ইরান যুদ্ধ নিয়ে জনমত গঠনে কেন ব্যর্থ হলো পশ্চিমা বিশ্ব
Published: 30th, June 2025 GMT
২২ জুন মার্কিন যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে এবং ১৪টি বিশালাকৃতির বোমা নিক্ষেপ করে। এ হামলা কোনো উসকানির জবাবে ছিল না। অবৈধ ইসরায়েলি আগ্রাসনের (ইরানের ৬০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে) পথ ধরেই এটি হয়েছে।
এ যেন সেই পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে ওঠা দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি। একটি সাম্রাজ্য তার কল্পিত প্রাচ্যে (যেটিকে তারা ‘মধ্যপ্রাচ্য’ নামে ডাকে) নিরীহ মানুষের ওপর বোমা ফেলে আসছে। সেদিন রাতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দুই মন্ত্রীকে নিয়ে বিশ্বকে জানালেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দস্যু ইরানকে এখন শান্তি স্থাপন করতেই হবে।’
বোমা হামলাকে যেভাবে কূটনীতির ভাষায় মোড়ানো হলো আর ধ্বংসযজ্ঞকে যেভাবে স্থিতিশীলতার পোশাক পরানো হলো, তাতে আতঙ্কিত হতে হয়। এটিকে ‘শান্তি’ বলা শুধু ভুল শব্দের প্রয়োগ হয় না, এটি অপরাধমূলক বিকৃতিও। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় ‘শান্তি’ই–বা কী? সেটা পশ্চিমাদের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া কি আর কিছু? আর ‘কূটনীতি’ই–বা কী? আক্রান্তকেই আক্রমণকারীর কাছে করুণ অনুরোধ জানাতে বাধ্য করা?
ইরানে ইসরায়েলের অবৈধ হামলা ১২ দিন ধরে চলে। এ সময়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তোলা ইরানি শিশুদের ছবি পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় দেখা যায়নি। এর পরিবর্তে নিরাপদ বাংকারে আশ্রয় নেওয়া ইসরায়েলিদের নিয়ে বড় বড় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম ভাষা মুছে দেওয়ার কাজে খুবই নিখুঁত। তারা কেবল ভুক্তভোগী হিসেবে ইসরায়েলিদের উপস্থাপন করে চলে, যেটা এই যুদ্ধের বয়ানকেই জোরালো করে।
শুধু ইরানের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেনি। গত ২০ মাসে গাজার বাসিন্দাদের অনাহারে কষ্টে রাখা হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, ৫৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে; কিন্তু বাস্তব হিসাব বলছে, এই সংখ্যা লাখের ঘরে পৌঁছেছে। গাজার প্রতিটি হাসপাতালে বোমা হামলা করা হয়েছে। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে হামলা করা হয়েছে এবং ধ্বংস করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে। অথচ অধিকাংশ পশ্চিমা গণমাধ্যম এই শব্দটি উচ্চারণ করতেই চায় না, আর কেউ যদি সাহস করে সরাসরি টিভিতে বলে ফেলে, তাহলে তারা নানা রকম সতর্কতামূলক ব্যাখ্যা জুড়ে দেয়। উপস্থাপক ও সম্পাদকেরা সবকিছু করেন, শুধু তাঁরা ইসরায়েলের অন্তহীন সহিংসতাকে দৃঢ় কণ্ঠে স্বীকার করেন না।
ট্রাম্পের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের রাজনৈতিক অভিজাতদের অনেকেই নিজেদের শান্তির দূত হিসেবে জাহির করতে চান। অথচ তাঁরা নিজেরাই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে ‘শান্তি’ শব্দের অর্থই বদলে গেছে। তাঁদের কাছে শান্তি মানে পৃথিবীর চোখের সামনেই গণহত্যা ও নৃশংসতা চালানোর বাধাহীন স্বাধীনতা।যুদ্ধাপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে পশ্চিমা গণমাধ্যমে কোনো নিন্দা, সমালোচনা করা হয় না। তাদের যুদ্ধাপরাধের কোনো তদন্তও করা হয় না। ইসরায়েলি জেনারেলরা বেসামরিক নাগরিকদের বসতির আশপাশে যুদ্ধ-সভা করে। এরপরও কোথাও সমালোচনা করা হয় না, তারা কীভাবে সাধারণ ইসরায়েলিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ইসরায়েলি সেনা ও সরকারি কর্মকর্তারা নিয়মিত মিথ্যা বলে বা গণহত্যামূলক বক্তব্য দেয়। তবু তাদের বক্তব্যগুলোই ‘সত্য’ হিসেবে প্রচার করা হয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিবিসিতে ইসরায়েলিদের মৃত্যুর খবর ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ৩৩ গুণ বেশি প্রচার করা হয়েছে। অথচ ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর হার ইসরায়েলিদের তুলনায় ৩৪ গুণ বেশি। এই পক্ষপাত শুধু ব্যতিক্রম নয়। এটাই পশ্চিমা গণমাধ্যমের নিয়ম।
