ভুয়া সংবাদ প্রত্যাহারসংক্রান্ত গবেষণায় প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জড়িয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে জানাল প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)। সংস্থাটি আজ রোববার এক ব্যাখ্যায় বলেছে, প্রত্যাহার করা সব সংবাদ অপতথ্য না–ও হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে ‘কোনো কোনো গণমাধ্যমে অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে’।

রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) সেমিনার কক্ষে ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক অপতথ্যের গতি-প্রকৃতি’ শীর্ষক এক সেমিনারে গতকাল শনিবার একটি চলমান গবেষণায় পাওয়া তথ্য তুলে ধরেন সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) একটি প্রকল্পের পরামর্শক মামুন-অর-রশীদ। তিনি গবেষণাটি করছেন পিআইবির পক্ষে।

মামুন-অর-রশীদের উপস্থাপনার একটি অংশে বলা হয়, ছয় মাসে প্রথম আলো সবচেয়ে বেশি—১২১টি ভুয়া সংবাদ প্রত্যাহার করেছে। এর পরে রয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, যুগান্তর ও সমকাল। কিন্তু একই স্লাইডে যে লেখচিত্র উপস্থাপন করা হয়, সেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে কালবেলা, তৃতীয় ইত্তেফাক ও চতুর্থ অবস্থানে যুগান্তরকে দেখানো হয়।

পিআইবির সেমিনারের পর কয়েকটি গণমাধ্যম ভুয়া সংবাদ প্রত্যাহারের পরিসংখ্যান ধরে খবর প্রকাশ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি আলোচনা হয়। তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকারদের কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট গবেষণার মেথড বা পদ্ধতিতে গলদ থাকতে পারে বলে উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এমন পরিস্থিতিতে আজ সন্ধ্যায় পিআইবি ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি পাঠায়।

ভুয়া সংবাদ প্রত্যাহার বিষয়ে তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে শনিবারই গবেষকের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তিনি আজ রাতে লিখিত বক্তব্যে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবারের সেমিনারটি ঘিরে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে। তিনি এমনভাবে সংবাদ পরিবেশনের তীব্র নিন্দা জানান এবং আরও পেশাদার মনোবৃত্তি নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় প্রথম আলো সংবাদ প্রস্তুত ও পরিবেশনে সর্বাধিক কিউরেশন (যাচাই–বাছাই) করে থাকে। স্পষ্টীকরণ বিবৃতির পর আশা করি এ ব্যাপারে মিস কনসেপশন (ভুল ধারণা) থাকবে না।’

পিআইবি দীর্ঘ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। ‘“বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অপতথ্যের গতি-প্রকৃতি” বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা’ শিরোনামের বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, সেমিনারে মূল প্রবন্ধকারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা বক্তব্য দেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো কোনো গণমাধ্যমে অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

‘উপস্থাপনার একটি দিক হলো অনলাইন গণমাধ্যমে প্রত্যাহারকৃত সংবাদ ও অপতথ্যবিষয়ক ডেটার একটা তুলনামূলক চিত্র। কিন্তু এটা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছে, যাতে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও শিরোনাম করা হয়েছে’, বলা হয় ব্যাখ্যায়।

সংবাদপত্রের ওয়েবসাইটের ৪০৪ বার্তা (404 Page Not Found) সংবলিত লিংক বিশ্লেষণের কথা উল্লেখ করে পিআইবির ব্যাখ্যায় বলা হয়, স্লাইডে উপস্থাপিত সংখ্যা প্রত্যাহারকৃত সংবাদ চিহ্নিত করে, যেগুলোর মধ্যে অপতথ্যও রয়েছে। সব ডেটা অপতথ্য না–ও হতে পারে, কিন্তু সব কটিই প্রত্যাহারকৃত সংবাদের নমুনা পরিসংখ্যান। বক্তব্যে এই ব্যাপারটি উল্লেখ করলেও প্রেজেন্টেশনের (উপস্থাপনা) স্লাইডের লেখায় তা উল্লেখ করা হয়নি, ফলে কিছু অস্পষ্টতার অবকাশ রয়ে যায়।

উল্লেখ্য, ৪০৪ বার্তার মানে সংশ্লিষ্ট লিংকে গিয়ে প্রতিবেদনটি আর পাওয়া যায়নি। এটা ‘ডেড লিংক’ নামে পরিচিতি। কেন ‘ডেড লিংক’ তৈরি হয়, জানতে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরা জানান, কোনো সংবাদ প্রত্যাহার করলে যেমন সংশ্লিষ্ট লিংকে ‘৪০৪’ বার্তা আসতে পারে, তেমনি অন্য অনেক কারণ রয়েছে। অনেক সময় ওয়েবসাইট ‘রি-ডিজাইন’ করা, আর্কাইভ নীতি ও ব্রোকেন ইউআরএলসহ নানা কারণে ‘ডেড লিংক’ তৈরি হতে পারে। শুধু ভুয়া তথ্যের কারণে সংবাদ প্রত্যাহার করা হয় না, আরও কারণ থাকতে পারে।

প্রথম আলো গবেষক মামুন-অর-রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলোর ডেড লিংক চায় শনিবার। আজ রাতে তিনি তা পাঠান। লিংকগুলোর মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি যাচাই করে দেখা যায়, কিছু কনটেন্ট (আধেয়) একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। বিভ্রান্তি এড়াতে একটি লিংক রেখে অন্যগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে ভুয়া সংবাদ প্রকাশ বা তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিরোনামের প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে রয়েছে।

