ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষা আছে, দীর্ঘশ্বাস ও হতাশাও আছে। শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু কিছুদিন বাদেই শুরু হয় তাঁদের অভাব-অনুযোগ। শিক্ষকেরা বিভিন্ন জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লিখছেন, বলছেন। কিন্তু তাঁরাও নানা ঘাটতি-অপূর্ণতার কথা বলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থেই ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হয়ে উঠতে পেরেছে কি না, মাঝেমধ্যে এমন প্রশ্নও ওঠে।

প্রতিবছর ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়। এ বছর প্রতিষ্ঠার ১০৪ বছর পূর্ণ করল এই বিশ্ববিদ্যালয়। এ অঞ্চলের মানুষের উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। সূচনালগ্নে সেই সম্ভাবনারও প্রকাশ ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগপর্যন্ত একাডেমিক ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার চিহ্ন রয়ে গেছে। পাকিস্তান পর্বের ২৪ বছরেও সফলতার ধারা বজায় থেকেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পর্বে ধীরে ধীরে এর ক্ষয় শুরু হয়েছে। 

কার্যকর অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে হলে পরিকল্পনা নেওয়ার বিকল্প নেই। এ জন্য সবার আগে দরকার সমস্যাগুলোকে তালিকা করা। এ কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষদের দায়িত্ব দিতে হবে

জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশে প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন সময়ে তাই এ প্রশ্নও উঠেছে, লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থাকা উচিত কি নয়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা শুধু রাজনীতি করেননি, সাধারণ ছাত্রদেরও রাজনীতিতে অংশ নিতে বাধ্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে গৌণ করে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো ভূমিকা রেখেছে।

 গত কয়েক দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে অনেক। বাজারের চাহিদাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন, আমাদের এতগুলো বিভাগের প্রয়োজন ছিল কি না। একই বিভাগের অন্তর্গত করে বিশেষ বিষয়ের পাঠদান করা যেত কি না। তা ছাড়া দুঃখজনক হলেও সত্যি, সব বিভাগেই সিলেবাস আছে, কিন্তু এসব সিলেবাসকে শিক্ষাক্রমের অন্তর্গত করে সাজানো সম্ভব হয়নি। এটি করতে না পারার কারণে উপযুক্ত ও দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। 

সমস্যা রয়েছে গবেষণাক্ষেত্রেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দৃশ্যমান ও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা হচ্ছে না। গবেষণার জন্য যে পরিবেশ ও পদ্ধতি দরকার, সেটি বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারছে না। বিভিন্ন বিভাগ থেকে যেসব গবেষণা হচ্ছে, সেগুলো মানের দিক থেকে দুর্বল। বৃহত্তর পরিকল্পনার অধীন গবেষণার ক্ষেত্র নির্ধারণ করা দরকার ছিল। তারপর সেই অনুযায়ী গবেষণা পরিচালনা করা যেত। বর্তমান প্রক্রিয়ায় যেসব গবেষণা হচ্ছে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন এবং প্রায় ক্ষেত্রেই পুরোনো কাজের চর্বিতচর্বণ।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার পরিবেশ দিতেও ব্যর্থ হয়েছে। অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ পাঠদান বা পাঠ গ্রহণের উপযুক্ত নয়। শিক্ষার্থীরা অনেক কক্ষে ঠিকমতো বসতেও পারেন না। প্রায় কক্ষেই শিক্ষকদের লেখার উপযোগী বোর্ড নেই, নেই লেখা প্রদর্শনের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা। আবাসিক হলগুলোয় থাকার সুযোগ তৈরি করতেই শিক্ষার্থীদের যুদ্ধ করতে হয়। সেখানেও পড়ার পরিবেশ নেই। তা ছাড়া গতানুগতিক ধারায় বছরের পর বছর যে প্রশ্ন হয়, তাতে পরীক্ষার আগে পুরোনো নোট বা তার ফটোকপি পড়লেই চলে! এখন শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য গিয়ে ঠেকেছে চাকরির পরীক্ষায়। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, হলের পাঠকক্ষ ও বিভাগীয় সেমিনারগুলোয় বসে তাঁরা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন! 

ছাত্র সংসদ না থাকায় সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। নিয়মিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে তাঁদের অংশগ্রহণ দেখা যায় না। বিতর্ক, আবৃত্তি, অভিনয়সহ বিভিন্ন আয়োজনে তাঁদের আগ্রহ কমেছে। একসময় খেলাধুলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুনাম ছিল; এখন সেটাও নেই। লেখালেখি, পত্রিকা সম্পাদনা—এসব কাজেও আগের মতো উৎসাহী ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী পাওয়া যায় না।

