নেমেছে। সময়ের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে অনুষ্ঠানের মান যথেষ্ট বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া সরকারের প্রচার-প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান এ সময়ে আগের চেয়ে বেড়েছে।
এরশাদের আমলে প্রধান অভিযোগ ছিল সংবাদ নিয়ে। দিনের প্রধান সংবাদ যদি প্রচার হতো ২৫ মিনিট, তবে ১২-১৪ মিনিট দেখানো হতো রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরশাদের সারা দিনের কর্মকাণ্ড। ওই আমলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর খবর খুবই সীমিত আকারে প্রচার করা হতো। তা–ও সেটি নিয়মিত ছিল না। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হরতাল বা অন্য কোনো কর্মসূচি পালন করলে তা বিটিভি ও বেতারে প্রচার হতো ভিন্ন আঙ্গিকে। দেখানো হতো, এসব হরতাল জাতীয় জীবনে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
একপেশে সরকারি নিয়ন্ত্রণে খবর প্রচারের কারণে বিদেশি প্রচারমাধ্যম তখন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনার জন্য গ্রামগঞ্জ ও শহরের মানুষ চায়ের দোকানের সামনে জড়ো হতেন। গুরুত্বপূর্ণ ও বড় আন্দোলন সংগঠিত হলে চায়ের দোকানের ভিড় বাড়ত। মানুষ যেকোনো উপায়েই হোক, সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ জানতে চান। কিন্তু কোনো সরকারই গণমানুষের চাওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে গণমাধ্যমকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পারেনি।
পরবর্তী সময়ে সমস্যা নতুন রূপ ধারণ করেছে। একে একে দেশে অসংখ্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রচারের অনুমোদন পেয়েছে। এসব চ্যানেল অনুমোদনের পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করেছে দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে নতুন চ্যানেলগুলোও প্রায় ক্ষেত্রেই সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। শুধু তা–ই নয়, গত দেড় দশকে জনপ্রিয় হওয়া রাজনৈতিক টকশোগুলোও পক্ষ অবলম্বন করে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এর ওপর আছে চ্যানেলগুলোর ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সরকারি নিয়ন্ত্রণ।
যথাযথ সংবাদ পাওয়ার জন্য মানুষ পত্রিকার ওপরও পুরোপুরি ভরসা করতে পারেনি। কারণ, বেশির ভাগ পত্র–পত্রিকা কোনো নির্দিষ্ট দলের হয়ে কথা বলেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে বেশ কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছিল। বিরোধী সমালোচনাকে কোনো সরকারই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু গত দেড় দশকে সরকারের পক্ষ থেকে এটি ছিল সরাসরি নিপীড়নমূলক। বছরখানেক আগের জুলাই অভ্যুত্থানের খবরও পত্র–পত্রিকা ও চ্যানেলগুলো প্রচারের ক্ষেত্রে রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত ছিল।
এখন যে কমিটি গঠিত হয়েছে বলা হচ্ছে, সেই কমিটি গত ১৫ বছরের গণমাধ্যমের নীতিমালা পর্যালোচনা করবে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ নীতি প্রণয়নেও কাজ করবে। টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য আমরা যত কথাই বলি না কেন, সরকার ফ্যাসিস্ট হলে আসলে কোনো সূত্রই কাজে দেয় না। চাপিয়ে দেওয়া নতুন নীতি ও আইনের ধারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। মুখে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বললেও অগণতান্ত্রিক সরকার শাস্তি প্রদান ও ভয়ভীতির মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও একেকটি গণমাধ্যম সেলফ সেন্সরশিপ বা নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে চলে।
বিটিভি ও বেতারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নির্ধারিত হয় সরকারের ইচ্ছায়। তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় নীতি, আদর্শের বাইরে সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরপরও বাড়তি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় কেন। যাঁরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসেন, তাঁরা কোন দলের বা কোন পক্ষের রাজনীতি করেন, এটিও এসব মাধ্যমের কর্মকর্তাদের বিবেচনায় রাখতে হয়! না হলে বরখাস্ত হওয়ার বা শাস্তি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের যদি সত্যিকার স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে সরকারকে উদার ও গণতান্ত্রিক হতে হবে। আর অন্যান্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বসতে হবে কিংবা তাদের কথা শুনতে হবে। এমন আইন বা কালাকানুন প্রণয়ন করা যাবে না, যা অনুসন্ধানী সংবাদ ও প্রতিবেদন তৈরি করতে সাংবাদিকদের জন্যই ভীতি তৈরি করে। তবে একই সঙ্গে অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রেও সংবাদমাধ্যমগুলোর সতর্ক থাকা জরুরি। এমন কোনো সংবাদ বা তথ্য পরিবেশন করা ঠিক নয়, যেগুলো যাচাইকৃত নয়, কিংবা ভুল ও মিথ্যা।