দ্বৈত জন্মনিবন্ধনের সমস্যা নিয়ে দেড় বছর ঘোরার পর জানলেন কী করতে হবে
Published: 29th, June 2025 GMT
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মো. সেলিমের (৩৩) জন্মনিবন্ধন করা হয়েছিল ২০১০ সালে। তাঁর বাবা এটি করিয়ে দিয়েছিলেন। চলতি বছরের মে মাসে সেলিম তাঁর সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী ছেলের জন্মনিবন্ধন করাতে উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে যান। সেখানে জানতে পারেন, অনলাইনে সেলিমের দুটি জন্মনিবন্ধন রয়েছে। সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে এই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে জানিয়ে ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়।
গাজীপুরের মো.
অনলাইনে এমন দ্বৈত জন্মনিবন্ধনের সমস্যায় পড়েছেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বাসিন্দা শহীদুল ইসলামও।
১৬ জুন রাজধানীর রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে এসব ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা করণীয় জানতে এসেছিলেন। সে সময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সেলিম, জয়নাল ও শহীদুলের পুত্রবধূ ফৌজিয়া ইয়াছমিনের সঙ্গে। সমস্যা সমাধানে কেউ দেড় বছর, কেউ সাত মাস, কেউবা দুই মাস ধরে ঘুরছেন। স্থানীয়ভাবে সঠিক তথ্য না পাওয়ায় তাঁদের ভোগান্তি দূর হচ্ছে না।
রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা একাধিক জন্মনিবন্ধন করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই এই সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে। অনলাইনে দ্বৈত নিবন্ধন রয়েছে, এমন ব্যক্তিরা আবেদন করলে একটি বাতিল করা হচ্ছে।
সার্বিকভাবে দেশে এখন জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে কোনো ভোগান্তি নেই উল্লেখ করে যাহিদ হোসেন বলেন, প্রতিদিন নিবন্ধনের উচ্চ সংখ্যাই বলছে, কাজে গতি রয়েছে।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২৫ জুন জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি, ২০ হাজারের বেশি সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি।
‘দেড় বছর পর জানতে পারলাম কী করতে হবে’জয়নাল আবেদীন গাজীপুর সদর উপজেলায় পরিবার নিয়ে থাকেন। ২৬ বছর সৌদি আরবে থাকার পর ২০২০ সালে দেশে ফিরে আসেন। এখন উত্তরায় এক ব্যক্তির গাড়ির চালান।
জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ের স্বামী লিবিয়াপ্রবাসী। মেয়েকে লিবিয়া পাঠানোর জন্য ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন। গত বছর যখন আবেদন বাতিল হয়, তখন স্থানীয়ভাবে বারবার জানার চেষ্টা করেছেন, কী করতে হবে, কিন্তু কেউ জানাননি। উল্টো এক দালাল ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে তাঁকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এখানে এসে তিনি জানতে পারলেন, একটি জন্মনিবন্ধন বাতিলের জন্য আবেদন করতে হবে।
জয়নাল আবেদীন আক্ষেপ করে বললেন, দেড় বছর ঘোরাঘুরির পর জানতে পারলাম কী করতে হবে। স্থানীয়ভাবে এসব তথ্য জানানো হলে এত ভোগান্তি হতো না।
মো. সেলিমের বাবার নাম মো. হজরত আলী ভান্ডারী, মায়ের নাম জহুরা খাতুন। তাঁর নামে দুটি জন্মনিবন্ধন রয়েছে। ডিএনসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জন্মনিবন্ধন ‘রিসেট’ করতে বলা হয়। তবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে আসার পর তিনি জানতে পারেন, ‘রিসেট’ নয়, তাঁকে জন্মনিবন্ধন হস্তান্তর অর্থাৎ বাতিলের জন্য আবেদন করতে হবে। পরে তা-ই করেছেন। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় তদন্ত করে সেই প্রতিবেদন পাঠাবেন ওয়ার্ড কার্যালয়ে। সে জন্য মাসখানেক সময় লাগবে। এরপর তাঁকে নতুন করে জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে।
সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সাড়ে পাঁচ বছর ও এক বছর বয়সের দুই ছেলেমেয়ে আছে। নিজের জন্মনিবন্ধন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তিনি সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করাতে পারছেন না।
সাত মাস পর সমাধান হলোনরসিংদীর শহীদুল ইসলামের জন্মনিবন্ধন করানো হয়েছিল মো. শহীদ শেখ নামে, ২০২২ সালে। একই নামে জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়। কিন্তু ছেলেমেয়েদের শিক্ষাগত সব সনদে তাঁর নাম শহীদুল ইসলাম।
শহীদুলের পুত্রবধূ ফৌজিয়া ইয়াছমিন প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৪ সালে শহীদুল ইসলাম নাম দিয়ে তাঁর শ্বশুরের আরেকটি জন্মনিবন্ধন করানো হয়। গত বছরের নভেম্বরে জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করতে গেলে বলা হয়, অনলাইনে দুটি জন্মনিবন্ধন রয়েছে। এটি সংশোধন না করলে জাতীয় পরিচয়পত্রও সংশোধিত হবে না।
ফৌজিয়া ইয়াছমিন বলেন, এর পর থেকে তাঁরা ছুটতে ছুটতে হয়রান। তাঁদের বলা হয়, প্রথম যে জন্মনিবন্ধন রয়েছে, সেটি রাখতে হবে। পরে শ্বশুরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সনদ প্রমাণ হিসেবে জমা দিয়ে প্রথম জন্মনিবন্ধন বাতিলের আবেদন করা হয় ১৬ জুন। পরে ২৭ জুন তাঁদের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, প্রথম জন্মনিবন্ধনটি বাতিল হয়েছে। এদিন ফৌজিয়া স্বস্তি প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, সাত মাস পর সমস্যার সমাধান হলো। এখন তাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে পারবেন।
বেশি লাগার অভিযোগ‘সার্ভার ডাউন’ ও ই-পেমেন্টের কারণে ২০২৩ সালে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে জনসাধারণকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। ওই সময় সার্ভারের সক্ষমতাও কম ছিল। পরে সার্ভারের সক্ষমতা বাড়ানোসহ আগের মতো হাতে হাতে ফি পরিশোধ ব্যবস্থা রাখায় ২০২৪ সালে ভোগান্তি অনেকাংশে দূর হয়েছিল। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা আত্মগোপনে চলে যান। এ পরিস্থিতিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে আবারও ভোগান্তি শুরু হয়। দুই মাসের বেশি সময় পর্যন্ত বেশির ভাগ জায়গায় নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
পরে প্রশাসক নিয়োগ করে সংকট দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভার ক্ষেত্রে এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন দিচ্ছেন আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সিটিতে সংশোধনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের অনুমোদন লাগে।
জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিয়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কাজের ফলে কোথাও কোথাও বেশি লাগছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, আবেদনপত্রে ভুল থাকার কারণে কোনো কোনো আবেদনকারীর সনদ পেতে সময় বেশি লাগছে। বাকিদের ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে তাঁরা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদ দিয়ে দিচ্ছেন।
তবে উপজেলা পর্যায়ের অনেক ভুক্তভোগীর মতে, ইউএনওরা একই সঙ্গে এলাকার অনেক কাজে যুক্ত থাকেন। মাসে একবার নিবন্ধনের আবেদনগুলোতে সই করার জন্য পৌরসভায় আসেন। এর আগে থানাগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সইও নিতে হয় নিবন্ধনে। তিনিও মাসের কোনো এক দিন আবেদন ফরম যাচাইয়ের পর সই করেন। ফলে নিবন্ধনে সময় লাগছে।
আরও পড়ুনজন্মনিবন্ধন সংশোধনে দেড় লাখের বেশি আবেদন৩১ অক্টোবর ২০২৪রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার বাসিন্দা জুলফিকার আলী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়ের জন্মসনদ ডিজিটাল করার জন্য আবেদন করার পাঁচ মাস পর তা পেয়েছিলেন। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি আবেদন করেছিলেন, পেয়েছিলেন মে মাসের মাঝামাঝি। জুলফিকার আলী বলেন, নিবন্ধন পেতে পৌরসভা কার্যালয়ে তিনি কয়েকবার গেছেন। তাঁকে বলা হতো, ‘সই হয়ে আসেনি।’