প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন বলেন, কোনো সংবাদ প্রকাশের পর তা ভুয়া শনাক্ত হলে প্রথম আলো ঘোষণা দিয়ে তা প্রত্যাহার করে। প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকা ও অনলাইন সংস্করণের জন্য সংবাদ প্রত্যাহার, ভুল সংশোধন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারসহ নানা বিষয়ে নীতিমালা রয়েছে। প্রথম আলো সেসব নীতিমালা অনুসরণ করে। ভবিষ্যতে আরও সতর্কভাবে তা অনুসরণ করা হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল র প রক শ ত উপস থ প অপতথ য প আইব র একট

এছাড়াও পড়ুন:

‘মিস ইনফরমেশন শেয়ার করার বড় মাধ্যম ফটোকার্ড’

বাংলাদেশের মিডিয়া হাউজগুলো মনে করে ফ্যাক্টচেক এর পেছনে টাকা খরচ অতিরিক্ত, যেটা তারা চান না। অথচ মিস ইনফরমেশন শেয়ার করার একটি বড় মাধ্যম হলো ফটোকার্ড। ভাইরাল ঘটনার খবর গণমাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার হয়। ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম সাম্প্রতিক অপতথ্যের গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। শনিবার রাজধানীর সার্কিট হাউস রোডে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) সেমিনার কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারটিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়ব, মূল প্রবন্ধ পড়েন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ (ইবিএলআইসিটি) প্রকল্পের পরামর্শক মামুন–উর–রশীদ, সভাপ্রধান হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। 

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আমাদের মিডিয়া হাউজগুলো মনে করে ফ্যাক্টচেক এর পেছনে টাকা খরচ অতিরিক্ত, যেটা তারা চান না। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকারই এই ইনভেস্টমেন্ট নাই। ফেইক ভিডিও, স্ক্রিপটেড ভিডিও এসব কিছুই ছড়ায়, ছড়াবেও কিন্তু পত্রিকাগুলো এ ধরনের কাজগুলো রুখে দিতে চায় কিনা, পেইড টুলসগুলো কিনে প্রতিটাই রুখে দিতে পারে কিনা, তা দেখতে হবে। 

তিনি বলেন, বর্তমানে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সত্যের চেয়ে ভাইরাল হওয়ার দিকেই মনোযোগ বেশি। এ ধরনের খবর গণমাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করা হয়। ভাইরাল নিউজের বাণিজ্যিক ও আর্থিক মূল্য আছে বলে সেটা করা হচ্ছে। এই চিন্তাধারা থেকে বের হওয়া না গেলে দেশের গণমাধ্যমগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।

পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ সূচনা বক্তব্যে গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতার চিত্র তুলে ধরে বলেন, রাষ্ট্র নিজে মিথ্যার কারখানায় পরিণত হয়েছিল এবং সংবাদমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার ফেরিওয়ালা। 

গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুমের ঘটনা ঘটানোর জন্য শিকারি সাংবাদিকতা করা হয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

ফারুক ওয়াসিফ বলেন, সাংবাদিকরা গত ১৫ বছর পেশাগতভাবে হুমকিতে ছিলেন। তারা রাজনৈতিকভাবে কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। মূলধারার গণমাধ্যম এখনও সত্য প্রকাশে দ্বিধান্বিত। মূলধারার গণমাধ্যমে কী ধরনের অপতথ্য ছড়ানো হয় এবং তা কীভাবে রুখে দেওয়া যায় সেটা নিয়ে কাজ হওয়া দরকার। অপতথ্যকে বা গুজবকে শুধু ফ্যাক্টচেক দিয়ে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। এটাকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে।

মামুন-উর-রশীদ বলেন, মিডিয়া হাউজ যদি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাহলে সেটা পুরো সোসাইটির জন্য হুমকিস্বরূপ। 

৫ আগস্টের পর বিভিন্ন হাউজের সংবাদ প্রকাশের ডেটাসহ বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলের অপতথ্য ছড়ানোর হার নিয়ে বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করে তিনি বলেন, মেইনস্ট্রিম মিডিয়া আমাদের দেশে সরব। আর বাংলাদেশে মিস ইনফরমেশন শেয়ার করার একটি বড় মাধ্যম ফটোকার্ড।

সেমিনারে প্রবন্ধের ওপর মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। এতে বক্তব্য রাখেন- প্রথমা প্রকাশনার প্রধান সমন্বয়কারী মশিউল আলম, একাত্তর টিভির সিওও শফিক আহমেদ, যুগান্তরের নগর সম্পাদক মিজান মালিক প্রমুখ। 

সংবাদমাধ্যমে অপতথ্য মোকাবিলায় গণমাধ্যমকর্মীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের বিষয়গুলোকে তুলে ধরেন তারা। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন পিআইবির জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা গোলাম মোর্শেদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘মিস ইনফরমেশন শেয়ার করার বড় মাধ্যম ফটোকার্ড’
  • ভাইরাল ঘটনার খবর গণমাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার হয়: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
  • ‘অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়তে মেটাকে কার্যকর উপায় খুঁজতে হবে’