বিমানের ফ্লাইটে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটি, নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
Published: 13th, August 2025 GMT
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটছে। কোনো উড়োজাহাজ মেরামতের পর উড্ডয়ন করছে, আবার কোনোটা গ্রাউন্ডেড করা হচ্ছে। নিয়মিত শিডিউল বিপর্যয়ের পাশাপাশি বাতিল হচ্ছে ফ্লাইট। এর খেসারত দিতে হচ্ছে যাত্রী ও বিমান কর্তৃপক্ষকে।
গত এক মাসে দেশি-বিদেশি রুটে অন্তত ৯টি উড়োজাহাজে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে। যদিও বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে, তবে এসব ঘটনায় যাত্রীসেবা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
বিমানের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ দিনে আবুধাবি, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরসহ একাধিক রুটে মাঝ আকাশে বা উড্ডয়নের আগে উড়োজাহাজে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোথাও টয়লেট বিকল, কোথাও ইঞ্জিনে ত্রুটি, আবার কোথাও রানওয়েতে আটকে পড়েছে উড়োজাহাজ। এতে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, সংযোগ ফ্লাইট মিস এবং গন্তব্যে যেতে না পারার ঘটনা ঘটেছে।
গত রোববার (১০ আগস্ট) রোমের লেওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দরে একটি বোয়িং ড্রিমলাইনার ডানার ফ্ল্যাপ ত্রুটির কারণে ‘গ্রাউন্ডেড’ হয়। লন্ডন থেকে যন্ত্রাংশ এনে মেরামতের আগে ২৬২ জন যাত্রীকে হোটেলে রাখা হয়। পরদিন সোমবার ড্যাশ-৮ মডেলের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের কেবিনের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ২০ মিনিট উড়ে ঢাকায় ফিরে আসে।
আগস্টের শুরুর দিকেও তিনটি উড়োজাহাজে ত্রুটি দেখা দেয়। এর মধ্যে ৬ আগস্ট ব্যাংককগামী বোয়িং ৭৩৭ ইঞ্জিন কম্পনের কারণে ফিরে আসে, ৭ আগস্ট আবুধাবিগামী বোয়িং টয়লেট বিকল হয়ে ঢাকায় ফেরে এবং ৯ আগস্ট সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পথে বোয়িংয়ে সমস্যা হয়।
গতকাল ১২ আগস্ট ঢাকা থেকে কুয়েত ও দুবাইয়ের দুটি ফ্লাইটই পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ দিয়ে। উড়োজাহাজ সংকটে উভয় ফ্লাইটই বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-কুয়েত রুটের বিজি ৩৪৩ ফ্লাইটটি ছিল বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটে। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইগামী ফ্লাইটটি ছিল বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে।
কেন দুটি ফ্লাইট বাতিল করা হলো জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ বি এম রওশন কবীর বলেন, উড়োজাহাজের সংকট। কারণ, রোমে যে ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটি গ্রাউন্ডেড আছে, সেটি উড্ডয়ন উপযোগী করতে ১২ আগস্ট বিমানের নিজস্ব ৫ জন প্রকৌশলী গেছেন। আশা করা যাচ্ছে, ওই দিন সন্ধ্যা নাগাদ উড়োজাহাজটি উড্ডয়ন উপযোগী হবে।
বিমানের ফ্লাইটে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটি বিষয়ে জানতে চাইলে এ বি এম রওশন কবীর বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় এবং ত্রুটি সম্পূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত উড়োজাহাজ আকাশে ওঠে না।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনা আকস্মিক নয়। এগুলো বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম ইউএনবিকে বলেন, একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটছে, এটি সত্যি। বহরের বেশির ভাগ উড়োজাহাজ অনেক পুরোনো হওয়ায় সমস্যা নিয়মিত দেখা দিচ্ছে। এসব ত্রুটি বিমান শনাক্ত করে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আরও তদারকি বাড়াতে হবে। তবে এসব ত্রুটি প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এ বি এম রওশন কবীর আরও বলেন, যেহেতু উড়োজাহাজগুলো পুরোনো, তাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা করতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার ও পাইলট নিয়োগে স্বজনপ্রীতি করা যাবে না। যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে।
এর আগে গত জুলাই মাসেও বিমানের উড়োজাহাজে কয়েকটি বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে, যার মধ্যে দুবাই ও শারজায় ড্রিমলাইনার ও বোয়িং উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড হওয়ার ঘটনা রয়েছে।