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। রাজনীতির বাইরেও এমন কিছু সংবেদনশীল বিষয় আছে, যেগুলোকে বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো পক্ষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় কিংবা জাতি ও লিঙ্গগত ভেদ তৈরি করে, এমন কিছু প্রচারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। শিশুদের জন্য সংবেদনশীল কি না, ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক কারণে আপত্তিকর কি না, বিষয়টি সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার সুযোগ তৈরি করতে পারে কি না, অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচারের আগে এগুলোও দেখতে হবে।
নবগঠিত কমিটি নীতি ও আইন তৈরি বা সংস্কারের ক্ষেত্রে সবকিছুকে বিবেচনায় রাখবে বলেই আমরা আশা করি। তবে এর প্রতিপালনে পরবর্তী সরকারের প্রতি প্রত্যাশা থাকবে আরও বেশি।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র প র জন ত ক অন ষ ঠ ন জনপ র য় ক জ কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
হজরত আলী (রা.)-এর ১০টি কালজয়ী উক্তি
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর খুতবা, পত্র ও উপদেশের একটি বিখ্যাত সংকলন হলো নাহজুল বালাগা বা বাগ্মিতার পথ। এটি একাদশ শতাব্দীতে সাইয়্যেদ শরিফ এটি সংকলন করেন।
গ্রন্থটিতে ২৪১টি খুতবা, ৭৯টি পত্র এবং ৪৮৯টি উপদেশ রয়েছে। গ্রন্থটির সংকলক শিয়া মতাদর্শী বলে পরিচিত হলেও শিয়া-সুন্নি উভয় ধারার আলেমরা এই গ্রন্থের সত্যতা স্বীকার করেন, যদিও কয়েকটি বর্ণনা সূত্র নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
নাহজুল বালাগা ইসলামি সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ এবং আলী (রা.)-এর জীবনাদর্শ ও শিক্ষার অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত। সেখান থেকে তার ১০টি কালজয়ী উক্তি তুলে ধরা হলো।
গ্রন্থটিতে ২৪১টি খুতবা, ৭৯টি পত্র এবং ৪৮৯টি উপদেশ রয়েছে। গ্রন্থটির সংকলক শিয়া মতাদর্শী বলে পরিচিত হলেও শিয়া-সুন্নি উভয় ধারার আলেমরা এই গ্রন্থের সত্যতা স্বীকার করেন।হজরত আলী (রা.)-এর কালজয়ী উক্তি১. জ্ঞানের মূল্য: ‘জ্ঞানই তোমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ; এটি কখনো হ্রাস পায় না বরং বিতরণের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়।’ (নাহজুল বালাগা, উপদেশ ১৯৫)
২. দুনিয়ার সত্যতা: ‘দুনিয়া একটি ক্ষণস্থায়ী ছায়া। এর পেছনে ছুটো না। যা চিরস্থায়ী, তার জন্য প্রস্তুত হও।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা ১০৩)
৩. নীরবতার শক্তি: ‘নীরবতা তোমাকে সম্মান দেয়, আর অপ্রয়োজনীয় কথা তোমার মর্যাদা কেড়ে নেয়।’ (নাহজুল বালাগা, উপদেশ ২২৪)
৪. ন্যায়বিচারের গুরুত্ব: ‘ন্যায়বিচার একটি সমাজের প্রাণশক্তি; এটি ছাড়া সমাজ ধ্বংসের মুখে পড়ে।’ (নাহজুল বালাগা, পত্র ৫৩)
আরও পড়ুনইমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কয়েকটি কারণ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এমন সঙ্গী বেছে নাও যে তোমাকে ভালো পথে নিয়ে যায় এবং তোমার ভুল সংশোধন করে।হজর আলী (রা.), নাহজুল বালাগা, উপদেশ ১৬০৫. অহংকারের ধ্বংস: ‘অহংকার মানুষের হৃদয়কে অন্ধ করে এবং তাকে পতনের দিকে নিয়ে যায়।’ (নাহজুল বালাগা, উপদেশ ৮৬)
৬. সত্যের পথ: ‘সত্য বলো, এমনকি যদি তা তোমার বিরুদ্ধে যায়। সত্যই তোমার মুক্তির পথ।’ (নাহজুল বালাগা, উপদেশ ১৪৬)
৭. সঙ্গী নির্বাচন: ‘এমন সঙ্গী বেছে নাও যে তোমাকে ভালো পথে নিয়ে যায় এবং তোমার ভুল সংশোধন করে।’ (নাহজুল বালাগা, উপদেশ ১৬০)
৮. ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ: ‘ক্রোধ তোমার শত্রু। যে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে নিজেকে জয় করতে পারে।’ (নাহজুল বালাগা, উপদেশ ১৫৩)
৯. দানের ফজিলত: ‘দান করো, কারণ এটি তোমার সম্পদ কমায় না, বরং তোমার মর্যাদা বাড়ায়।’ (নাহজুল বালাগা, উপদেশ ২৩৬)
১০. আল্লাহর ওপর ভরসা: ‘আল্লাহর ওপর নির্ভর করো, তিনি তোমার সব সমস্যার সমাধানকারী। যে তাঁর ওপর ভরসা করে, সে কখনো হতাশ হয় না।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা ১১৪)
সূত্র: দ্য ইসলামিক ইনফরমেশন ডটকম
আরও পড়ুননামাজ: দাসের মহিমা০৪ মার্চ ২০২৫