বিতর্কিত ঠিকাদারের কাচ্চিতে ভূরিভোজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর
Published: 30th, June 2025 GMT
চলতি অর্থবছরের শেষ দিন ছিল সোমবার (৩০ জুন)। ফলে এদিন দুপুরে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে বিভিন্ন কাজের বিল ছাড়ের ছিল তুমুল ব্যস্ততা। এর মধ্যে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে ওই অফিসে এসে পৌঁছাল নামকরা একটি ব্র্যান্ডের তৈরি কাচ্চি বিরিয়ানির প্যাকেট। হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য উপহার হিসেবে খাবারগুলো এনেছেন বিস্ফোরক মামলার আসামি ও বিতর্কিত ঠিকাদার আবদুর রহমান মুন্না। তাতে কী, ততক্ষণে অফিসজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। অতঃপর সেই কাচ্চি বিরিয়ানিতেই দুপুরে ভূরিভোজ সারেন হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
জানা গেছে, আজ দুপুর পৌনে ২টার দিকে ঠিকাদার মুন্না গাড়িভর্তি কাচ্চি বিরিয়ানি উপজেলা পরিষদের ভেতরে হিসাবরক্ষণ অফিসে নিয়ে আসেন। এ সময় মুন্না গাড়ির ভেতরেই অবস্থান করলেও খাবারের প্যাকেট অফিসের ভেতরে পৌঁছে দেন তাঁর চালক। এরপর অফিস পিয়নরা খাবারগুলো প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর টেবিলে পৌঁছে দেন।
বিতর্কিত ঠিকাদার মুন্নার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। গত ৫ আগস্টের পর তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা হয় চারঘাট থানায়। এ ছাড়া রাজশাহীর বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা সম্প্রতি আইজিপি বরাবর মুন্নার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে তারা দাবি করেন, সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের ‘আশীর্বাদে’ মুন্না ১৭ বছর ধরে সারদা পুলিশ একাডেমি, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ, জেলা পুলিশসহ বিভিন্ন জেলায় পুলিশের স্থাপনা নির্মাণ, সংস্কার, রেশন সরবরাহ, পণ্য ও সেবা সরবরাহের অধিকাংশ কাজ নামে-বেনামে করেছেন। এককভাবে পুলিশের সব কাজ করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের প্রভাব খাটিয়ে তিনি পুলিশে একচেটিয়া নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্যও করেছেন।
হিসাব রক্ষণ অফিসের এক কর্মচারী জানান, ঠিকাদার মুন্নার প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি কাজের বিল আটকে ছিল। আজ সেগুলো ছাড়া হয়েছে। অন্য ঠিকাদারের কোনো বিল কাগজপত্রের জটিলতায় আটকা পড়লে মুন্না সব সময় এ বিষয়ে অফিসের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন। এ জন্য প্রায়ই কর্মকর্তাদের নানা ধরনের উপহার দিয়ে খুশি রাখেন। তাই বিল ছাড় হলে অফিসের সবাইর জন্য মাঝেমধ্যে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেন।
হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর নয়ন কুমার অধিকারী বলেন, ‘আজ (সোমবার) দুপুরে আমাদের সবার জন্য কাচ্চি বিরিয়ানির ব্যবস্থা ছিল। খাওয়ার পর আমি জেনেছি সেগুলো ঠিকাদার মুন্না পাঠিয়েছেন। শুধু আমাদের অফিসে না, পাশের কয়েকটি ব্যাংকেও তিনি খাবার পাঠিয়েছেন বলে শুনেছি।’
এদিকে একজন বিতর্কিত ঠিকাদারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহসভাপতি আঞ্জুমান আরা বলেন, যে ঠিকাদারের বিলের কাজ করছেন, তাঁর কাছ থেকেই কাচ্চি বিরিয়ানি খাচ্ছেন কর্মকর্তারা। এটি কোনো নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।
এ বিষয়ে উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সামশুল করিম বলেন, ‘আমার কর্মচারীরা বলেছিল, আজ দুপুরে খাবার না আনার জন্য। তারা মুন্না নাকি অন্য কারও কাছ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করেছে, আমার জানা নেই।’ যে কেউ খাবার দিলেই তাঁর সেটি খাওয়া নৈতিকতার মধ্যে পড়ে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেননি।