একই এলাকার আবদুর রাজ্জাক তাঁর মেয়ের মৃত্যুসনদ পেয়েছিলেন এক মাস পর, গত ১৫ মে। ঋণসংক্রান্ত কাজে মেয়ের মৃত্যুনিবন্ধন সনদ পাওয়া জরুরি ছিল। আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর মেয়ে রিশিতা আক্তার (২৬) বেঁচেছিলেন ৯ মাস। গত এপ্রিলে তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতের বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসা করতে গিয়ে ২২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। মেয়ের নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কারণে মেয়ের মৃত্যুনিবন্ধন সনদ জরুরি ছিল।
ছোটাছুটির কথা বলতে গিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘না হলেও ১০ দিন পৌরসভায় গেছি সনদ হয়েছে কি না, তা জানার জন্য। ওখানে না গেলে এই ভোগান্তির কথা কেউ বুঝবে না। শুধু জন্মনিবন্ধন নয়, নাগরিক সনদ নিতেও মাসের পর মাস ঘুরছে মানুষ। আগে এসব সনদ কাউন্সিলরদের কাছে গিয়ে দুই-তিন দিনের মধ্যে পাওয়া গেছে।’
পবার ইউএনও আরাফাত আমান আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধন নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ করার কারণ নেই। তিনি নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে একবারে অনেক সনদে সই করে দেন। ব্যস্ততার কারণে কখনো কখনো কিছুটা দেরি হলেও হতে পারে।
আরও পড়ুনঢাকা দক্ষিণ সিটির জন্মনিবন্ধন নিয়ে পাসপোর্টসহ সব জটিলতা কাটল১৫ আগস্ট ২০২৪আরও পড়ুনএকাধিক জন্মসনদ বাতিলে এল নতুন নিয়ম২৫ জুলাই ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত র প রথম আল ক ন র জন য দ ড় বছর হয় ছ ল ম স পর র জন ম প রসভ উপজ ল সমস য সনদ প
এছাড়াও পড়ুন:
মাত্র ২০ মিনিটে পাসপোর্ট আবেদন করা যাবে যেখানে
হাজারীবাগের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সেলিম। সাতসকাল থেকে ব্যবসার কাজে আড়তে ঢোকেন। সেখান থেকে বের হতে হতে রাত ১২টা। অনেক দিনের ইচ্ছা তিনি পাসপোর্ট করবেন। কিন্তু হাজারীবাগ থেকে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট করার সময় কোথায় তাঁর। তাঁকে দেখা গেল ঢাকার নীলক্ষেতের নাগরিক সেবা কেন্দ্রে। পত্রিকায় সংবাদ দেখে এসেছেন পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে। তিনি বলেন, ‘আমার সময় কম। সারা দিন অনেক কাজ। এরই মধ্যে আবার পাসপোর্টের ফরম পূরণ বা পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার জন্য সুযোগ নেই। পত্রিকায় নাগরিক সেবা কেন্দ্রের খবর দেখে এসেছি পাসপোর্ট করাতে। মাত্র ২০ মিনিটে পাসপোর্টের সব তথ্য পূরণ করতে পারছি এখান থেকে। এখানে এসে জেনেছি, এখন পাসপোর্টসহ ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) সংক্রান্ত সেবা মিলবে এখানে।’
মোহাম্মদ সেলিমের পাসপোর্টের কাগজপত্র পূরণে সহায়তা করছিলেন নাগরিক সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. জাহিদ হাসান। ২০২৫ সালে স্থাপত্য ডিপ্লোমা করেন এই তরুণ। তিনি নীলক্ষেত নাগরিক সেবা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন।
জাহিদ বলেন, ‘আমার এই কেন্দ্র থেকে ১০-১৫ জন নানা ধরনের নাগরিক সেবা নিতে আসেন। বেশির ভাগ মানুষই জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) সংক্রান্ত তথ্য হালনাগাদ করতে আসেন। এখান থেকে মাত্র ১০০-২০০ টাকার মধ্যে সব সেবা নেওয়া যাচ্ছে।
সব মিলবে এক কেন্দ্রে
