আশরাফুর রহমান আকন্দ। জামালপুরে জন্ম নেওয়া এই সাংবাদিক ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) বাংলা বিভাগ ‘রেডিও তেহরান’-এ কর্মরত। ইরান–ইসরায়েল সংঘাতের সময় তিনি তেহরানে দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র। যুদ্ধের ভয়াবহতা, কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি, যুদ্ধবিরতি, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ, ইরানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন রাইজিংবিডির সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির সহকারী বার্তা সম্পাদক সাইফ বরকতুল্লাহ

রাইজিংবিডি: ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধ আপনি তেহরানে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছে। সেই সময়টা কেমন ছিল? 

আশরাফুর রহমান আকন্দ: ১৩ জুন রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানী তেহরানসহ ইরানের কয়েকটি স্থানে আকস্মিকভাবে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। আকস্মিক হামলা এজন্য বলছি যে, ১৫ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ষষ্ঠ দফা পরমাণু আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আলোচনার আগে মার্কিন মদদে ইসরায়েল হামলা চালাবে- ইরানিরা তা ভাবতেও পারেনি। 

যাই হোক, ইসরায়েল যখন অবৈধভাবে আগ্রাসন চালায় তখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে মোবাইল ফোনে ইরানি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে খোঁজ নিতে থাকি, ঠিক কী হয়েছে জানার জন্য। জানতে পারি ইসরায়েলি হামলায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, তেহরানের খাতামুল আম্বিয়া সামরিক ঘাঁটির কমান্ডার জেনারেল গোলাম আলী রাশিদ এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরিসহ অনেকেই শহীদ হয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় এই তিন কমান্ডার নিহত হবার খবরে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। মন বলছিল এই বুঝি-ইরানের প্রতিশোধ হামলা শুরু হবে! কিন্তু না, ইরানের পাল্টা হামলা শুরু হয় ১০ ঘণ্টা পর, দিবাগত রাত দেড়টায়। তার আগে অবশ্য শহীদ কমান্ডারদের শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দেন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী। তিনি এক ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দেন- “এই অপরাধের মাধ্যমে ইহুদিবাদী সরকার নিজেদের জন্য একটি তিক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি ডেকে এনেছে এবং নিশ্চিতভাবেই তারা সেই পরিণতি ভোগ করবে।” 

এরপর টানা ১২ দিন চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি হামলা। যুদ্ধের দিনগুলোতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয় ও আতঙ্কে সময় কেটেছে। তবে সবসময় চেষ্টা করেছি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। যুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের খবর শেয়ার করেছে রেডিও তেহরানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পার্সটুডের ওয়েবসাইট ও আমার ফেসবুক টাইমলাইনে। যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছি পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। তবে যুদ্ধের ৬ দিন পর সরকার ইন্টারনেটের ওপর সীমাদ্ধতা আরোপ করে। 

তখন আর কোথাও অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারিনি। টানা দুই দিন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলাম নেট দুনিয়া থেকে। আমার সংবাদ না পেয়ে পরিবার ও স্বজনরা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন— পরে জানতে পারি। 

যুদ্ধের দিনগুলোতে তেহরানে জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটে। অনেকেই তেহরান ছেড়ে গ্রামে চলে যান। আমি যে বাসায় থাকি সেখানকার পাঁচটি পরিবারের তিনটিই চলে গিয়েছিল। অধিকাংশ অফিস ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পাবলিক বাস, ট্রেন, পাতাল রেল চললেও যাত্রী ছিল সীমিত। 

সারাদিন ব্যস্ত সময় পার করে রাতে ঘুমাতে গেলেও ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। রাতে কয়েক দফা তেহরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হতে দেখেছি। আমার বাসার জানালা দিয়ে দেখেছি ইসরাইলি ড্রোন প্রতিহত করার দৃশ্য। কয়েকবার মোবাইল ফোনে ভিডিও করেছি রোমাঞ্চকর সেই ‘আকাশ যুদ্ধ’। সাংবাদিক হিসেবে এমন বাস্তব যুদ্ধ দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।

রাইজিংবিডি: ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় তেহরানে রেডিওতে দায়িত্ব পালন করেছেন, যেদিন সম্প্রচার কেন্দ্রে হামলা হলো— সে সময় কী ভাবছিলেন?

