তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেভাবে বাতিল হয়েছিল
Published: 9th, August 2025 GMT
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হয়েছিল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। ওই সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল ব্যাপক বিতর্ক। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের ভাষায়, যেভাবে একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়, তাকে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কতন্ত্র’ বলা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের এ ধরনের মতামত চাপিয়ে দেওয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে কোনোমতেই সংগতিপূর্ণ নয়। আর এর পরিণতিও শুভ হয় না। এর মাধ্যমে সমঝোতার পরিবর্তে সংঘাতের রাজনীতিরই প্রসার ঘটে।
বদিউল আলম মজুমদার এই কথাগুলো বলেছেন তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি বইয়ে। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে, ২০২৩ সালে। বইটি প্রকাশ করে প্রথমা।
পরবর্তী সময়ে এই বইয়ের সূত্র ধরেই পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন বদিউল আলম মজুমদার। গত বছরের ১৮ আগস্ট বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিটটি করেন। এর পরিপ্রেক্ষেতে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা–সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিকভাবে বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। সে সরকারের রূপরেখা কেমন হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। চলতি সপ্তাহে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি বইটিতে বদিউল আলম মজুমদার দেখিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আদালতের যে রায় দেওয়া হয়েছিল তার প্রাসঙ্গিকতা, যৌক্তিকতা ও আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে আপিল বিভাগের রায়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনে বিশেষ সংসদীয় কমিটির সুপারিশ কীভাবে শুধু তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাওয়ার কারণে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক কীভাবে রায়ে পরিবর্তন এনেছেন, যিনি এখন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে।
বইটির মুখবন্ধে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো.
কোনো কোনো আইনজ্ঞ ও গবেষক এটাকে ‘অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধন’ বলে অভিহিত করেছেন। বদিউল আলম মজুমদার তাঁর বইয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ও পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন ও পুরো প্রক্রিয়াটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলএকটি পরোক্ষ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এটি ছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী।
২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এরপর একই বছরের ২১ জুলাই তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়।
এ কমিটির কাজ যখন শেষের দিকে, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আপিল বিভাগ একটি সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত আদেশ দেন। তাতে বলা হয়েছিল, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রসপেকটিভলি অর্থাৎ ভবিষ্যতের জন্য বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো। তাতে আরও বলা হয়েছিল, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সুপারিশ বদলে যাওয়া নিয়ে কমিটির কোনো কোনো সদস্যের ক্ষোভ থাকলেও কেউ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার নিয়ে তখন প্রশ্ন তোলেননি।সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ তৈরি করেছিল। তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি বৈঠকের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে এবং নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল রাখার বিধান প্রস্তাব করে সুপারিশ চূড়ান্ত করে বিশেষ সংসদীয় কমিটি। এটি নিয়ে কমিটির সদস্যদের কারও কারও অসন্তোষ ছিল।
২০১২ সালে আপিল বিভাগের বিস্তারিত রায় প্রকাশ করা হয়। তবে তার আগে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয়, যার মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোতে (২৮ অক্টোবর ২০১৩) প্রকাশিত ‘কোন সংবিধান, কার সংবিধান?’ শীর্ষক এক উপসম্পাদকীয়তে সংশোধনীটির লেজিটিমেসি বা আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এটি যে শেখ হাসিনার সরকারের একটি ‘অবৈধ’ কর্মকাণ্ড, সে বয়ান তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি’ বইয়ে ওই বিশেষ সংসদীয় কমিটির বিস্তারিত কার্যক্রম, কমিটির সদস্য আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবস্থান, কমিটির কাছে দেওয়া বিশিষ্টজনদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর কারণে কীভাবে সুপারিশ বদলে যায়, তড়িঘড়ি করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা ও এই সংশোধনী পাসের পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে।
বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন২০১০ সালের ২১ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে প্রয়াত সংসদ সদস্য সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন ও প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপারসন করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন আমির হোসেন আমু, প্রয়াত মো. আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, প্রয়াত মো. রহমত আলী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রয়াত মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, রাশেদ খান মেনন, প্রয়াত আবদুল মতিন খসরু, হাসানুল হক ইনু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, হাছান মাহমুদ ও শিরীন শারমিন চৌধুরী (সংরক্ষিত মহিলা আসন)। কমিটিতে সংসদের বিরোধী দল বিএনপিকে তাদের একজন প্রতিনিধির নাম দেওয়ার আহ্বান জানানো হলে তাতে তারা সাড়া দেয়নি।
বইয়ে বলা হয়েছে, প্রায় ১০ মাসে এই কমিটি ২৬টি বৈঠক করে। কমিটি ১১৪ জন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানায়। এর মধ্যে ১০৪ জন সশরীর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
কমিটির সুপারিশ ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপবদিউল আলম মজুমদার তাঁর বইয়ে বলেছেন, নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলাপ–আলোচনা এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধি ও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময় ও তাঁদের পরামর্শের ভিত্তিতে ২৯ মে ২০১১ তারিখে বিশেষ সংসদীয় কমিটি সংবিধানের ৪৩টি অনুচ্ছেদে মোট ৪৯টি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি সংশোধিত সুপারিশমালা তৈরি করে।
সুপারিশে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্য বহাল রেখে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়। এর পরদিন ৩০ মে বিশেষ কমিটির সদস্যরা তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে এবং সংসদ বহাল রেখেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ৫ জুন কমিটি তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের আগ পর্যন্ত এ–সম্পর্কিত বিধানটি ছিল সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদে। বইয়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ৩০ মে ২০১১ তারিখে সাক্ষাতের পর বিশেষ কমিটি ৫ জুন ২০১১ তারিখে তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করে ৮ জুন স্পিকারের কাছে প্রেরণ করে।
২০২৩ সালে প্রকাশিত বইয়ে বদিউল আলম মজুমদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কয়েকটি পরিণতি উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীরা সমঝোতার রাজনীতির পথ থেকে সরে আসে এবং দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতিতে ফিরে যায়।কমিটির ২৯ মে তারিখের সর্বসম্মত সুপারিশের সঙ্গে চূড়ান্ত সুপারিশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। যেমন—চূড়ান্ত সুপারিশে সংবিধানের ৫৮ক বিলুপ্ত করা হয়। একই সঙ্গে বিলুপ্ত করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা–সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ। এ ছাড়া সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠান–সম্পর্কিত সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করা হয়।
অথচ এর আগে শেখ হাসিনা নিজেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে বিশেষ কমিটির কাছে মত দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল বিশেষ কমিটির ২০তম সভায় উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, ...‘অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক সরকার আর কেউ দেখতে চায় না। আর ৫৮–এ একটি সুযোগ থাকায় ওই ফাঁক দিয়ে আবার অন্য কিছু ঢুকে যাওয়া। তাই ৫৮ অনুচ্ছেদকে একটু সংশোধন করে ওই সুযোগটা যাতে আর না থাকে, সেটা বন্ধ করে একটি টাইম ফ্রেম দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি এবং সংবিধানের ১২৩ ও ৭২(১) অনুচ্ছেদের সংশোধনসহ ৫১টি সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন তৈরি করে বিশেষ সংসদীয় কমিটি।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সুপারিশ বদলে যাওয়া নিয়ে কমিটির কোনো কোনো সদস্যের ক্ষোভ থাকলেও কেউ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার নিয়ে তখন প্রশ্ন তোলেননি। বিষয়টি উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার তাঁর বইয়ে বলেছেন, নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে সংসদের কার্যক্রমে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংসদের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ দলীয় প্রধানেরও এখতিয়ারের বাইরে। কার্যপ্রণালি বিধিতেও সংসদ নেতাকে কোনো বিশেষ সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাতিল করার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
দ্রুততার সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস২০১১ সালের ২০ জুন বিশেষ কমিটির ৫১টি সুপারিশ হুবহু অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এর চার দিন পর ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে তোলা হয়। একই দিন বিলটি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য দুই সপ্তাহের সময় দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