সরকারি বিভিন্ন সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে অনলাইনে ‘এক ঠিকানায় সকল নাগরিক সেবা’ স্লোগানে চালু হয় নাগরিক সেবা বাংলাদেশ। গত মে মাসে এই কার্যক্রমের পাইলট প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রশিক্ষিত নাগরিক সেবা উদ্যোক্তারা এই সেবাগুলো নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে সাধারণ নাগরিকদের প্রদান করছেন। পাইলট প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর গুলশান, উত্তরা ও নীলক্ষেত এলাকায় নাগরিক সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তান, বনশ্রী ও মোহাম্মদপুরে আরও তিনটি নাগরিক সেবা কেন্দ্র চালু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উদ্যোগে এবং সরকারের আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলছে এই সেবা। এই সেবার আওতায় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য নিয়মিতভাবে সেবার হালনাগাদ ও সমন্বয়ের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এই ওয়েবসাইট (https://www.nagoriksheba.gov.bd/) থেকে দেখা যায়, জনপ্রিয় সেবার মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-রিটার্ন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ই-মিউটেশন, ভূমি কর, ই-পরচা, অনলাইন জিডি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যয়ন, সার্টিফিকেট সত্যয়ন ও ই-পাসপোর্ট সেবা।
যেসব সেবা মিলছে
নীলক্ষেত সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্ত জাহিদ হাসান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র আবেদন থেকে শুরু করে ইউটিলিটি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এখানে। প্রতিটি কেন্দ্রে আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে নাগরিকদের জন্য। নাগরিক সেবা কেন্দ্র সাধারণ মানুষের দীর্ঘ ভ্রমণ বা লাইনের প্রয়োজন দূর করছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ই-মিউটেশন, ই-পরচা, ভূমি কর; রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুনিবন্ধন; বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নতুন ভোটার নিবন্ধন, কার্ড পরিবর্তন; বাংলাদেশ পুলিশের অনলাইন জিডিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কাপড় বিক্রয়ের লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষানবিশির জন্য আবেদন, ময়ূর ক্রয়ের জন্য আবেদন, নার্সারি থেকে অনলাইনে চারা ক্রয়ের জন্য আবেদনের মতো বিভিন্ন বিষয়ে আবেদন করা যাচ্ছে এসব কেন্দ্র থেকে।
সুযোগ থাকলেও সেবা নেই
২২ অক্টোবর গুলশানের নাগরিক সেবা কেন্দ্রে নিজের জন্মনিবন্ধন করার উদ্দেশ্যে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আলিমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম অনেক সুবিধা পাব এখানে, ভেবেছিলাম এক স্থান থেকেই সেবা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারব। কিন্তু জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে দেখি এখান থেকে কেবল আবেদন করা যাচ্ছে, যেটা নিয়ে আমাকে আবার কমিশনার কার্যালয়ে যেতে হবে, অথচ আবেদনের কাজটি আমি বাসা থেকেই করতে পারতাম কিংবা একজন সাধারণ কম্পিউটার দোকান থেকেও করা যেত।’ এ কথার উত্তরে নাগরিক সেবা উদ্যোক্তা মীর ফাতেমা বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন সার্ভারের এক্সেস না থাকায় সেবাকেন্দ্র থেকে আবেদন, ভেরিফিকেশন ও জন্মনিবন্ধন সনদ প্রিন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে পরিপূর্ণ সুবিধা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেবাকেন্দ্রে আসা আরেকজন নাগরিক জানান, গুলশানের নাগরিক সেবা কেন্দ্রটি মহাখালী বা কড়াইল বস্তিতে থাকা ভাসমান বা নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য বড় সেবা কেন্দ্র হতে পারে। অনেক মানুষের এখনো জন্মসনদ নেই। এখানে এসে জন্মসনদ করার সুযোগ আছে। তবে সম্পূর্ণ প্রসেসটি এখান থেকেই করা গেলে জনদুর্ভোগ কমত এবং ভাসমান ব্যক্তিরাও জন্মনিবন্ধনের সুযোগ পেত।
গুলশান নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, দ্রুতই এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আরও নতুন নতুন সেবা নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে নেওয়া যাবে। সেবা কেন্দ্র পরিচালনায় নারী উদ্যোক্তারা আছেন বলে অনেক নারী ও শিশু-কিশোরবান্ধব এখানকার পরিবেশ। পাইলট পর্যায় থেকে সরাসরি চালু হলে অনেক সেবার সুযোগ মিলবে।
