মামলা পরিচালনায় সম্পৃক্ত প্রসিকিউটর, তদন্ত কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও আদালতের কর্মচারীদের ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে করা মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়টি এসেছে। এ মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন।

বিচারপতি মো.

গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গত ২ জুলাই এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি গতকাল রোববার ট্রাইব্যুনালে কর্মরত সাংবাদিকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম।

শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলকেও দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ও বুলবুলের কথোপকথন একটি অডিও গত বছরের অক্টোবরে ভার্চ্যুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়ে। এই অডিও সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় দুজনের কথোপকথন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি নয়।

গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। এ মামলার আরেক আসামি বুলবুলও পলাতক।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে শেখ হাসিনা ও বুলবুলের কথোপকথন (ফাঁস হওয়া অডিও) তুলে ধরা হয়েছে। এর এক জায়গায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সব তালিকা করো আর অফিসারদের বলো আমরা তালিকা পাঠাচ্ছি নেত্রীর কাছে। উনি চাইছেন, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ শেখ হাসিনার এই কথার পর বুলবুল বলেন, ‘জি নেত্রী, জি আসসালামু আলাইকুম।’ এরপর শেখ হাসিনা বলেন, ‘চাকরি সামনেও করতে হবে, এটা ভুলে যায় না যেন। এক মাঘে শীত যায় না।’

এই অংশ (কথোপকথন) সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম উল্লেখ না করে কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছেন হাসিনা। তবে ধারণা করা যায়, শেখ হাসিনা মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের (প্রসিকিউটর, তদন্ত কর্মকর্তা, ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য) ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়েছেন।

বুলবুলের সঙ্গে কথোপকথনের মাঝামাঝি সময়ে শেখ হাসিনা কী বলেছেন, সেটিও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমার তো সারা বাংলাদেশে ২২৭টি মার্ডার কেস। তোমরা তালিকা করো। ধরো অন্তত ২২৭ জনকে মারার লাইসেন্স পেয়ে গেছি। আর এক মামলার যে শাস্তি আর সোয়া ২০০ মামলায় সেই শাস্তি, তাই না? তো ঠিক আছে, সেই শাস্তি নেব কিন্তু তার আগে সোয়া ২০০ হিসাব করে নেব। এটা যেন মাথায় থাকে।’

রায়ে বলা হয়েছে, বুলবুলের কাছে শেখ হাসিনা ২২৭ জনকে হত্যার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেছেন। সে জন্য বুলবুলকে তিনি ২২৭ জনের একটি তালিকা তৈরি করতে বলেছেন।

‘সবকিছু কি প্রকাশ্যে করতে হয়’

অডিওতে শেখ হাসিনাকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘একটা কথা আমি বলি, তোমাদের কার বাড়ি পোড়াইছে কে?’ তখন বুলবুল বলেন, ‘ওই ওরাই নেত্রী, সবাই, জামাত-বিএনপি সকলেই।’ এরপর শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের বাড়িঘর নাই?’ বুলবুল বলেন, ‘আছে নেত্রী।’ হাসিনা বলেন, ‘তাদের ঘরবাড়ি নাই।’ বুলবুল বলেন, ‘জি, আছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাহলে, সবকিছু কি প্রকাশ্যে করতে হয়?’ বুলবুল বলেন, ‘জি না, না নেত্রী, জি।’ এরপর শেখ হাসিনা, ‘আমাদের ঘরবাড়ি নাই, তাদেরও ঘরবাড়ি থাকবে না।’

কথোপকথনের এই বিষয়টি তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে, এসব বলে প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে বুলবুলকে উসকে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা ও বুলবুলের কথোপকথনের ওই অডিওর ফরেনসিক পরীক্ষার বাইরেও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা বিষয়টির তদন্ত করেন বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই তদন্ত সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, গাইবান্ধার সাংবাদিক সুমন মিয়া ফাঁস হওয়া ওই অডিও প্রথমে পান। অডিওর কথোপকথনটি স্থানীয় সাংবাদিক ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বুলবুল। তদন্তে আরও উঠে আসে, ‘এ টিম’ নামের একটি গ্রুপের (অনলাইনভিত্তিক) মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে ও জুমে আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) গোপন সভা হতো। গত বছরের ২৫ অক্টোবর সে রকম একটি সভায় শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।

ট্রাইব্যুনালে তিন মামলা বিচারাধীন

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা একটি মামলার এখন সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তাঁর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর একটিতে আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনামলে গুম–খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায়ও শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত তদন ত সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

দিল্লির স্বামী চৈতন্যানন্দ হোয়াটসঅ্যাপে ছাত্রীদের কী ধরনের বার্তা পাঠাতেন

ভারতের স্বঘোষিত ধর্মগুরু স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতীর গ্রেপ্তারের পর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট থেকে এমন চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ওই চ্যাটে ছাত্রীদের ওপর তাঁর যৌন হয়রানির চিত্র উঠে এসেছে।

ভারতের সাউথওয়েস্ট পশ্চিম দিল্লি এলাকায় একটি আশ্রমের মাধ্যমে শ্রী শারদা ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ম্যানেজমেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে থাকে। অভিযুক্ত স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতী এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ছিলেন। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন।