ফিলিস্তিনের মতো ইরানের ক্ষেত্রেও বেছে বেছে সতর্কতার সঙ্গে শব্দ ব্যবহার করা হয়। ইরানকে কখনো একটি দেশ হিসেবে তুলে ধরা হয় না, বরং শুধু একটি শাসনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ইরান কোনো সরকার নয়, বরং একটি হুমকি। তারা কোনো জনগোষ্ঠী নয়, বরং একটি সমস্যা। প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদন ‘ইসলামিক’ শব্দটি অবমাননাকর শব্দের মতো যুক্ত করা হয়। এটি চুপিসারে এই সংকেত দেয় যে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিরোধ দমন করতে হবে।
ইরানের ক্ষেত্রেও বেছে বেছে সতর্কতার সঙ্গে শব্দ ব্যবহার করা হয়। ইরানকে কখনো একটি দেশ হিসেবে তুলে ধরা হয় না, বরং শুধু একটি শাসনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ইরান কোনো সরকার নয়, বরং একটি হুমকি। তারা কোনো জনগোষ্ঠী নয়, বরং একটি সমস্যা। প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদন ‘ইসলামিক’ শব্দটি অবমাননাকর শব্দের মতো যুক্ত করা হয়। এটি চুপিসারে এই সংকেত দেয় যে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিরোধ দমন করতে হবে।
ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র নেই। পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ইরানকে বিশ্বব্যবস্থার জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখানো হয়। কারণ, সমস্যাটি ইরানের হাতে থাকা জিনিসে নয়, বরং যা তারা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে, তার মধ্যে। অভ্যুত্থান, নিষেধাজ্ঞা, গুপ্ত হত্যা এবং অন্তর্ঘাতের পরও ইরান টিকে আছে। ইরান এমন একটি রাষ্ট্র, যেটি এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহিংসতার পরও ভেঙে পড়েনি।
এভাবেই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের হুমকির মিথটি একটি অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। এই একই মিথ ব্যবহার করা হয়েছিল ইরাকে অবৈধ হামলার যৌক্তিকতা দেখাতে।
তিন দশক ধরে, আমেরিকান সংবাদমাধ্যমের শিরোনামগুলোয় বলা হচ্ছে, ‘ইরান বোমা তৈরির মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে’। এভাবে তিন দশক পেরিয়ে গেছে। অথচ সেটা কখনোই বাস্তবে রূপ পায়নি।
কিন্তু ভয়, সেটা যদি ভিত্তিহীনও হয়, সেটাও কাজে লাগানো যায়। আপনি যদি মানুষকে ভয়ের জগতে রাখতে পারেন, তাহলে তাদের চুপ করিয়ে রাখতে পারবেন। আপনি যদি ‘পারমাণবিক হুমকি’ শব্দটি বারবার বলেন, তাহলে কেউই আর ভাববে না সেই সব শিশুর কথা, যাদের ‘বিশ্বকে নিরাপদ রাখার’ নামে হত্যা করা হচ্ছে।
আমেরিকানদের জনমতে বিভাজনটা যে ক্রমেই বাড়ছে, সেটা ট্রাম্প প্রশাসনের চোখ এড়ায়নি। সুযোগসন্ধানী ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আর কোনো যুদ্ধ চায় না। সে কারণে ২৪ জুন তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দেন, ‘যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে’। তিনি ইসরায়েলের উদ্দশে বলেন, ‘বোমা ফেলো না।’ যদিও ইসরায়েল সেনাবাহিনী তখনো ইরানের ওপর হামলা চালাচ্ছিল।