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে ১৯টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং এবং ৫টি কানাডার ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের। বোয়িংয়ের উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে: ৪টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ৪টি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, ২টি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার।
বিমান সূত্রে জানা যায়, যাত্রী ভোগান্তি কমাতে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে, পাশাপাশি নতুন ক্রয় পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এক র পর এক য ন ত র ক ত র ট গ র উন ড ড ফ ল ইট আগস ট র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
রওশন জাহান: বোন, শিক্ষক ও সহযোদ্ধা
রওশন জাহান বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে গবেষকদের অন্যতম অগ্রদূত। ৪ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। রওশন জাহান আমার বোন। আমাদের ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আমার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান চার বছরের। রওশন যেন শিক্ষক হয়েই জন্মেছিলেন। আমি যখন ছোট, যেকোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে ছুটে যেতাম তাঁর কাছেই।
কিছু বাংলা ধ্বনি উচ্চারণে আমার ও ছোট ভাই কবিরের সমস্যা ছিল। রওশনের বয়স তখন আট বা নয় বছর। তবু আমাদের শেখাতে পেরেছিলেন জিব কীভাবে নাড়িয়ে সঠিক উচ্চারণ করা যায়।
রওশন ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। চার বছর বয়সেই পড়াশোনা নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে সাহিত্যে। রওশন কথাবার্তায় পারঙ্গম ছিলেন, সহজেই বন্ধু বানাতে পারতেন। যেসব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, সবখানেই শিক্ষকরা তাঁর প্রতিভার গুণমুগ্ধ ছিলেন।
আমি ছিলাম তাঁর চার বছরের ছোট। তিনি চাইলেই কেবল সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারতেন, তবু আমাকে অনেক সময় দিয়েছেন। একসঙ্গে খেলেছেন, গল্প শুনিয়েছেন, বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ শিখিয়েছেন। এমনকি শিখিয়েছেন সাহিত্যও।
আমরা একটি অভিন্ন শৈশবের অংশ ছিলাম। একসঙ্গে থেকেছি স্কুল ও কলেজজীবনজুড়ে। এরপর এল ১৯৬১ সাল। ফুলব্রাইট শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার জন্য রওশন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমালেন।
শুধু পড়াশোনায়ই নয়, রওশন অন্যান্য ক্ষেত্রেও অসাধারণ ছিলেন। স্কুলে তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন, কুমিল্লায় ওস্তাদ আয়াত আলী খানের কাছে শিখেছিলেন সংগীত। সিনেমা আর খেলাধুলাতেও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। মনে পড়ে, একবার কলকাতার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ঢাকায় এসেছিল ফুটবল খেলতে। রওশন আর আমি মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। পুরো দর্শকভর্তি স্টেডিয়ামে শুধু আমরা দুজনই ছিলাম মেয়ে। সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে রওশন কখনোই দ্বিধা করতেন না।
রওশন জীবনের সহজ আনন্দগুলো থেকেই সুখ পেতেন। রওশন জাহান ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক। তিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন নিজস্ব সীমানার বাইরের এক বিশাল পৃথিবীর দিকে। আমার সৌভাগ্য যে এমন একজন অসাধারণ মানুষ আমার জীবনে এসেছিলেন এবং এত বছর আমার সঙ্গী হয়ে ছিলেন।ইংরেজি সাহিত্যে এমএ শেষ করে রওশন স্বল্প সময়ের জন্য ইডেন মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন শিক্ষার্থীদের রওশন বাংলা শেখাতেন। তাঁদের অনেকে আজও তাঁকে স্নেহভরে মনে রেখেছেন। ৯২ বছর বয়সেও অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাস কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলেছিলেন, রওশনই তাঁকে বাংলা শিখিয়েছিলেন। তাঁর শেখানো বাংলা পাঠের রেকর্ডিং বহু বছর ধরে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
শিকাগোতেই রওশনের সঙ্গে পরিচয় হয় মোজাফ্ফর আহমদের। মোজাফ্ফর তখন অর্থনীতিতে পিএইচডি করছিলেন। ১৯৬৬ সালে রওশন ঢাকায় ফিরে আসার পর তাঁরা একত্রে আবদ্ধ হন যৌথ জীবনে। আমি তাঁদের বিয়েতে থাকতে পারিনি। কারণ, তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলাম।
বিয়ের পর রওশন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরে যাননি। আমি সব সময় মনে করেছি, তাঁর এই সিদ্ধান্ত জাতির জন্য এক বিরাট ক্ষতি হয়েছে। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা এক উত্তম শিক্ষকের কাছ থেকে শেখার সুযোগ হারিয়েছে। কারণ, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য এবং ভাষাবিজ্ঞানের অসাধারণ সব গবেষক তৈরি করতে পারতেন রওশন। মানুষকে কিছু শেখানোর এক বিস্ময়কর দক্ষতা ছিল তাঁর।
