বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর দেশের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব বা সাসটেইনেবল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করে আসছে। পূবালী ব্যাংক প্রথম ২০২১ সালে এই তালিকায় স্থান পায়। দুই বছর পর ২০২৪ সালে আবারও ব্যাংকটি এ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। নতুন করে আবারও পূবালী ব্যাংকের স্থান করে নেওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নেওয়া নানা ধরনের পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদ—উভয় ক্ষেত্রেই সুশাসনের চর্চা রয়েছে। ব্যাংকের টেকসই অবস্থান নিশ্চিত করতে একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর ‘সাসটেইনেবল ফিন্যান্স কমিটি’ কাজ করে। এ ছাড়া প্রতিটি খাতের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে একাধিক উপকমিটি। এই কমিটিগুলো ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণ করে থাকে। কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়মিত প্রতিবেদন জমা দেয়। সার্বিকভাবে কাজগুলো দেখভাল করে ব্যাংকের ‘সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ইউনিট’। 

গত বছরের শুরু থেকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পূবালী ব্যাংক টেকসই অর্থায়ন, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রম ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়নে মনোযোগ বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে মূল ব্যাংকিং কার্যক্রমের টেকসই সূচক; যেমন আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ, খেলাপি ঋণ কমানো ও মূলধন পর্যাপ্ততা বজায় রাখতেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকিং সেবার বিস্তারেও কাজ করছি আমরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ডেটাবেজ তৈরি করা। পূবালী ব্যাংক নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করে কোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ জন্য সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ডেটাবেজকে মূল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা ও দেশব্যাপী যোগাযোগের কারণে পূবালী ব্যাংক বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহত্তম অনলাইন ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। 

টেকসই প্রকল্পে অর্থায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে পূবালী ব্যাংক। যেমন ডেকো লিগ্যাসি গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আগামী অ্যাপারেলসে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছেন। বর্তমানে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করা এই প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে অ্যাকর্ড স্ট্রাকচারাল সেফটি সনদ এবং মার্কিন গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের ‘লিড গোল্ড’ সনদ পেয়েছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে টেকসই খাতে ঋণ দিয়েছে পূবালী ব্যাংক। 

টেকসই খাতে আরও নানা উদ্যোগ রয়েছে পূবালী ব্যাংকের। ২০২৪ সালে সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয় ব্যাংকটি। তার অংশ হিসেবে পূবালী ব্যাংকের ৫৬৬টি এটিএম বুথের মধ্যে ৩০০টি এবং ৫০৮টি শাখার মধ্যে ৩২০টি শাখায় সোলার পাওয়ার সংযোগ স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সব শাখায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ‘থ্রি আর’ নীতি (রিডিউস, রিইউস, রিসাইকেল) বাস্তবায়ন, অনলাইনে ঋণ প্রস্তাব প্রেরণ, অনুমোদনসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 

সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রমেও ব্যাংকটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। গত বছর উপকূলীয় এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৮ হাজার ৮০০টি গাছ লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি ৬৬ হাজার ১৬৮ জন উপকারভোগীর মধ্যে সিএসআর তহবিল থেকে অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। গ্রিন রি-ফিন্যান্সের প্রতিটি প্রকল্পেই পূবালী ব্যাংকের গ্রাহক পোর্টফোলিও রয়েছে। 

বর্তমানে পূবালী ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকেরা ব্যাংকে না গিয়েই অর্থ স্থানান্তর, আরটিজিএস, বিইএফটিএন, বিভিন্ন পরিষেবা বিল পরিশোধ, এফডিআর ও ডিপিএস ব্যবস্থাপনা, ঋণের আবেদনসহ সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা নিতে পারছেন। 

সর্বোপরি শীর্ষ সাসটেইনেবল ব্যাংকের তালিকায় পূবালী ব্যাংকের অবস্থানের পেছনে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দূরদর্শী নির্দেশনা, গ্রাহকের আস্থা, সুশাসন, কোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে ধারাবাহিক সাফল্য ও শক্তিশালী টেকসই অর্থায়ন কাঠামো প্রভৃতি বিষয় কাজ করেছে।