আজকের শিক্ষার্থীরাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের মধ্যে কোন নেতৃত্ব আর সক্ষমতা তৈরি করছে। শিক্ষকেরাও নিয়মিত একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজের বাইরে গবেষণা, লেখালেখি ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে সময় দিতে পারছেন না। মানতেই হবে, আমাদের অনেক ঘাটতি ও অপূর্ণতা আছে; কিন্তু আন্তরিকতা আর আগ্রহে কমতি কেন থাকবে, সেটাও প্রশ্ন।

কার্যকর অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে হলে পরিকল্পনা নেওয়ার বিকল্প নেই। এ জন্য সবার আগে দরকার সমস্যাগুলোকে তালিকা করা। এ কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষদের দায়িত্ব দিতে হবে। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখছেন, তাঁদের এ কাজে যুক্ত করতে হবে। যেসব শিক্ষক বিভিন্ন উচ্চতর প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদে ছিলেন, এখন অবসরে আছেন, প্রয়োজনে তাঁদের মতও নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে নিয়মিত কাজের বাইরে বাড়তি ও বিশেষ কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য ভালো উপায় হলো প্রয়োজনীয় সংখ্যক কমিটি তৈরি করে সেগুলোর কাছে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া। যেমন ধরা যাক, ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি ও প্রশ্ন কেমন হতে পারে, তা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি তৈরি করা যায়। এই কমিটি বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত পদ্ধতির সুপারিশ করবে। কমিটি এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে তাঁদের মতও বিবেচনায় নেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নিয়ে বর্তমান প্রশাসনকে বেশ আগ্রহী দেখা যাচ্ছে। এটি ভালো লক্ষণ। নির্দেশিত ক্ষেত্রগুলোয় উন্নতির মধ্য দিয়েই র‍্যাঙ্কিং বাড়ানো সম্ভব। এর মধ্যে একটি হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যোগাযোগ ও কাজ বাড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেরও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা তৈরি করতে হবে।

জাতীয় স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনেকবার সম্মিলিত ঐক্য দেখিয়েছেন। এখন সত্যিকার ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ গড়ে তোলার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। শিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব না হলে বৈশ্বিক মানদণ্ডে ধীরে ধীরে আমাদের আরও পিছিয়ে পড়তে হবে।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এক ড ম ক উপয ক ত পর ক ষ পর ব শ এ জন য র জন ত জন য স আম দ র র জন য দরক র গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

‘এটা তো চাপের খেলা’—বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে ভারত কোচ

বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ ঘিরে উত্তাপ, উত্তেজনা নতুন নয়। তবে এবারের লড়াইটা ভারতের জন্য বাড়তি চাপেরও। প্রতিপক্ষের মাঠ, গ্যালারিভর্তি দর্শক আর হামজা-শমিতে উজ্জীবিত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স—সব মিলিয়ে হয়তো কঠিন পরীক্ষাতেই পড়তে হবে সফরকারীদের। আজ ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে ভারতের কোচের কণ্ঠেও ফুটে উঠল তেমনটাই।

আগামীকাল জাতীয় স্টেডিয়ামে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচে মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ-ভারত। তার আগে আজ একটি হোটেলে ভারতীয় দলের কোচ খালিদ জামিল বলেন, ‘এটা তো চাপের খেলা’।

এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব থেকে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দলেরই বিদায় আগেই নিশ্চিত হয়েছে। তবু বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে ভারত ম্যাচ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ। যার বড় প্রমাণ অনলাইনে টিকিট ছাড়ার ৬ মিনিটের মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যাওয়া।

এর পাশাপাশি প্রতিপক্ষের মাঠে খেলাটা যে সব সময়ই কঠিন, সেই বাস্তবতা জানেন জামিলও। তাঁর দলের ওপর চাপ আছে কি না প্রশ্নে ভারত কোচ বলেন, ‘হ্যাঁ, চাপ আছে। আমাদের তা মানতে হবে। সবাই জানে এটি একটি চাপের ম্যাচ। তবে সে জন্য আমাদের একটি ইতিবাচক ফলের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’

গত ২৫ মার্চ শিলংয়ে দুই দলের প্রথম লেগ গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। সেই ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক হয়েছিল হামজা চৌধুরীর। ইংলিশ ক্লাব লেস্টার সিটিতে খেলা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বাংলাদেশের হয়ে এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচে করেছেন ৪ গোল, যার মধ্যে দুটি করেছেন বৃহস্পতিবার নেপালের বিপক্ষে।

ভারত কোচ অবশ্য একক কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে ভাবতে নারাজ, ‘আমরা শুধু একজন খেলোয়াড়কে বিবেচনায় নিচ্ছি না। বাংলাদেশ দলে অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে। এটা খুব সিরিয়াস গেম।’

১৯৭৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ বার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত। এর মধ্যে ভারত জিতেছে ১৬টিতে, বাংলাদেশ ২টিতে। ড্র বাকি ১৪টি (২০০৩ সাফে বাংলাদেশের গোল্ডেন গোলে জয়ের ম্যাচসহ)।

সম্পর্কিত নিবন্ধ