ভাঙছে সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া, ৩৪ বছরেও হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ
Published: 11th, August 2025 GMT
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার আলী আকবরডেইল ইউনিয়নের ষাইটপাড়ায় (বেড়িবাঁধের পাশে) মোস্তফা বেগমের বাড়ি। গ্রামটির পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগর। গত জুলাই মাসে কয়েক দফা জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ২ আগস্টের জলোচ্ছ্বাসে মোস্তফা বেগমের ঘর সাগরে বিলীন হয়ে যায়। এরপর দুই মেয়ে-এক ছেলে নিয়ে তিনি আশ্রয় নেন পাশের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। নতুন করে ঘর নির্মাণ করার মতো জমি আর সামর্থ্য কোনোটাই নেই তাঁর।
মোস্তফা বেগম (৫৫) বলেন, তাঁর স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন। মাসখানেক ধরে স্বামীর খোঁজ নেই। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশে বসে আক্ষেপ করেন। ভাবেন, সাগর কেন তার সব কেড়ে নিল।
১৯৯০ সালে মোস্তফা বেগমের বাড়ি ছিল বঙ্গোপসাগরের দেড় কিলোমিটার গভীরে। সেখানে এখন জাহাজ নোঙর করে। ৪০ শতকের বসতভিটাতে ছিল ২০-২৫টি নারকেলগাছ, কয়েকটি আম ও কাঁঠালগাছ। ছিল গরু-ছাগল হাঁস মুরগির খামার। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পুরো গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে সাগরে তলিয়ে যায়। এরপর মোস্তফা ষাইটপাড়ায় এসে ঘর নির্মাণ করেন। গত দুই দশকে তিনবার স্থান পরিবর্তন করতে হয় তাঁকে। আক্ষেপের সুরে মোস্তফা বেগম বলেন, ৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ৩৪ বছর পার হয়েছে। এখনো সেই ঝড় আর ঢেউয়ের ভয়ে থাকেন তিনি।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একাধিক লঘু ও নিম্নচাপের প্রভাব এবং উচ্চ জোয়ারের ধাক্কায় আলী আকবরডেইল ইউনিয়নের তাবলেরচর, কাহারপাড়া, ষাইটপাড়া, বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, হায়দারপাড়া, তেলিপাড়া, আনিছের ডেইল গ্রামে পশ্চিম পাশে নির্মিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ( পাউবো) সাড়ে ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়েক শ ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। জোয়ারের ধাক্কায় বিলীন হয়েছে ৩০টির বেশি বসতবাড়ি। অধিকাংশ ঘর বাঁশ-কাঠ, পলিথিনের ছাউনিযুক্ত। লোনাপানিতে ডুবে আছে শত শত একরের ফসলি জমি, লবণ মাঠ।
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মীর কাশেম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে ইউনিয়নের হাজি মফজল ও মৌলভিপাড়াতে বিলীন ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি। তাতে জলবায়ু উদ্বাস্তু ৪৫০টি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশে বসতি করছেন। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য এই ওয়ার্ডে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও নেই।
পাউবোর দেওয়া তথ্যমতে, সাম্প্রতিক উচ্চ জোয়ারের ধাক্কায় উপজেলার আলী আকবরডেইল, কৈয়ারবিল, দক্ষিণ ধুরুং ও উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের ২০-২৫টি অংশে প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। বিলীনের ঝুঁকিতে আছে আরও ছয়-সাত কিলোমিটার। দ্বীপ উপজেলার চার দিকে বেড়িবাঁধ আছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। পাকিস্তান আমনে নির্মিত বাঁধগুলো উচ্চতা ১০-১২ ফুট।
পাউবো কক্সবাজারের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো.
উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ১৮৭২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত পাঁচটি বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়ার চারপাশের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে অন্তত ২০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছিল। মৃত্যু হয় অন্তত ২৫ হাজার মানুষের।
একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের খুদিয়ারটেক ও রাজাখালী নামের দুটি মৌজা মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। এই দুটি মৌজার অন্তত ৬০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজার শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি খাসজমি, চকরিয়া, রামু, পেকুয়া, টেকনাফ, বান্দরবানের লামা, আলীকদম, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, মিরসরাই, রাউজান, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে।
খুদিয়ারটেক ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আনোয়ারা বেগমও পরিবার নিয়ে থাকেন তাবলের চরে। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের শেষ দিকেও খুদিয়ারটেকে ৪০ হাজার মানুষের বসতি ছিল। এখন কেউ নেই। এই ওয়ার্ডের অন্তত ৩ হাজার একর ভূমি সাগরে বিলীন হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান ও কুতুবদিয়ার বাসিন্দা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, কয়েক দশক আগে কুতুবদিয়ার আয়তন ছিল প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার। সাগরে বিলীন হতে হতে এখন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩০ বর্গকিলোমিটারে ঠেকেছে। বর্তমান লোকসংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার। টেকসই বেড়িবাঁধ না হলে আরও এলাকা বিলীন হয়ে যাবে। গত তিন দশকে ৬০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দ্বীপ ছেড়েছে। জমি কমছে। জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সংকট আরও বাড়বে।
পাউবো সূত্র জানায়, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই এবং ফেনী থেকে নোয়াখালীর রহমতখালী পর্যন্ত ৬৪২ কিলোমিটার উপকূল সুরক্ষায় সুপার ডাইক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। জলবায়ু তহবিলের ৮০ হাজার ১৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত তহবিল সংগ্রহ না হওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সুপার ডাইক প্রকল্পের কুতুবদিয়া অংশে পড়েছে ৬৩ কিলোমিটার।
পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কুতুবদিয়াতে ৪০ কিলোমিটারের সুপার ডাইক বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১০ মিটার উচ্চতায় প্রস্তাবিত সুপার ডাইকের ওপরে দুই লেনের সড়ক, দুই দিকের ঢালুতে সিসি ব্লক বসানোর কথা ছিল। কিন্তু তহবিল সংগ্রহ না হওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ল ন হয় প রকল প জলব য় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
কোটিপতি হলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করেন তিনি
পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের অনেকে কায়িক পরিশ্রম ছেড়ে দেন। আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। কিন্তু সবাই তা করেন না। এমন একজন জাপানের কোইচি মাতসুবারা। ৫৬ বছর বয়সী এই জাপানি নাগরিকের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি ইয়েন (প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা) হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন।
মাতসুবারা সপ্তাহে তিন দিন, প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে কাজ করেন। তিনি সরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
এ কাজ থেকে মাতসুবারা মাসে ১ লাখ ইয়েন (প্রায় ৮২ হাজার ৬৪ টাকা) আয় করেন, যা টোকিওর গড় বেতনের তুলনায় অনেক কম। তারপরও তিনি এ কাজ করেন। কারণ, তিনি এটাকে শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক প্রশান্তির উপায় হিসেবে দেখেন।
মাতসুবারা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ী ছিলেন। মাধ্যমিকের পর তিনি একটি কারখানায় মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ইয়েন (প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) বেতনে কাজ শুরু করেন। খরচ বাঁচিয়ে কয়েক বছরে প্রায় ৩০ লাখ ইয়েন (২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা) সঞ্চয় করে তিনি প্রথম স্টুডিও ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।
পরে বাড়ি কেনার ঋণ আগেভাগে পরিশোধ করে ধীরে ধীরে আরও ফ্ল্যাট কেনেন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন মাতসুবারা। এখন টোকিও ও এর শহরতলিতে তাঁর সাতটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার সবই ভাড়া দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন।
ধনবান হলেও মাতসুবারা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। এখনো তিনি সস্তা ফ্ল্যাটে থাকেন, নিজের খাবার নিজে বানান, নতুন জামাকাপড় কেনেন না, সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং প্রধানত সাইকেলে চলাচল করেন। তাঁর জীবনদর্শন—‘প্রতিদিন কিছু না কিছু করার আশা করি, সুস্থ থাকতে চাই এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে চাই।’
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে মাতসুবারাকে ‘অদৃশ্য কোটিপতি’ বলে উল্লেখ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। জাপানে ধনীদের এমন সাধারণ জীবনধারা অস্বাভাবিক নয়। দেশটিতে সাদাসিধে জীবনযাপন অনেকের মধ্যে দেখা যায়।