একদা এক জ্ঞানী বৃদ্ধ বাস করতেন পাহাড়ে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা করত এক কিশোর। সে ভাবত, এই বৃদ্ধকে একদিন বোকা বানাতে হবে। একদিন কিশোরটি একটি কূটবুদ্ধি আঁটল। সে বনে গিয়ে একটি ছোট পাখি ধরল এবং সেটিকে দুই হাতের মুঠোয় রেখে বৃদ্ধের কাছে গেল। তার উদ্দেশ্য ছিল বৃদ্ধকে বোকা প্রমাণিত করা।

সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বলুন তো, আমার হাতে কী আছে?’

বৃদ্ধ জবাব দিলেন, ‘বৎস, তোমার হাতে একটি পাখি আছে।’

এরপর এল কিশোরের আসল প্রশ্ন: ‘পাখিটা জীবিত, নাকি মৃত?’

প্রশ্নটি ছিল চাতুর্যপূর্ণ। যদি বৃদ্ধ বলতেন ‘জীবিত’, তবে কিশোর পাখিটিকে হাতে চেপে মেরে ফেলবে এবং বলবে, ‘না, এটা মৃত।’ আর যদি বলতেন ‘মৃত’, তখন সে পাখিটি ছেড়ে দিয়ে বলবে, ‘দেখুন, এটা তো জীবিত!’ এভাবে সে বৃদ্ধকে ভুল প্রমাণিত করবে।

কিন্তু তিনি ছেলেটির চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘বৎস, পাখিটির জীবন অথবা মৃত্যু তোমার নিজের হাতেই নিহিত।’

আরও পড়ুননাথান বমের কেএনএফ পাহাড়ে কেন ‘কেটিসি’ চায়, নেপথ্যে কী১২ এপ্রিল ২০২৪

গল্পের সেই পাখির জীবন অথবা মৃত্যু যেমন সেই কিশোরের হাতে ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের বম জনগোষ্ঠীর টিকে থাকা বা না থাকার বিষয়টিও যেন এখন রাষ্ট্রের হাতে।

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থানকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। তবে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দমন করতে গিয়ে পুরো বম জনগোষ্ঠীকেই যেন সন্দেহভাজন আর ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সন্ত্রাসী দমনে অভিযান পরিচালিত হলেও অভিযোগ রয়েছে, বাস্তবে হয়রানি আর নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে একটি প্রান্তিক ও নিরীহ আদিবাসী জনগোষ্ঠী।

এ বছর অন্তত তিনজন বম যুবকের মৃত্যু হয়েছে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে। ভান লাল রুয়াল বম, লাল সাংময় বম ও লাল থেলং কিম বম নামের তিনজন বম পুরুষ মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। শিউলি বম হচ্ছেন একজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত নারী। তিনি চিকিৎসা না পেয়ে আটক অবস্থায় ধুঁকছেন। জামিন পেয়েও মুক্তি পাচ্ছেন না রাষ্ট্রপক্ষের প্রবল আপত্তির কারণে। তাঁর মতো আরও ১১ নারী আটক আছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। শুধু যাঁরা কারাগারে আটক রয়েছেন তাঁরাই নন, পাহাড়ে বসবাসকারী অনেক বম নারী প্রতিদিন নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন।

ফিরে আসি সেই গল্পে। পাখিটা বাঁচবে কি মরবে, তা নির্ভর করে পাখিটি যার হাতে বন্দী হয়ে আছে তার সদিচ্ছার ওপর। বম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল। এই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের মূল্য সমান। বম জনগোষ্ঠীকে সন্দেহ দিয়ে নয়, আস্থা দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।

চলতি বছরের মে মাস থেকে জুলাইয়ের মধ্যে কারা হেফাজতে বম জাতিগোষ্ঠীর তিন নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৫৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক। একই সঙ্গে নিরপরাধ বম নাগরিকদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার ও তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। বিবৃতিতে তিনটি মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়, ১৭ জুলাই ভান লাল রুয়াল বম (৩৫), ৩১ মে লাল সাংময় বম (৫৫) এবং ১৫ মে লাল থেলং কিম বমের (২৯) কারা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে।

বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, লাল থেলং কিম বম ও ভান লাল রুয়াল বম বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন। হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে তাঁদের মৃত্যু হয়।

এ ছাড়া গত ৩১ মে ক্যানসারে আক্রান্ত লাল সাংময় বম (৫৫) প্রাণ হারানোর শেষ মুহূর্তে জামিন পেয়েছিলেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পরপর এই তিনটি মৃত্যুর ঘটনা আমাদের স্পষ্ট করে যে রাষ্ট্রের এই নাগরিকেরা কারাবন্দী অবস্থায় সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই পরিবারগুলোর দাবি, তাঁরা কেউই কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট)–সংশ্লিষ্ট বা অপরাধী ছিলেন না।’

