বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ে ২৮০ খেলাপি প্রতিষ্ঠান সুবিধা পেল
Published: 13th, August 2025 GMT
ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের ঋণ আবারও পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতায় ব্যবসায়ীদের এই সুযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে প্রায় ২৮০টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে আরও এক হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন।
প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো টাকা জমা দিয়ে নবায়ন করতে পারছে না। এ জন্য বিশেষ সুবিধার আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হচ্ছে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ। যাদের ঋণের স্থিতি ৫০ কোটি টাকার বেশি, শুধু তাদের এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই সুবিধা দিতে চলতি বছরের শুরুতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ের নেতাদের ব্যবসা রয়েছে এই তালিকায়। আবার কারও কারও ব্যবসা খারাপ হয়েছে করোনাভাইরাস, ডলার-সংকটের সময়। আবার সুবিধা পাওয়া কারও কারও বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এবার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পাওয়া কিছু প্রতিষ্ঠান এর আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এ ধরনের সুবিধা পেয়েছে। তবে এ পর্যন্ত ঠিক কী পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর তখনই হবে, যখন গ্রাহক নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা দেওয়ার পর ব্যাংক তা কার্যকর করবে। তবে যাঁরা নির্বাচন করবেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ঋণ নবায়ন করে ফেলছেন বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ২৮০টি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ নীতিসহায়তা দিতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আরও আবেদন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরবে।
এখন পর্যন্ত কারা পেল সুবিধা
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এনার্জিপ্যাক গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা ঋণ নিয়মিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে গ্রুপটি।
এ বিষয়ে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস, ডলার-সংকট ও সরকারের বিল বকেয়া থাকায় আমাদের ঋণ খারাপ হয়ে যায়। ছয় বছর ধরে সরকার আমাদের বিল আটকে রেখেছিল। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনের বিশেষ সুযোগ দিয়েছে।’
হুমায়ূন রশীদ আরও বলেন, ‘আমরা নেপালে ট্রান্সফরমার রপ্তানি করেছি। বড় অঙ্কের ক্রয়াদেশ পেয়েছি। ডলারের অস্থিরতা কমে আসায় এখন ব্যবসা ভালো হওয়ার লক্ষণ দেখছি।’
এনার্জিপ্যাক ছাড়া এনায়েতুর রহমান বাপ্পীর মালিকানাধীন বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তাঁর মালিকানায় থাকা ভার্গো মিডিয়ার (চ্যানেল নাইন) ঋণও পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। বিল্ডট্রেডের ঋণ এবি ব্যাংকে ও ভার্গো মিডিয়ার ঋণ রূপালী ব্যাংকে।
এ ছাড়া ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে বিএনপির কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতের সৌরভ গ্রুপ, রাজশাহীর এরশাদ গ্রুপ, হবিগঞ্জে অবস্থিত ব্যবসায়ী আরিফুর রহমানের মালিকানাধীন ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান প্যালেস রিসোর্ট, স্কাই ক্যাপিটাল ও বদর স্পিনিং মিলস। সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আরও আছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, বেঙ্গল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল প্লাস্টিক, আবদুল মোনেম গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, ওপেক্স সিনহা ও তানাকা গ্রুপ।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের সময় আগুনে পুড়ে যাওয়া গাজী গ্রুপের ঋণও পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে। এই তালিকায় আরও রয়েছে জিয়া পরিবারের মালিকানায় থাকা ড্যান্ডি ডাইং লিমিটেড, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আসলাম চৌধুরীর রাইজিং স্টিল, সিলেট বিএনপির নেতা খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের সাবাব ফেব্রিকস, গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ওয়ান ডেনিম, ইলেকট্রনিক খাতের পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ইলেকট্রনিকস, ইফাদ গ্রুপ, এমবিয়েন্ট স্টিল (বিডি), জিপিএইচ ইস্পাত, প্রাইম গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, সিল্কওয়েজ গ্রুপ, তানাকা গ্রুপ, ডায়মন্ড স্পিনিং মিলস, মীম গ্রুপ (আলেমা টেক্সটাইল), এসএমএ গ্রুপ (এএ নিট স্পিন), বিইউসি অ্যাগ্রো, ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস, অ্যাপেক্স ওয়েভিং ও অঙ্কুর স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজ। তবে সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর সব প্রতিষ্ঠানই খেলাপি হয়েছে এমন নয়। কোনো কোনো গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যেসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে
প্রচলিত নিয়মে কোনো ঋণ খেলাপি হলে গড়ে সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে ওই ঋণ নবায়ন করা যায়। নবায়ন করা ঋণ পরিশোধে এক বছর পর্যন্ত বিরতি (গ্রেস পিরিয়ড) ও সাত বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুবিধা পাওয়া যায়।
