ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো নাজুক
Published: 29th, June 2025 GMT
ঢাকায় মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ওষুধ ছিটানো, সচেতনতামূলক প্রচার, আবার কোথাও কোথাও অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে পরিস্থিতি আরো জটিল। ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
শনিবার (২৮ জুন) সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় সারা দেশে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ৩৯২ জন। এদের মধ্যে ঢাকার বাইরের রোগীর সংখ্যা ৩৪৪ জন, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৮৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু বরিশাল বিভাগেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৪১ জন। যা সারা দেশের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ৪৮৪ জনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ নারী। মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের, যাদের মধ্যেও পুরুষের সংখ্যাই বেশি।
আইইডিসিআরের জরিপ ও স্বাস্থ্য বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বরিশাল, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরগুনার মতো জেলাগুলোতে এডিস মশার ঘনত্ব ও রোগীর সংখ্যা দুই-ই বাড়ছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, “বৃষ্টির পানি জমে থাকা, প্লাস্টিক প্যাকেট-পাত্রে পানি জমা, মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই ডেঙ্গু বাড়ছে।”
চিকিৎসার অভাবে ঢাকামুখী রোগী
ঢাকার বাইরে চিকিৎসা অবকাঠামো দুর্বল থাকায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা ছুটে আসছেন ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে। এতে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে এবং গুরুতর রোগীর পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে তৈরি হচ্ছে জটিলতা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুস্তাক হোসেন বলেন, “চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালকে প্রস্তুত করতে হবে যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগী চিহ্নিত ও চিকিৎসা শুরু করা যায়।”
তথ্যচিত্র: গত ২৪ ঘণ্টার চিত্র
নতুন আক্রান্ত: ৩৯২ জন
মৃত্যু: ২ জন (বরিশাল বিভাগ ও ঢাকা উত্তর সিটি)
সর্বোচ্চ আক্রান্ত বিভাগ: বরিশাল (১৪১ জন)
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন: ২৬০ জন।
মোট আক্রান্ত (২০২৫): ৯,৪৮৪ জন।
মোট মৃত্যু (২০২৫): ৪১ জন।
২০২৪ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন, মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ হাজার ৭০৫ জন। এবারের মৌসুমেও সেই ভয়াবহতার পূর্বাভাস মিলছে তবে এবার সংকটের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার বাইরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সিটি করপোরেশন নয়, দেশের প্রতিটি পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে হবে। তরুণদের নিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম, ব্যবহৃত পাত্র ব্যবস্থাপনা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। ডেঙ্গু আর রাজধানীকেন্দ্রিক সমস্যা নয়, বরং সঠিক পদক্ষেপ না নিলে দেশজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে।
ঢাকা/ইভা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর স থ ত ব যবস থ বর শ ল
এছাড়াও পড়ুন:
রংপুরে আরও তিনজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, জনসচেতনতায় জোর নেই
রংপুরের কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলায় আরও তিনজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে দুজন কাউনিয়ার এবং একজন মিঠাপুকুরের বাসিন্দা। এ নিয়ে জেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। তবু আক্রান্ত এলাকাগুলোতে অ্যানথ্রাক্স নিয়ে তেমন সচেতনতামূলক কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র বলছে, চলতি বছরের জুলাই ও সেপ্টেম্বরে রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজন মারা যান। একই সময়ে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে অর্ধশত ব্যক্তির শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা যায়। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করেছিল প্রাণিসম্পদ বিভাগ। পরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধিদল ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পীরগাছা সদর এবং পারুল ইউনিয়নের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ জন নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করেছিল। এর মধ্যে আটজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়।