হিসাবরক্ষণ অফিসে খাবার পাঠানোর বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান ঠিকাদার আবদুর রহমান মুন্না। তিনি দাবি করেন, ‘আমার গাড়ি রাজশাহী থেকে চারঘাট যাচ্ছিল। পথে হিসাবরক্ষণ অফিসের খাবারের বিষয়টি জানতে পেরে আমার গাড়িতে সেগুলো অফিসে পৌঁছে দিয়েছি।’ বিভিন্ন অনিয়মের লিখিত অভিযোগের বিষয়ে মুন্না বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতিতে কখনও জড়িত ছিলাম না। সৎভাবে ব্যবসা করেছি।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব তর ক ত ঠ ক দ র কর মকর ত ব যবস উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
বাঙালি মুসলিমদের নিশানা করেই কি আসামে আদিবাসীদের অস্ত্র দিচ্ছে রাজ্য সরকার
ভারতের আসাম রাজ্যের বিজেপি সরকার তীব্র বিতর্ক সত্ত্বেও গতকাল বৃহস্পতিবার আদিবাসীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। ওই দিনই জানানো হয়েছে, অনলাইনে আবেদন করে রাজ্যের ‘অরক্ষিত ও প্রত্যন্ত’ এলাকায় বসবাসকারী ‘মূল নিবাসী উপজাতি গোষ্ঠীর’ মানুষ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবেন।
ভারতের সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ স্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, বিজেপিশাসিত রাজ্যের বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার অতীতের একাধিক ভাষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে ‘অরক্ষিত’ এলাকা বলতে এমন অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে বাঙালি-বংশোদ্ভূত মুসলিমরা বসবাস করেন।
রাজ্যের একাংশের মানুষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে শুক্রবার বলেন, এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিল।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নাগরিকের হাতে অস্ত্র থাকা প্রয়োজন: মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত
অস্ত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বৃহস্পতিবার পোর্টাল চালু করার সময় মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘যদি আমি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বা আন্তরাষ্ট্রীয় সীমানা অঞ্চলের কাছাকাছি থাকি, অথবা আমি এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করি, যেখানে আমার সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা খুবই কম। যদি সেখানে একটি সম্প্রদায়ের হার ৯০-৯৫ শতাংশ হয় এবং অপর সম্প্রদায় ৫ শতাংশ হয়, তবে সেখানে উত্তেজনা থাকবে। ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক—সব স্তরেই উত্তেজনা থাকবে। একটি ছোট ঘটনা এমন পরিস্থিতিও সৃষ্টি করতে পারে যেখানে ৯৫ শতাংশের সম্প্রদায় ৫ শতাংশকে আক্রমণ করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে পারে।’
আসামের আদিবাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার পক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর আরও যুক্তি, সাধারণভাবে একটি থানায় ৬ থেকে ১২ জন কনস্টেবল থাকেন। কোনো সংঘাত হলে জেলা সদর থেকে অতিরিক্ত বাহিনী পাঠাতে দুই-তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
বিজেপির এই উগ্রবাদী মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই দুই-তিন ঘণ্টা আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। এবং যদি লোকেরা (আক্রমণকারীরা) এটা জানে, আক্রান্ত ব্যক্তি বা আক্রান্ত বাড়িতে একটি আগ্নেয়াস্ত্র আছে, তাহলে এটিই একটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের ‘প্রথম প্রতিরক্ষক’ বলেও উল্লেখ করেন হিমন্ত।
কারা পেতে পারেন আগ্নেয়াস্ত্র
আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের জন্য ‘সেবা সেতু’ নামে একটি পোর্টালে আবেদন করা যাবে। সেবা সেতু ওয়েবসাইটে এত দিন আসাম সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক পরিষেবার ঘোষণা দেওয়া হতো। সেসবের পাশাপাশি এখন জানানো হয়েছে, কারা আগ্নেয়াস্ত্র পেতে পারেন।
ওয়েবসাইটে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, আবেদনকারীকে আসামের আদিবাসী হতে হবে, তার বয়স কমপক্ষে ২১ হতে হবে এবং ‘অরক্ষিত ও প্রত্যন্ত’ অঞ্চলে বসবাস করতে হবে। আবেদনকারীর অপরাধমূলক কোনো ব্যক্তিগত ইতিহাস থাকা চলবে না এবং তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও থাকা চলবে না।