তবে বিশেষ ক্ষমতায় দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এবারের ঋণ পুনর্গঠন সুবিধার আওতায় খেলাপি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধে ৫ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া হচ্ছে। আর মাত্র ১ শতাংশ এককালীন জমা বা ডাউন পেমেন্টে দেওয়া হচ্ছে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা। সেই সঙ্গে আছে ঋণ পরিশোধে তিন বছরে বিরতির সুযোগ।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় অনেক ভালো ব্যবসায়ীও ঋণের কিস্তি পরিশোধে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। তাতে ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। বাড়ছে ঋণের সুদহার। আবার ব্যাংকারদের কেউ কেউ বলছেন, যাঁরা পুনর্গঠনের সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁদের অনেকের ঋণ দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি হয়ে আছে। এসব গ্রাহক থেকে বছরের পর বছর কোনো টাকা আদায় করা যাচ্ছিল না। এখন পুনর্গঠনের আওতায় ব্যাংক এককালীন জমা বাবদ কিছু অর্থ পাচ্ছে, যা অনেক ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতিতে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন পর অনেক গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) কোষাধ্যক্ষ ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, গাজী গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের এ ধরনের সুবিধা দেওয়াটা যৌক্তিক। তবে করোনাভাইরাস ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির মতো পুরোনো ইস্যুতে যাদের এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সেটি প্রয়োজন ছিল না। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধে ১৫ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠনের বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ১১টি শিল্প গ্রুপকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, এননটেক্স, রতনপুর গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, বিআর স্পিনিং, রাইজিং গ্রুপ ও আবদুল মোনেম। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি এবারও ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে এরই মধ্যে।
বাড়ছে খেলাপি ঋণ
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতরণ করা ব্যাংকঋণের একটি বড় অংশ এখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত দলটির শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঋণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আবার দেশের অর্থনীতিতে বর্তমান মন্দাবস্থার কারণেও বহু ব্যবসায়ীর ঋণ খারাপ হতে শুরু করেছে। এ ছাড়া নতুন নীতিমালার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি হয়ে গেছে। গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা গত জুনে বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ পুনর্গঠনের ফলে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমবে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি না ফিরলে এসব ঋণ আবার খারাপ হয়ে যাবে। তাই ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ ও গতি ফিরিয়ে আনাটা এখন জরুরি।
এ বিষয়ে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হতো। এবার যৌক্তিক কারণে দেওয়া হচ্ছে। তাতে সবাই আবেদন করতে পারছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক নানা ধরনের নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও পরিদর্শনের পর ঋণ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরের চূড়ান্ত ভার ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা ভালো। তবে মেয়াদ বেশি হওয়ায় টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক খ র প হয় দ র এই স ব যবস য় র ব যবস ক র ঋণ ঋণ র প র অন ক সরক র রহম ন ধরন র ব এনপ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বের সেরা কর্মস্থল হিলটন হোটেল, সেরা তালিকায় আছে মেটলাইফ
আধুনিক মানুষের দিনের বড় একটা সময় যায় কর্মস্থলে। ফলে সেই কর্মস্থলের পরিবেশ কেমন, কর্তৃপক্ষ কর্মীদের কথা কতটা ভাবছে—এ সবকিছু এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।
সম্মান, নিরাপত্তা, উন্নতির সুযোগ ও কাজের অর্থবহতা আছে—মানুষ সাধারণত এমন কর্মস্থলই চায়। এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। তারা মূলত বিশ্বের সেরা ২৫ কর্মস্থলের তালিকা করে। সেই তালিকায় সবার ওপরে আছে হিলটন হোটেল। মূলত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এই জরিপ ও তালিকা করা হয়েছে।
এবারের তালিকায় ২৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টি যুক্তরাষ্ট্রের। অন্যগুলো বিভিন্ন দেশের, মূলত ইউরোপের। কোম্পানিগুলোর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে—২৫টি কোম্পানির মধ্যে ৮টি এই খাতের। এ ছাড়া নির্মাণ, জৈব ওষুধ, উৎপাদন, কুরিয়ার, আর্থিক ও পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানিগুলোও তালিকায় আছে।
সেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি কোম্পানি হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জীবনবিমা কোম্পানি মেটলাইফ। ২০২৫ সালে দশম স্থান অর্জন করে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো এই মর্যাদাপূর্ণ বৈশ্বিক স্বীকৃতি ধরে রাখল কোম্পানিটি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪০টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম রয়েছে।