প্রথম সিটিজেন সার্ভিস কানেকটিভিটি হাব
নাগরিক সেবা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বিশেষ উদ্যোগ। তৃণমূল পর্যায়ে ডিজিটাল সরকারি সেবাগুলো আরও সহজলভ্য করে তুলছে এই কেন্দ্র। প্রশিক্ষিত উদ্যোক্তাদের পরিচালিত স্থানীয় সেবা কেন্দ্রের বর্ধমান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, নাগরিকেরা দ্রুত, পেশাদারভাবে এবং বাড়ির কাছেই প্রয়োজনীয় কাজে সহায়তা পাচ্ছেন। বর্তমানে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) সংক্রান্ত সেবাসহ বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদের মোট ৪০০টি সেবা নিয়ে নাগরিক সেবার পাইলট এবং লার্নিং প্রোগ্রাম চলছে। প্রতিটি সরকারি অফিসের সেবাকে এক জায়গায় এনে নাগরিকদের হয়রানিমুক্ত সেবাদানের লক্ষ্যে নাগরিক সেবার মাধ্যমে ‘ন্যাশনাল এপিআই কানেকটিভিটি হাব’ তৈরি করা হচ্ছে। এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন অফিসের ওয়েবসাইটে গিয়ে আলাদাভাবে সেবার আবেদন করার প্রয়োজন পড়বে না। বরং এক জায়গায় সব সেবা পাওয়ার জন্য একটি ন্যাশনাল কানেকটিভিটি হাব দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সব সেবা এক জায়গায় দিতে এটি বাংলাদেশের প্রথম সিটিজেন সার্ভিস কানেকটিভিটি হাব।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উদ্যোগে এবং আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে নাগরিক সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) জানিয়েছে, বিভিন্ন সরকারি অফিসের সেবাকে এক ছাদের নিচে আনার জন্য নাগরিক সেবা কেন্দ্র ধারণাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে। নাগরিকেরা যেন বাড়ির আশপাশে সরাসরি বিভিন্ন নাগরিক সেবা গ্রহণ করতে পারে, তার সব সুবিধা আছে এখানে। প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে নাগরিক সেবা কেন্দ্র। এসব সেবা কেন্দ্র স্থানীয় উদ্যোক্তারা পরিচালনা করছেন বলে এলাকাভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের এসব নাগরিক সেবা কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন সেবা কেন্দ্রের ঠিকানা:১. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, গুলিস্তান
ঠিকানা: রমনা টেলিফোন ভবন, গুলিস্তান (নগর ভবনের পাশে)। গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/cAet4WzmPEBeJTXG9) । ফোন: ০১৭৪৪৯৮৭৬০৬
২. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, বনশ্রী
ঠিকানা: হাউস নম্বর ১/এ, রোড ০২, ব্লক ডি, বিটিসিএল, বনশ্রী, ঢাকা-১২১৯১ গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/LifX6NDRcU22dazD7)। ফোন: ০১৮১১২৫৬৩৪১
৩. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, মোহাম্মদপুর
ঠিকানা: প্লট-৪৭, আসাদ অ্যাভিনিউ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭। গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/DHqACmu21nys38nh9)। ফোন: ০১৭১৮৮৬৩৩৭১
৪. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, গুলশান
প্লট নম্বর-২৫, রোড-১৬, গুলশান-১, ঢাকা, গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/9btSKptu5nsR92VaA)
ফোন: ০১৯১১৩১০৩৫৭
৫. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, উত্তরা
ঠিকানা: ৩ এবং ৫, শাহজালাল অ্যাভিনিউ, সেক্টর-৬, উত্তরা, ঢাকা, গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/N93mhjMjK294wmAG6)। ফোন: ০১৯১৩৭৩৭৩৪৭
৬ নাগরিক সেবা কেন্দ্র, নীলক্ষেত
ঠিকানা: নীলক্ষেত টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, ১, বাবুপুরা রোড, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫, গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://g.co/kgs/tNihsqQ)
ফোন: ০১৪০৯৫৬২৩৯৩