আশরাফুর রহমান আকন্দ: ১৩ জুন হামলার দিন থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত আমাদের অফিস চলেছে স্বাভাবিক নিয়মে অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। ১৬ তারিখে আমার অফিস ছিল সকাল ৭টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত। অফিস শেষে আমি ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) সদর দপ্তরের রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করি। আইআরআইবি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ভবন থেকে সদর দপ্তরের দূরত্ব ৩০০ মিটারের মতো। আমাদের অফিস ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ভবনে।

লাঞ্চ সেরে বাসায় ফিরি বেলা দুইটার দিকে। বিকেল পাঁচটার দিকে এক সহকর্মীর মাধ্যমে খবর পাই আমাদের অফিস খালি করার জন্য ইসরায়েল ৩০ মিনিট সময় বেঁধে দিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপত্তাকর্মীরা সবাইকে অফিস থেকে সরিয়ে নেন। বিকেলে সাড়ে পাঁচটার দিকে চারটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে আইআরআইবির সদর দপ্তরে। সে সময় ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠান চলছিল। লাইভ চালাতে থাকেন উপস্থাপিকা সাহার ইমামি। তার উপস্থাপনা দেখে মনে হয়েছে, সাংবাদিকতা তখন কেবল পেশা ছিল না, সেটা দায়িত্ব ও প্রতিরোধের অংশ হয়ে উঠেছিল। আমিও তার দায়িত্বানুভূতি থেকে প্রেরণা নিয়ে চালিয়ে গিয়েছি আমেরিকা-ইসরায়েলবিরোধী ‘মিডিয়া যুদ্ধ’! 

রাইজিংবিডি: ইরানে ইসরায়েলের হামলার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নানা তথ্য আসছে। আসলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে— আপনার মতামত জানতে চাই।

আশরাফুর রহমান আকন্দ: আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, ইরান সরকার শুরু থেকেই তার ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ প্রকাশ করে আসছে; ইসরায়েলের মতো তারা কোনো সেন্সরশিপ আরোপ করেনি। তবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি, হয়তো সময় লাগবে।

গত বুধবার ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় ১২ দিন ধরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত ৬২৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৭০ জন। নিহতদের মধ্যে কমান্ডারসহ ৫৬ জন সেনা সদস্য, ১৪ জন পরমাণু বিজ্ঞানী, ৯ জন গণমাধ্যমকর্মী রয়েছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে মাসুমাহ আজিমি এবং নিমা রাজাবপুর আইআরআইবির ভবনে ইসরাইলি হামলায় শহীদ হন।

শত শত নিরপরাধ মানুষ হত্যা ও বেসামরিক অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ এনে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের উচ্চ মানবাধিকার পরিষদের প্রধান নাসের সেরাজ গত শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের কাছে একটি প্রতিবাদপত্র জমা দেন।

প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান ব্রডকাস্টিংয়ের (আইআরআইবি) কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর, স্বাস্থ্য ও সেবাকেন্দ্র, কারাগার, আবাসিক এলাকা এবং নগর ও গ্রামীণ অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে আবাসিক ভবনগুলোতে ইসরায়েলের হামলায় দেশটির একাধিক বিখ্যাত পরমাণুবিজ্ঞানীকে নিজ বাড়িতে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

আপনি জানেন যে, ইসরায়েল ও আমেরিকা ইরানের পরমাণু স্থাপনাতেও হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলি হামলা পরবর্তী প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন করে ইরানি গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, নাতাঞ্জ এবং ফোরদু পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

এরপর গত ২১ জুন মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের ফোরডো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালায়। এই হামলা বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের জন্ম দিলেও ইরান সরকার জানিয়েছে, এসব অঞ্চলের সাধারণ জনগণের জন্য তেমন কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়নি।

ইরানের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, মার্কিন হামলার আগে ইরানের বেশিরভাগ উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম গোপন ও নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “এই পদক্ষেপটি শনিবার ভোরেই সম্পন্ন হয় এবং এই কৌশলগত প্রস্তুতি ইরানের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়েছে।”

রাইজিংবিডি: যুদ্ধবিরতি চলছে। এর মাঝেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন চুক্তির বিষয়ে কথা বলছেন, নানা হুমকিও দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ইরানের অবস্থান কেমন মনে হচ্ছে?