৯০ লাখের বেশি উত্তরের ওপর ভিত্তি করে ফরচুনের সেরা ২৫টি কর্মক্ষেত্রের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী আড়াই কোটি কর্মীর কাজের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে মেটলাইফের প্রেসিডেন্ট ও সিইও মিশেল খালাফ বলেন, ‘টানা দ্বিতীয় বছরের মতো বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকায় স্থান পাওয়া কর্মীদের নিষ্ঠা ও উদ্যোগের প্রমাণ।’
কারা আছে তালিকায়দেখে নেওয়া যাক এবারের তালিকায় কোন কোন দেশের কোম্পানি আছে। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে কুরিয়ার ও যাতায়াত খাতের কোম্পানি ডিএইচএল। তৃতীয় স্থানে আছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সিসকো। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রে। চতুর্থ স্থানে আছে পেশাদার সেবা দেওয়া আইরিশ কোম্পানি অ্যাক্সেনচিউর, পঞ্চম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বিশ্বখ্যাত হোটেল ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল। ষষ্ঠ স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি অ্যাব ভিয়ে, সপ্তম স্থানে আছে ফ্রান্সের পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানি টিপি। অষ্টম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনভিত্তিক কোম্পানি স্ট্রাইকার, নবম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি সেলস ফোর্স।
দশম স্থানে আছে মার্কিন বিমা কোম্পানি মেটলাইফ, ১১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সার্ভিস নাউ। ১২তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি স্পেকসেভার্স। ১৩তম স্থানে আছে জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি সিমেন্স হেলদিনেস; ১৪তম স্থানে আছে আইরিশ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এক্সপেরিয়েন। ১৫তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এনভিডিয়া, ১৬তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি কেডেন্স। ১৭তম স্থানে আছে জার্মানির বিমা ও আর্থিক কোম্পানি আলিয়াঞ্জ এবং ১৮তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতের কোম্পানি ডাও।
১৯ থেকে ২১তম স্থানে আছে তিনটি মার্কিন কোম্পানি। ১৯তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি ভিয়াট্রিস, ২০তম স্থানে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাডোবি, ২১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ক্রাউডস্ট্রাইক।
২২ ও ২৩তম স্থানেও আছে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি কোম্পানি—উৎপাদন খাতের এসসি জনসন ও খুচরা বিক্রয় খাতের ট্রেক বাইসাইকেল। ২৪তম স্থানে আছে লিচেনস্টাইনের নির্মাণ কোম্পানি হিলতি ও ২৫তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের বিমা ও আর্থিক খাতের কোম্পানি অ্যাডমিরাল গ্রুপ।
কীভাবে এই মূল্যায়ন৩০ বছর ধরে এই জরিপ পরিচালনা করছে ফরচুন ম্যাগাজিন। সারা বিশ্বের কর্মীদের কাছ থেকে তারা জানতে চায়, কর্মস্থলে তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কিছু মানদণ্ড তৈরি করে। সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতে বোঝা যায়, কোনো কর্মস্থল প্রকৃত অর্থেই ‘দারুণ’ কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা সে প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান কি না, প্রতিষ্ঠান কত দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ও তার সামগ্রিক ব্যবসায়িক সাফল্য কতটা মিলবে—এসব বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায় জরিপে।
ফরচুন ম্যাগাজিন নিজস্ব ট্রাস্ট ইনডেক্স বা আস্থাসূচক তৈরি করেছে। ব্যবস্থাপনার প্রতি কর্মীদের আস্থা কতটা, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ও কোম্পানির প্রতি কর্মীদের আনুগত্য কতটা—এসব আস্থাসূচকের মাধ্যমে এসব বিষয় পরিমাপ করা হয়।
এ জরিপে কর্মীরা গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁদের মতামত জানাতে পারেন। ৬০টি বিষয়ের ওপর ৫ পয়েন্টের ভিত্তিতে উত্তর দিতে হয়, সঙ্গে থাকে ২টি উন্মুক্ত প্রশ্ন।
কর্মীদের কাছ থেকে যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয়, সেগুলো হলো নেতৃত্বের কাছে কি সহজে যাওয়া যায়, নেতৃত্ব সততা ও স্বচ্চতার সঙ্গে কথা বলেন ও কাজ করেন কি না, নেতৃত্বের কথা ও কাজে মিল আছে কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে সম্মানিত বোধ করেন কি না এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কতটা। নেতৃত্ব কর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানান কি না এবং কর্মীদের সুস্থতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না। এ ছাড়া কর্মীদের অবদান রাখার সুযোগ আছে কি না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়।
জরিপে কর্মীদের কাছে আরও যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয় সেগুলো হলো:বেতন, মুনাফা, পদোন্নতি, স্বীকৃতি ও সুযোগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কতটা ন্যায়সংগত;
কর্মীরা নিজেদের কাজ, কর্মদল ও প্রতিষ্ঠানের জন্য গর্ব বোধ করেন;
কাজ অর্থবহ এবং তা পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে;
সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগে;
কর্মীরা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারেন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অভিজ্ঞতার ভিন্নতা কতটা, তা–ও জরিপে পরিমাপ করা হয়। কর্মীদের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা ও গুণগত মানও মূল্যায়ন করা হয়। এভাবে প্রতিটি ধাপে কঠোর মানদণ্ড মেনে এই তালিকা করা হয় বলে জানিয়েছে ফরচুন ম্যাগাজিন।