কমিটি চারটি উপ-অনুচ্ছেদ যুক্ত করার সুপারিশ করে মোট ৫৫টি অনুচ্ছেদসংবলিত প্রতিবেদন ২৯ জুন সংসদে দাখিল করে। পরদিন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি ২৯১-১ ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি বইয়ে লেখক বলছেন, ‘লক্ষণীয় যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সংশোধনী পাসের জন্য সংসদের কোনো বিশেষ অধিবেশনও ডাকা হয়নি। এটি নিয়ে সংসদে কোনো উল্লেখযোগ্য বিতর্কও হয়নি।’
এটি সুস্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংসদে তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগে একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে। সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে যেভাবে একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়, তা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো পণ্ডিতের ভাষায় সেটাকে ‘টিরানি অব দ্য মেজরিটি’ বা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠদের একনায়কতন্ত্র’ বলা যায়।
সংখ্যাগরিষ্ঠের এ ধরনের মতামত চাপিয়ে দেওয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে কোনোমতেই সংগতিপূর্ণ নয়। আর এর পরিণতিও শুভ হয় না। এর মাধ্যমে সমঝোতার পরিবর্তে সংঘাতের রাজনীতিরই প্রসার ঘটে। এটি সুস্পষ্ট যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের ক্ষেত্রে সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তাদের মতামত শুধু অন্যদের ওপর চাপিয়েই দেয়নি, এর মাধ্যমে তারা ক্ষমতার পৃথক্করণের নীতিকেও লঙ্ঘন করেছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পরিণতি২০২৩ সালে প্রকাশিত বইয়ে বদিউল আলম মজুমদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কয়েকটি পরিণতি উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীরা সমঝোতার রাজনীতির পথ থেকে সরে আসে এবং দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতিতে ফিরে যায়।
এর ফলে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দেশে পরপর দুটি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দুটি তথাকথিত নির্বাচনের ফলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভেঙে গেছে, ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ভবিষ্যতে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের আরেকটি ভয়াবহ পরিণতি হলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন–পীড়ন। এই দমন–পীড়নের চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে।
রিয়াদুল করিম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ত ল র র জন ত কম ট র স প র শ ব শ ষ কম ট র ত র র জন ত র আপ ল ব ভ গ ক ষমত স ন র জন ত ক কম ট র ক অন চ ছ দ প রস ত ব প রক শ ত য় কম ট র ব যবস থ সমঝ ত র ব তর ক উল ল খ ত র পর হয় ছ ল র পর ব র জন য প স কর এর পর সদস য মত মত আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বের সেরা কর্মস্থল হিলটন হোটেল, সেরা তালিকায় আছে মেটলাইফ
আধুনিক মানুষের দিনের বড় একটা সময় যায় কর্মস্থলে। ফলে সেই কর্মস্থলের পরিবেশ কেমন, কর্তৃপক্ষ কর্মীদের কথা কতটা ভাবছে—এ সবকিছু এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।
সম্মান, নিরাপত্তা, উন্নতির সুযোগ ও কাজের অর্থবহতা আছে—মানুষ সাধারণত এমন কর্মস্থলই চায়। এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। তারা মূলত বিশ্বের সেরা ২৫ কর্মস্থলের তালিকা করে। সেই তালিকায় সবার ওপরে আছে হিলটন হোটেল। মূলত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এই জরিপ ও তালিকা করা হয়েছে।
এবারের তালিকায় ২৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টি যুক্তরাষ্ট্রের। অন্যগুলো বিভিন্ন দেশের, মূলত ইউরোপের। কোম্পানিগুলোর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে—২৫টি কোম্পানির মধ্যে ৮টি এই খাতের। এ ছাড়া নির্মাণ, জৈব ওষুধ, উৎপাদন, কুরিয়ার, আর্থিক ও পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানিগুলোও তালিকায় আছে।
সেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি কোম্পানি হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জীবনবিমা কোম্পানি মেটলাইফ। ২০২৫ সালে দশম স্থান অর্জন করে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো এই মর্যাদাপূর্ণ বৈশ্বিক স্বীকৃতি ধরে রাখল কোম্পানিটি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪০টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম রয়েছে।
৯০ লাখের বেশি উত্তরের ওপর ভিত্তি করে ফরচুনের সেরা ২৫টি কর্মক্ষেত্রের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী আড়াই কোটি কর্মীর কাজের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে মেটলাইফের প্রেসিডেন্ট ও সিইও মিশেল খালাফ বলেন, ‘টানা দ্বিতীয় বছরের মতো বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকায় স্থান পাওয়া কর্মীদের নিষ্ঠা ও উদ্যোগের প্রমাণ।’