আশরাফুর রহমান আকন্দ: মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই চুক্তি করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসে ইসরায়েলকে হামলার সবুজ সংকেত দেন এবং নিজেও ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করেন। মার্কিন হামলায় ‘ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে' বলেও দাবি করেন তিনি। তাহলে চুক্তির প্রশ্ন আসছে কেন? তার মানে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি।

আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তেহরানকে ফের আলোচনার টেবিলে আনতে চায়। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে ইরানকে সাহায্য করার জন্য আলোচনা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

এসবের মধ্যে রয়েছে- শান্তিপূর্ণ বেসামরিক জ্বালানি উৎপাদন পারমাণবিক কর্মসূচি গড়তে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা এবং বিদেশে আটকে থাকা ইরানের ছয় বিলিয়ন ডলার ছাড় করা।

কিন্তু ইরান কোনো প্রলোভন কিংবা হুমকির কাছে মাথানত করবে না। ইরান এখন আর আগের ইরান নেই। যুদ্ধের পর ইরান সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। ইরানের পার্লামেন্ট (মজলিস) ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে তেহরানের সহযোগিতা স্থগিত করার একটি বিল অনুমোদন করেছে। পার্লামেন্টের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ইরানের পরমাণু সুবিধাগুলোর নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরমাণু কার্যক্রম নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আইএইএ পরিদর্শকদের দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। ইরান স্পষ্টভাবে বলেছে, "শত্রুদের চক্রান্ত ও অপতৎপরতা সত্ত্বেও আমাদের হাজার হাজার বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞের প্রচেষ্টায় আমরা এই শিল্পের বিকাশ অব্যাহত রাখব, আমাদের পারমাণবিক অর্জন বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে।’’

রাইজিংবিডি: যুদ্ধের পর ইরান নতুনভাবে বিশ্বে শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত। আগামী দিনে পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসতে পারে?

আশরাফুর রহমান আকন্দ: বিশ্লেষকদের ধারণা একদম সঠিক। ইরানি হামলায় ইসরাইলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, গাজাবাসীর নতুন প্রতিরোধ, তেল আবিবে নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভ, ইরান, ইরাক, ইয়েমেন, লেবানন এবং ফিলিস্তিনে বিজয় মিছিল তাই প্রমাণ করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনী যুদ্ধবিরতির পর গত বৃহস্পতিবার ভিডিও বার্তায় বলেছেন, "এতসব হইচই, প্রচারণা ও দাবি সত্ত্বেও ইহুদিবাদী ইসরাইল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আঘাতে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে এবং পিষে গেছে। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, তিনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করেছেন। এর ফলে তারা ইহুদিবাদীদের উন্নত ও বহু-স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে এবং শত্রুদের অনেক সামরিক এলাকা ও শহরের বিভিন্ন স্থানকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পেরেছে।’’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, "মার্কিন রেজিম সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছিল, কারণ তারা ভেবেছিল- যদি তারা যুদ্ধে না জড়ায় তাহলে ইহুদিবাদী ইসরাইল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা এটিকে বাঁচাতে যুদ্ধে জড়িয়েছিল, কিন্তু কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আমেরিকার গালে শক্ত চপেটাঘাত করেছে।’’

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেছেন, "আমরা ইহুদিবাদী সরকারকে জানিয়েছি যে, ইরান লেবানন নয় এবং যুদ্ধবিরতির যে কোনো লঙ্ঘনের দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে জবাব দেওয়া হবে।’’

ইরানি নেতাদের কথাবার্তায় মনে হয়, আগামী দিনে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি আরো বাস্তববাদী ও অঞ্চলকেন্দ্রিক হবে। ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধ ফ্রন্টকে ঢেলে সাজানো হবে। ইরান হবে সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদীদের আতঙ্ক আর মুসলিম বিশ্বে হবে রোল মডেল।  

রাইজিংবিডি: আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পরিবর্তন চায় আমেরিকা-ইসরায়েল। তবে তাঁর বয়স এখন ৮৪ বছর। তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরি কে হতে পারেন?

আশরাফুর রহমান আকন্দ: আমেরিকা-ইসরায়েলের প্রত্যাশা অনুযায়ী ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে পরিবর্তন আসবে না। পশ্চিমা গণমাধ্যমে আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর উত্তরসূরীদের নাম ঘোষণা করা হলেও ইরানিরা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। কারণ সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের কাজটি করে ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদ (অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টস)। এই পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৮৮ জন। তারা জনসাধারণের সরাসরি ভোটে ৮ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।

যদি সর্বোচ্চ নেতা মারা যান, দায়িত্ব পালনে অযোগ্য বলে বিবেচিত হন বা পদত্যাগ করেন, তখনই এই পরিষদ নতুন নেতার জন্য প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করে। সর্বোচ্চ নেতা ইচ্ছে করলেই কাউকে তাঁর উত্তরসূরী নিযুক্ত করতে পারেন না। 

রাইজিংবিডি: যুদ্ধবিরতির পর ইরানে মানুষ উৎসব করেছে। সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন?