সেবা সেতু ওয়েবসাইটে শর্তে আরও বলা হয়, আবেদনকারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। ২০১৬ সালের অস্ত্র আইন মোতাবেক উপযুক্ত প্রশিক্ষণও থাকতে হবে।
তবে প্রচারমাধ্যমের বক্তব্য অনুসারে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী ‘অরক্ষিত অঞ্চল’ বলতে বাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলকে বোঝালেও সেবা সেতুতে অরক্ষিত অঞ্চলের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। বন্দুক সংগ্রহ করার আগে আরও একাধিক বিষয়—যেমন কেন তার আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োজন—এ বিষয়ে আবেদনকারীকে লিখিতভাবে তার বক্তব্য রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে।
ভারতের বর্তমান অস্ত্র আইন অনুসারে একজন সাধারণ বেসামরিক নাগরিকের পক্ষে আইনগতভাবে অস্ত্র কেনা বা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। আসাম সরকারের এই নতুন নির্দেশনা অস্ত্র সংগ্রহ করাকে অনেক সহজ করে দেবে বলে আসামের সাধারণ মানুষই মনে করছেন।
নাগরিক সমাজের বিরোধিতা
আজ শুক্রবার প্রথম আলোর সঙ্গে এই বিষয়ে আসামের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি আসামে তৈরি হতে চলেছে।’
ওই ব্যবসায়ী বলেন, এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে আসামে এই মুহূর্তে প্রায় ৪০ শতাংশ মুসলিম রয়েছেন, যাঁদের বড় অংশই বাঙালি মুসলমান। আসামে যে জনবিন্যাসের একটা পরিবর্তন হচ্ছে তা–ও অনস্বীকার্য। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, সমাজের একটি বৃহৎ অংশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হবে।
আসামের ওই ব্যবসায়ী আরও বলেন, যে রাজ্যে বা দেশে সাধারণ মানুষের হাতে বেশি অস্ত্র থাকে, সেখানে সাধারণভাবেই বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মাঝেমধ্যেই স্কুল-কলেজে গুলি চলে। আসামে সুকৌশলে পরিস্থিতিকে সেই দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুনআসামে কাদের লক্ষ্য করে আদিবাসী, মূল নিবাসীদের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি দিল হিমান্তের সরকার৩০ মে ২০২৫উত্তর-পূর্ব ভারতে একসময় কর্মরত এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার মতে, এর ফলে আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশেও সহিংসতা বাড়বে।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্দুক এমন এক জিনিস, যা এক জায়গায় থেমে থাকে না। একেকটি বন্দুকের বিরাট আয়ু হয়, যত্নে রাখলে একেকটি বন্দুক দীর্ঘদিন কাজ করে। ফলে এই আগ্নেয়াস্ত্র ধীরে ধীরে কালোবাজারে বিক্রি হবে এবং তা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও ঢুকে পড়বে। আসামের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রয়েছে।’
সাবেক ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারত অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা, যার সীমান্তের মাত্র ২ শতাংশ রয়েছে ভারতের সঙ্গে। বাকি ৯৮ শতাংশ অন্যান্য দেশের সঙ্গে।
অবসরপ্রাপ্ত ওই পুলিশ কর্তা বলছিলেন, ‘সেসব দেশের সঙ্গে নানা কারণে ভারতের সম্পর্ক বেশ খানিকটা নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা ঈশ্বরই জানেন।’
উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের কথায়, এর ফলে শুধু আসামে নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে সহিংসতা বাড়বে। কারণ, এই বন্দুক সেখানেও পৌঁছবে।
ওই গবেষক বলেন, ‘আমার মনে হয় এই কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হলো। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হয়তো এভাবে নিজেকে জাতীয় রাজনীতিতে তুলে ধরতে চাইছেন। কারণ, তিনি দেখেছেন, মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক জীবনে চরম উন্নতি করেছেন।’
আরও পড়ুনবাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে হিমন্তের বিতর্কিত মন্তব্য, নিন্দা জানাল বিরোধীরা১৮ মে ২০২৪