ট্রাম্পের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের রাজনৈতিক অভিজাতদের অনেকেই নিজেদের শান্তির দূত হিসেবে জাহির করতে চান। অথচ তাঁরা নিজেরাই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে ‘শান্তি’ শব্দের অর্থই বদলে গেছে। তাঁদের কাছে শান্তি মানে পৃথিবীর চোখের সামনেই গণহত্যা ও নৃশংসতা চালানোর বাধাহীন স্বাধীনতা।
কিন্তু তাঁরা আমাদের সম্মতি উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা জানি শান্তি কী। আমরা এটাও জানি যে যুদ্ধের পোশাকে শান্তি আসে না। শান্তি আকাশ থেকে বর্ষিত হয় না। শান্তি আসে কেবল তখনই, যখন সেখানে মুক্তি থাকে। আর তাঁরা যতবারই আঘাত করুক না কেন, জনগণ টিকে থাকে। ফিলিস্তিন থেকে ইরান-জনগণকে পরাজিত করা যায় না, তাদের কেনা যায় না। তারা সন্ত্রাসের কাছে নত হয় না।
● আহমাদ ইবসাইস প্রথম প্রজন্মের একজন ফিলিস্তিনি আমেরিকান
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল দ র ব যবহ র কর ইসর য় ল র ও ইসর য় ল গণহত য সরক র উপস থ
এছাড়াও পড়ুন:
কুমিল্লায় নারীকে ধর্ষণ ও নিগ্রহের প্রতিবাদে জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে ধর্ষণ ও নিগ্রহের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে প্রতিবাদে মিছিল করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
রোববার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে এ বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণ ঘুরে একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়।
মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘আমার বোন ধর্ষিতা কেন, ইন্টেরিম জবাব চাই’, ‘অবিলম্বে ধর্ষকদের বিচার কর’, ‘জানমালের নিরাপত্তা দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। প্রতিবাদ মিছিল শেষে একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্য চত্বরের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শামসুল আলম মারুফ বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মাধ্যমে ইন্টেরিম (অন্তর্বর্তীকালীন) সরকার ক্ষমতায় বসল। কিন্তু এরপর আমরা দেখতে পেলাম নারীদের ওপর একাধিক নিপীড়ন, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনসহ বিগত কয়েক মাসে ঘটিত শত শত মব ভায়োলেন্সের ঘটনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে।’
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘সরকারের এমন আচরণ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা, পুলিশের কাঠামোগত সংস্কার না করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম জুলাই–আগস্টের শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইভান তাহসীব বলেন, ‘প্রতিদিন এই ধর্ষণের ঘটনাগুলো সংবাদের শিরোনামে দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি বললেও এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রতিদিন হাটে-ঘাটে চলতে গিয়ে আমরাও সবাই অনেকখানি অনিরাপদ বোধ করছি। এটা হওয়ার কথা ছিল না। জুলাই অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল হাসিনার আমলের সকল দুঃশাসন কাটিয়ে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অথচ একই রকম সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান।’
তাহসীব আরও বলেন, ‘আমরা বিচারের কথা বলি, যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পর আর কেউ এমন ঘৃণ্য কাজ করতে সাহস না পায়। যাতে এই সংস্কৃতি বন্ধ হয়। মুরাদনগরের সেই ধর্ষিতার চাচা বলেছিলেন কাল তাঁর ঘরের কারও সাথে এমনটা হবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? আমরা সেই নিশ্চয়তার দাবিতে আজ দাঁড়িয়েছি। যতক্ষণ না সেটা নিশ্চিত হচ্ছে, আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’