কারা আছে তালিকায়দেখে নেওয়া যাক এবারের তালিকায় কোন কোন দেশের কোম্পানি আছে। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে কুরিয়ার ও যাতায়াত খাতের কোম্পানি ডিএইচএল। তৃতীয় স্থানে আছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সিসকো। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রে। চতুর্থ স্থানে আছে পেশাদার সেবা দেওয়া আইরিশ কোম্পানি অ্যাক্সেনচিউর, পঞ্চম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বিশ্বখ্যাত হোটেল ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল। ষষ্ঠ স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি অ্যাব ভিয়ে, সপ্তম স্থানে আছে ফ্রান্সের পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানি টিপি। অষ্টম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনভিত্তিক কোম্পানি স্ট্রাইকার, নবম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি সেলস ফোর্স।
দশম স্থানে আছে মার্কিন বিমা কোম্পানি মেটলাইফ, ১১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সার্ভিস নাউ। ১২তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি স্পেকসেভার্স। ১৩তম স্থানে আছে জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি সিমেন্স হেলদিনেস; ১৪তম স্থানে আছে আইরিশ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এক্সপেরিয়েন। ১৫তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এনভিডিয়া, ১৬তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি কেডেন্স। ১৭তম স্থানে আছে জার্মানির বিমা ও আর্থিক কোম্পানি আলিয়াঞ্জ এবং ১৮তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতের কোম্পানি ডাও।
১৯ থেকে ২১তম স্থানে আছে তিনটি মার্কিন কোম্পানি। ১৯তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি ভিয়াট্রিস, ২০তম স্থানে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাডোবি, ২১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ক্রাউডস্ট্রাইক।
২২ ও ২৩তম স্থানেও আছে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি কোম্পানি—উৎপাদন খাতের এসসি জনসন ও খুচরা বিক্রয় খাতের ট্রেক বাইসাইকেল। ২৪তম স্থানে আছে লিচেনস্টাইনের নির্মাণ কোম্পানি হিলতি ও ২৫তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের বিমা ও আর্থিক খাতের কোম্পানি অ্যাডমিরাল গ্রুপ।
কীভাবে এই মূল্যায়ন৩০ বছর ধরে এই জরিপ পরিচালনা করছে ফরচুন ম্যাগাজিন। সারা বিশ্বের কর্মীদের কাছ থেকে তারা জানতে চায়, কর্মস্থলে তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কিছু মানদণ্ড তৈরি করে। সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতে বোঝা যায়, কোনো কর্মস্থল প্রকৃত অর্থেই ‘দারুণ’ কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা সে প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান কি না, প্রতিষ্ঠান কত দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ও তার সামগ্রিক ব্যবসায়িক সাফল্য কতটা মিলবে—এসব বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায় জরিপে।
ফরচুন ম্যাগাজিন নিজস্ব ট্রাস্ট ইনডেক্স বা আস্থাসূচক তৈরি করেছে। ব্যবস্থাপনার প্রতি কর্মীদের আস্থা কতটা, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ও কোম্পানির প্রতি কর্মীদের আনুগত্য কতটা—এসব আস্থাসূচকের মাধ্যমে এসব বিষয় পরিমাপ করা হয়।
এ জরিপে কর্মীরা গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁদের মতামত জানাতে পারেন। ৬০টি বিষয়ের ওপর ৫ পয়েন্টের ভিত্তিতে উত্তর দিতে হয়, সঙ্গে থাকে ২টি উন্মুক্ত প্রশ্ন।
কর্মীদের কাছ থেকে যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয়, সেগুলো হলো নেতৃত্বের কাছে কি সহজে যাওয়া যায়, নেতৃত্ব সততা ও স্বচ্চতার সঙ্গে কথা বলেন ও কাজ করেন কি না, নেতৃত্বের কথা ও কাজে মিল আছে কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে সম্মানিত বোধ করেন কি না এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কতটা। নেতৃত্ব কর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানান কি না এবং কর্মীদের সুস্থতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না। এ ছাড়া কর্মীদের অবদান রাখার সুযোগ আছে কি না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়।
জরিপে কর্মীদের কাছে আরও যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয় সেগুলো হলো:বেতন, মুনাফা, পদোন্নতি, স্বীকৃতি ও সুযোগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কতটা ন্যায়সংগত;
কর্মীরা নিজেদের কাজ, কর্মদল ও প্রতিষ্ঠানের জন্য গর্ব বোধ করেন;
কাজ অর্থবহ এবং তা পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে;
সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগে;
কর্মীরা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারেন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অভিজ্ঞতার ভিন্নতা কতটা, তা–ও জরিপে পরিমাপ করা হয়। কর্মীদের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা ও গুণগত মানও মূল্যায়ন করা হয়। এভাবে প্রতিটি ধাপে কঠোর মানদণ্ড মেনে এই তালিকা করা হয় বলে জানিয়েছে ফরচুন ম্যাগাজিন।