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, এর ভিত্তিতে এখনো কোনো অভিযোগপত্র দেয়নি পুলিশ।’ অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একজন অপরাধীরও জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

বিবৃতিতে ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া শিউলি বমের কারাগারে আটক থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, শিউলি বম থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলেও বান্দরবানের নিম্ন আদালতে তিনি জামিন পাননি। সর্বশেষ ২৮ জুলাই উচ্চ আদালতে শিউলিসহ ১১ জন নারীর জামিন আবেদনের শুনানি হলেও জামিন মেলেনি। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে জামিন হলেও রাষ্ট্রপক্ষের বিরোধিতার কারণে তা আটকে গেছে।

বিবৃতিতে কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত, অবিলম্বে নিরপরাধ বম নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, হাটবাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, জুমচাষ ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বন্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা, বম জাতিগোষ্ঠীর ওপর ‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট (গোটা জাতিগোষ্ঠীকে শাস্তি)’ বন্ধ করা ও বন্দী বম নাগরিকদের মুক্তির দাবি জানানো হয়।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, শাহীন আনাম, আনু মুহাম্মদ, শামসুল হুদা, রেহনুমা আহমেদ, ইফতেখারুজ্জামান, জেড আই খান পান্না, শিরীন পারভীন হক, সুমাইয়া খায়ের, শহিদুল আলম, রাজা দেবাশীষ রায় প্রমুখ। (২ আগস্ট ২০২৫, প্রথম আলো)

ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইনডিজেনাস অ্যাফেয়ার্সের (আইডব্লিউজিআইএ) এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান পরিস্থিতি জাতিগত নির্মূল অভিযানের (এথনিক ক্লিনজিং) সুস্পষ্ট লক্ষণ বহন করছে। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযান এখন পুরো বম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একধরনের সম্মিলিত শাস্তির রূপ নিয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নির্বিচার গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে দ্রুত মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে। ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইনডিজেনাস অ্যাফেয়ার্স সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন পার্বত্যচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার করা হয়। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখনো এক গভীর নীরবতা বিরাজ করছে। আমরা দেখছি, কীভাবে একটি জনগোষ্ঠীর অধিকার, নিরাপত্তা ও টিকে থাকার ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র বোঝা যায়, রাষ্ট্র তার সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কেমন আচরণ করে তার স্বরূপ দেখে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের একমাত্র কর্তব্য নয়, প্রত্যেক নাগরিক, প্রতিটি জাতিসত্তার সম্মান, অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। বম জনগোষ্ঠী কোনো বহিরাগত নয়; তারা এই ভূখণ্ডের মানুষেরই অংশ। তাঁদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা, তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করা; এবং তাঁদের মানবাধিকারের প্রশ্নে নীরব থাকা—এসব আসলে মানবাধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতিগত ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।

ফিরে আসি সেই গল্পে। পাখিটা বাঁচবে কি মরবে, তা নির্ভর করে পাখিটি যার হাতে বন্দী হয়ে আছে তার সদিচ্ছার ওপর। বম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল। এই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের মূল্য সমান। বম জনগোষ্ঠীকে সন্দেহ দিয়ে নয়, আস্থা দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা কেমন বাংলাদেশ পেতে চাই? আমরা কি এমন এক বাংলাদেশ চাইব, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেবে? নাকি এমন এক বাংলাদেশ চাইব, যা একটি পাখিকে গলা টিপে মেরে ফেলে?

মিলিন্দ মারমা: লেখক ও অধিকারকর্মী

ইমেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ ক র ওপর ন র জ বন র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ২৯

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কয়েকটি অপরাধপ্রবণ এলাকায় বুধবার দিনভর বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অভিযোগে ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে তিনটি ছুরি, দুটি ধারালো চাকু, দুটি লোহার রড, একটি সাইকেল ও ৩০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়।

বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়মিত মামলা, মাদক মামলা, পরোয়ানাভুক্ত আসামি ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অপরাধী রয়েছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন হীরা (১৯), রফিক (২১), আবদুর রহমান (৩৯), নাবিদ হাসান ওরফে চয়ন (২৬), খোকন (৩১), মনসুর (৩৫), জুয়েল (৩২), সানজু (২২), মিলন (৪২), শাওন (৩৬), নোয়াজ শরীফ (২৮), সেলিম (৩৪), আসাদুজ্জামান ওরফে ইমন (২৩), আনোয়ার হোসেন (৩৬), সজল (৩০), বরকত গাজী (২৮), জুয়েল (৩৮), আরমান (৩০), বাদল (৩৮), কোরবান (২৮), নয়ন (২৭), মাসরুফ (২৩), আল আমিন (২৭), রাকিব (১৮), মিলন (২৫), ওয়াজিদ (৩৬), এরশাদ (২৫), ছালাম ওরফে সামাদ (৩৭) ও দিলসার (৩০)।

সম্পর্কিত নিবন্ধ