বার্তা আদানপ্রদানের প্ল্যাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপে একটি চ্যাটে দেখা যায়, স্বামী চৈতন্যানন্দ কথিত ‘দুবাইয়ের এক শেখের’ সঙ্গে এক ছাত্রীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন।

এক ছাত্রীর সঙ্গে কথোপকথনে ৬২ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি এমন কথা লিখেছেন যাতে দেখা যায়, তিনি দুবাইয়ের এক শেখের কথা বলে এক ছাত্রীকে সঙ্গী খুঁজে দেওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর কোনো সহপাঠী বা জুনিয়র কেউ আছে কি না, জানতে চেয়েছেন। ওই ছাত্রী ‘না’ সূচক জবাব দিয়েছেন।

আরেকটি চ্যাটে দেখা যায়, চৈতন্যানন্দ এক ছাত্রীকে বারবার ‘বেবি’ ‘বেবি ডটার ডল’ বলে সম্বোধন করছেন।

একবার স্বামী চৈতন্যানন্দ লিখেছিলেন, ‘শুভ সন্ধ্যা আমার সবচেয়ে প্রিয় বেবি ডটার ডল।’

জবাবে ওই ছাত্রী লিখেছেন, ‘এখানে তো দুপুর স্যার, শুভ দুপুর। আপনি কিছু খেয়েছেন স্যার?’

অন্য একটি চ্যাটে স্বামী চৈতন্যানন্দ ‘ডিসকো ডান্স’ করার বিষয়ে রসিকতা করে ছাত্রীকে বার্তা দেন। ছাত্রীটি তাঁর সঙ্গে এতে যোগ দিতে চান কি না, তা জানতে চান। ছাত্রীটি সম্ভবত ভদ্রতার খাতিরে উত্তরে লেখে, ‘ওয়াও স্যার, দারুণ।’

আরেকটি কথোপকথনে স্বামী চৈতন্যানন্দ এক ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাবে না?’

আগ্রা থেকে গ্রেপ্তার

কমপক্ষে ১৭ জন ছাত্রীকে হয়রানির অভিযোগে স্বামী চৈতন্যানন্দকে গত রোরবার ভোর সাড়ে তিনটার দিকে আগ্রার তাজগঞ্জ এলাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, তিনি প্রায় দুই মাস ধরে গ্রেপ্তার এড়াতে বৃন্দাবন, মথুরা ও আগ্রার মধ্যে ঘোরাঘুরি করছিলেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে প্রায়ই তিনি ছোট হোটেলে থাকতেন ও ট্যাক্সি ব্যবহার করতেন।

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, স্বামী চৈতন্যানন্দ গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘পার্থ সারথি’ ছদ্মনামে আগ্রার ওই হোটেলে ওঠেন এবং ১০১ নম্বর কক্ষে ছিলেন। কর্মচারীরা জানান, গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত তিনি তাঁর কক্ষেই ছিলেন।

স্বামী চৈতন্যানন্দ পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে আছেন। তাঁকে শারদা ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ম্যানেজমেন্টের তিনজন নারী সহকর্মীর মুখোমুখি করা হবে। অভিযোগ রয়েছে, এই নারী সহকর্মীরা তাঁর পক্ষ নিয়ে ছাত্রীদের হুমকি দিতেন এবং অপরাধমূলক মেসেজ মুছে ফেলতে সাহায্য করেছিলেন।

গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ একটি আইপ্যাড ও তিনটি মোবাইল ফোন জব্দ করেছে, যার একটির মাধ্যমে ইনস্টিটিউটের সিসিটিভি ক্যামেরা এবং হোস্টেলের চত্বরে দূর থেকে নজর রাখা যেত।

রাষ্ট্রসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলে ‘স্থায়ী রাষ্ট্রদূত’ ও ব্রিকসের জন্য ‘বিশেষ দূত’ হিসেবে স্বামী চৈতন্যানন্দের নামে বানানো জাল ভিজিটিং কার্ডও উদ্ধার করা হয়েছে।

স্বামী চৈতন্যানন্দের কাছ থেকে দুটি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। একটি ‘স্বামী পার্থ সারথি’ নামে এবং অন্যটি ‘স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতী’ নামে। দুই পাসপোর্টে তাঁর জন্মস্থান ও পিতামাতার তথ্যে গরমিল ছিল। পুলিশ তাঁর ৮ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে।

তদন্তকারীরা আরও জানতে পারেন, আগস্টে এফআইআর দায়ের হওয়ার পর স্বামী চৈতন্যানন্দ জাল নথি ব্যবহার করে ৫০ লাখ টাকারও বেশি তুলে নিয়েছিলেন।
এসব অভিযোগ প্রথম সামনে আসে দিল্লিতে স্বামী চৈতন্যানন্দের ব্যক্তিগত ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্রীদের কাছ থেকে। এফআইআরে বলা হয়েছে, তিনি কিছু ছাত্রীকে গভীর রাতে তাঁর কক্ষে যেতে বাধ্য করতেন। অসময়ে অশ্লীল ও আপত্তিকর বার্তা পাঠাতেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দিল্লির স্বামী চৈতন্যানন্দ হোয়াটসঅ্যাপে ছাত্রীদের কী ধরনের বার্তা পাঠাতেন