আরও পড়ুনপীরগাছায় ৮ জনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, রংপুরের আরও দুই উপজেলায় উপসর্গের রোগী৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫আরও পড়ুনরংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজনের মৃত্যু, আক্রান্ত অর্ধশত১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫কাউনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুজন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ সেপ্টেম্বর কাউনিয়ায় অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ আছে এমন ছয়জনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে দুজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। সুজন সাহা বলেন, আক্রান্ত রোগীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। হাসপাতালের কর্মী রোগীর বাসায় গিয়ে চিকিৎসা দেবেন।
মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ১৫–২০ দিন আগে ইমাদপুর ইউনিয়নের আমাইপুর গ্রামে একটি গরু অসুস্থ হলে জবাই করা হয়। পরে ওই মাংস কাটাকাটি করার পর গ্রামের পাঁচ–ছয়জনের শরীরে ঘা হয় ও অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়। এরপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁরা চিকিৎসা নিতে আসলে সেখানে থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন পুরুষের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।
মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা (রোগনিয়ন্ত্রণ) এম এ হালিম লাবলু প্রথম আলোকে বলেন, ইমাদপুরে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবু রোগী যাতে সামাজিকভাবে কোনো হেয় পরিস্থিতির মধ্যে না পড়েন, সে জন্য তাঁদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তিনি জানান, এ রোগ গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে। অসুস্থ গরু জবাই করা বা মাংস খাওয়া যাবে না।
বুধবার দুপুরে আমাইপুর গ্রামে গেলে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও সোহরাব আলীর সঙ্গে। তাঁদের দাবি, গরুর মালিক গরু অসুস্থের কথা বলেননি। বলেছিল, দড়ি দিয়ে গরুর ফাঁস লেগেছিল। এ কারণে প্রতিবেশীরা মাংস কাটাকাটিতে যুক্ত হন। এই দুই স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রহমতপুর বাজারে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান, অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সচেতনতামূলক কার্যক্রম তাঁরা দেখেননি।
মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরেকটি সূত্র বলছে, উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের জীবনপুর গ্রামের একজন নারীর অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ পাওয়া গেছে। তিনি অসুস্থ গরুর সংস্পর্শে আসেননি। তবে তাঁর বাড়িতে গরু-ছাগল আছে। ওই নারী নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, মাটি বা ঘাসের সঙ্গে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু বছরের পর বছর ধরে থেকে যায়। বেশির ভাগ সময় পানি জমা ঘাস গবাদিপশু খাচ্ছে। সেখান থেকে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এ জন্য অ্যানথ্রাক্স প্রতিষেধক টিকা কার্যক্রমে জোর দিতে হবে।
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত ইমাদপুর এলাকার বাসিন্দারা প্রথম আলোকে জানান, ১০ থেকে ১২ দিন আগে তাঁদের এলাকায় গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী পচার হাটের মমিনুল ইসলাম ও মহেন্দ্র দাস বলেন, তাঁদের এলাকায় টিকা দেওয়া হয়নি। তাঁরা গরু-ছাগল নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ প্রথম আলোকে বলেন, গবাদিপশুর অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করার পরেই গত আগস্ট থেকে তাঁরা টিকা কার্যক্রম শুরু করেছেন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করতে দেরি করেছে। এ কারণে এখন আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দাবি, পীরগাছা ছাড়াও কাউনিয়া, মিঠাপুকুর, রংপুর সদর, পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী, উলিপুর ও রাজাটহাটেও অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিরাপদ মাংসের জন্য বিভিন্ন জবাইখানায় গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
অ্যানথ্রাক্স বিষয়ে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ দেরি করেনি দাবি করে ডেপুটি সিভিল সার্জন রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন জানতে পারছি, সঙ্গে সঙ্গে আইইডিসিআরকে জানানো হয়েছিল। প্রতিটি উপজেলাকে সতর্ক করা আছে এবং অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসার গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। এটার জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক বা চিকিৎসাব্যবস্থা, সেটাও পর্যাপ্ত আছে। এ মুহূর্তে যেটা বিষয়, জনগণকে সচেতন করা। অসুস্থ প্রাণী জবাই না করা, নিজেরা না খাওয়া, লুকিয়ে বিক্রি না করা। অসুস্থ প্রাণী মারা গেলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।’