১৯৭৩ সালে আমি নারীদের নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নিলে তাঁকে আমাদের সাপ্তাহিক পাঠচক্রে যোগ দিতে অনুরোধ করি। রওশন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন। সে বছরই উইমেন ইন বাংলাদেশ শিরোনামে ইংরেজিতে আমার প্রথম প্রবন্ধটি লিখি। রওশন সেটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, যাতে তা আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছায়।
পরে আহমদ ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এক বড় আলোচনার আয়োজন করেন। সেখানে আমি প্রবন্ধটি বাংলায় উপস্থাপন করি। রাজিয়া খান আমিন ও সুরাইয়া খানম ছিলেন আলোচক।
১৯৭৫ সালে আমরা পাঠচক্রের গ্রুপটিকে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) হিসেবে নিবন্ধন করি। নাম দিই উইমেন ফর উইমেন। একই নামে একটি বইও প্রকাশ করেছিলাম। সেখানে রওশন ‘বাংলা সাহিত্যে নারী’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। রওশন পরে সংগঠনটির সভাপতি হন। গবেষণা ও লেখালেখির মাধ্যমে দুই দশক ধরে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটিকে সক্রিয় রাখেন।
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে তিনি নানা বিষয়ে গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন, একই সঙ্গে বহু বই প্রকাশ করেন। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেও তাঁর গবেষণার পরিসর ছিল বিস্তৃত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, পরিবেশ, আন্দোলন ও রাজনীতি, শ্রমিকের কর্মপরিস্থিতি, নারীর প্রতি সহিংসতা—সব বিষয়েই তিনি কাজ করেছেন।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকাশনা বেগম রোকেয়ার সুলতানাস ড্রিম-এর সম্পাদিত ইংরেজি সংস্করণ। বইটি নিউইয়র্কের ফেমিনিস্ট প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার অধ্যয়ন কোর্সে দীর্ঘদিন পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আজও বইটির চাহিদা ব্যাপক।
রওশন রোকেয়ার অবরোধবাসিনীর অংশবিশেষ এবং আহমদ ছফার ওঙ্কার ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
গবেষণা ও লেখালেখির পাশাপাশি রওশন নানা নারীবিষয়ক ও নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, সিএএমপিই, এডুকেশন ওয়াচ এবং বাংলা-জার্মান সম্প্রীতির মতো সংগঠনগুলোতে তিনি বহু বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বহু প্রতিবেদনের তিনি লেখক বা সম্পাদক। রওশন কখনোই প্রচারের আলোয় আসতে চাননি। তিনি ছিলেন নেপথ্যের নীরব কর্মী, কিন্তু
অত্যন্ত কার্যকর।
রওশন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বহু সম্মেলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। আমরা দুজন মিলে ১৯৮৫ সালে নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নারী সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলাম। পরে ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে চতুর্থ জাতিসংঘ নারী সম্মেলনে আমরা তিন বোন—রওশন, নিলুফার ও আমি একসঙ্গে যোগ দিই। রওশন ও নিলুফার শুধু আমার বোনই ছিলেন না, ছিলেন আমার সহযোদ্ধাও। একই লক্ষ্য ও স্বপ্নের জন্য আমরা একসঙ্গে লড়েছি। রওশনের কন্যা সোহেলা নাজনীনও এখন যোগ দিয়েছে একই মহৎ সংগ্রামে।
রওশন আর আমার নিবিড় সম্পর্ক অনেকের কাছেই বিস্ময়কর লাগতে পারে। কারণ, আমাদের ব্যক্তিত্ব ছিল একেবারেই ভিন্ন। রওশন ছিলেন সত্যিকারের সদয় ও বিনয়ী মানুষ। কখনো কাউকে কষ্ট দিতেন না, নিজেকে কখনো সামনে আনতেন না—প্রায় সন্তের মতো একজন মানুষ। আর আমি ছিলাম একেবারে উল্টো। তবু আমাদের মধ্যে কখনো ঝগড়া হয়নি, মূলত রওশন এত প্রীতিপূর্ণ ও ক্ষমাশীল ছিলেন বলেই।
তাঁর চলে যাওয়া আমার জীবনে এমন এক শূন্যতা রেখে গেছে, যা কখনো পূরণ হবে না। বাকি জীবনের প্রতিমুহূর্তেই আমি তাঁকে গভীরভাবে অনুভব করব। তবে একই সঙ্গে আনন্দে স্মরণ করব আমাদের একসঙ্গে কাটানো সুখের সময়গুলো। যে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রতিটি গাছ ও ফুল চিনিয়ে দিতেন; আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখাতেন আর সেগুলোর নাম বলতেন; বই বা কবিতা পড়ার সময় পুরোটা মুখস্থ বলতেন; কিংবা কোনো গান শুনে গলা মিলিয়ে গাইতেন—সেই সময়গুলো মনে পড়বে।
রওশন জীবনের সহজ আনন্দগুলো থেকেই সুখ পেতেন। রওশন জাহান ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক। তিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন নিজস্ব সীমানার বাইরের এক বিশাল পৃথিবীর দিকে। আমার সৌভাগ্য যে এমন একজন অসাধারণ মানুষ আমার জীবনে এসেছিলেন এবং এত বছর আমার সঙ্গী হয়ে ছিলেন।
● অধ্যাপক ড. রওনক জাহান ডিস্টিংগুইশড ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)