আশরাফুর রহমান আকন্দ: যুদ্ধবিরতির মানুষের মধ্যে এখন এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ও গর্ব কাজ করছে। কারণ তারা জানে, ইরানের হামলায় বেসামাল হয়ে পড়া ইসরায়েলকে বাঁচাতে মার্কিন সরকার প্রথমে আরব দেশগুলোর মাধ্যমে ইরানকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ইরান ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ইরান বলেছে, ‘‘যুদ্ধ তোমরা শুরু করেছো, শেষ করব আমরা।’’ বাস্তবে তাই হয়েছে, ইরানের দেওয়া সময়েও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। শেষ হামলাটাও ইরানই চালিয়েছে।

যাই হোক, শিশু হত্যাকারী ইসরায়েলকে দৃষ্টান্তমূলক জবাব দেওয়ায় জনগণ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করেছে। 

রাইজিংবিডি: গুপ্তচর সন্দেহে আপনাকে একবার আটক করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

আশরাফুর রহমান আকন্দ: আপনি জানেন যে, ইসরায়েলি হামলার সঙ্গে ইরানে বেশকিছু গুপ্তচর জড়িত ছিল। তাদের ধরতে যুদ্ধের দিনগুলোতে ইরানে চিরুনি অভিযান চালানো হয়। তেহরানে আমি যে এলাকায় থাকি সেখান থেকেও কয়েকজনকে আটক করা হয়। 

১৯ জুন রাত ৯টার দিকে বাসার কলিং বেল ও দরজায় টোকা পড়ে। ওয়াশরুমে থাকায় দরজা খুলতে দেরি হয়। বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন বাসিজ বাহিনীর চার সদস্য, সশস্ত্র ও ইউনিফর্ম পরা। দেরিতে দরজা খোলায় সন্দেহ করে তারা জোরপূর্বক ঘরে ঢুকে আমার হাত বেঁধে, চোখ ঢেকে ফোন নিয়ে নেয়। আমাকে সন্দেহভাজন অপরাধীর মতোই আটক করে।

নিজেকে আইআরআইবির সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিলেও তারা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। তল্লাশির পরেও আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের আঞ্চলিক দপ্তরে নিয়ে যায়। পরে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এসে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, এক অপরাধীর ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে আনা হয়েছিল। বাসিজের আঞ্চলিক প্রধান ড.

ইসলামিও দুঃখ প্রকাশ করেন। তারা সব জিনিস ফিরিয়ে দেন এবং বাসায় পৌঁছে দিয়ে যান। ঘটনার পরও এক কর্মকর্তা ফোন করে খোঁজ নেন এবং ক্ষতিপূরণস্বরূপ দুই মিলিয়ন তুমান দেন। ভুল সন্দেহ ও আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা হলেও কর্মকর্তাদের আন্তরিকতায় কিছুটা স্বস্তি পাই।
 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সশস ত র ব হ ন ইসর য় ল র কর মকর ত কম ন ড র ১২ দ ন র জন য কর ছ ন আম দ র র অফ স প রস ত আম র ক লক ষ য ইসল ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে অভিযোগ ইরানের

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এনেছে ইরান। এ–সংক্রান্ত দাখিল করা এক প্রতিবাদপত্রে দেশ দুটির বিরুদ্ধে শত শত নিরপরাধ মানুষ হত্যা ও বেসামরিক অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়েছে।

ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের উচ্চ মানবাধিকার পরিষদের প্রধান নাসের সেরাজ গত শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের কাছে এই প্রতিবাদপত্র জমা দেন।

গত বুধবার ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় ১২ দিন ধরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত ৬২৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৭০ জন। ইরানের প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, এই সমন্বিত হামলা আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার আইন এবং মানবিক আইনের মৌলিক নীতিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন।

প্রতিবাদপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান ব্রডকাস্টিংয়ের (আইআরআইবি) কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর, স্বাস্থ্য ও সেবাকেন্দ্র, কারাগার, আবাসিক এলাকা এবং নগর ও গ্রামীণ অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে আবাসিক ভবনগুলোতে ইসরায়েলের হামলায় দেশটির একাধিক বিখ্যাত পরমাণুবিজ্ঞানীকে নিজ বাড়িতে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ইরানের মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এতে মানুষের জীবনধারণের অধিকার, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার অধিকার, চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকারসহ মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

এ ছাড়া বারবার আবাসিক ভবনে বোমাবর্ষণের হুমকির মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধের অধিকার এবং ইরানের আইআরআইবিতে হামলা চালিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও লঙ্ঘন করেছে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে পার্থক্য না করে চালানো হামলায় নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের পূর্ব সতর্কতা না দিয়ে তাদের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবাদলিপিতে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে অভিযোগ ইরানের