চৌধুরী আবদুল ওয়াহীদ
প্রধান, সিএমএসএমই বিভাগ ও সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ইউনিট, পূবালী ব্যাংক 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জ কর গ র হক ট কসই

এছাড়াও পড়ুন:

টেকসই খাতের ঋণ ব্যাংকের স্থিতিশীলতায় অবদান রাখছে

প্রথম আলো:

করপোরেট ঋণনির্ভর ব্যাংক হওয়ার পরও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক কীভাবে টেকসই ব্যাংকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। টেকসই খাতে আপনাদের ব্যাংক কেমন অর্থায়ন করেছে?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমাদের ব্যাংকের বড় একটি অংশ করপোরেট ঋণের ওপর নির্ভরশীল, এ কথা সত্য। তা সত্ত্বেও আমরা সব সময় সমান গুরুত্ব দিয়ে এসএমই, কৃষি, কুটির শিল্প ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থায়ন করে আসছি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি, যাতে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীও ব্যাংকিং সুবিধা পায়। টেকসই অর্থায়নের আওতায় আমরা সব ধরনের গ্রাহকের জন্য কার্যকর পণ্য ও সেবা চালু করেছি। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল ন্যানো ঋণ—একটি স্বয়ংক্রিয়, সহজলভ্য ও কাগজবিহীন ঋণ। এর ফলে গ্রাহকের ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটি বাস্তব উদাহরণ।

পরিবেশবান্ধব যাতায়াতব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে আমরা বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড যানবাহন ক্রয়ে ঋণ প্রদান করি। তা ছাড়া এসএমই খাতে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে ঋণ দিয়ে থাকি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবেশবান্ধব পুনঃ অর্থায়ন স্কিমের অধীন বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করছি। সব মিলিয়ে শুধু করপোরেট নয়, সব স্তরে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখছি, যার স্বীকৃতি হিসেবে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই রেটিংয়ে স্থান পেয়েছি। বলা যায়, টেকসই খাতের ঋণ ব্যাংকের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও বড় অবদান রাখছে।

প্রথম আলো:

আপনাদের ব্যাংকের সেবা তো নানা মাধ্যমে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কী পরিমাণ মানুষ আপনাদের সেবা পাচ্ছেন?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক সারা দেশে বহুমাত্রিক ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, এমটিবিতে ১৩ লাখ ৬১ হাজার গ্রাহকের হিসাব রয়েছে। তার মধ্যে ঋণ হিসাব ৪৫ হাজার ১৬৫টি। আমাদের ডেবিট কার্ড ৩ লাখ ৭৯ হাজার এবং ক্রেডিট কার্ড ১ লাখ ৪৬ হাজার গ্রাহক ব্যবহার করেন। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করেন ১ লাখ ৫৯ হাজার গ্রাহক। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে এমটিবি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ গ্রাহকের হাতে প্রযুক্তিনির্ভর ও আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে।

প্রথম আলো:

পরিবেশের ওপর আপনাদের উদ্যোগগুলোর প্রভাব কেমন?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: নানা উদ্যোগ আমাদের ব্যাংকিং সেবাকে আরও আধুনিক, সহজ ও টেকসই করে তুলেছে। ডিজিটাল সেবার বিস্তারে গ্রাহকদের সময়, অর্থ ও ভোগান্তি কমেছে। এতে গ্রাহক সন্তুষ্টি যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে মানুষের আরও কাছে। পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম, যেমন সৌরবিদ্যুৎ–চালিত শাখা, কাগজবিহীন ব্যাংকিং, ই-স্টেটমেন্ট, জ্বালানি ও পানি-সাশ্রয়ী অফিস পরিচালনা—এসবই আমাদের পরিবেশ সচেতনতা এবং পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালু করি, যেখানে আমাদের কর্মীরা নিজেরাই অংশ নেন এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী উপহার দেন। এ ছাড়া আমরা গ্রাহকদেরও পরিবেশবান্ধব ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে উৎসাহিত করি, যা ভবিষ্যতের টেকসই ব্যাংকিং নিশ্চিত করে।

প্রথম আলো:

স্কুলশিক্ষার্থীদের বাইসাইকেল উপহার দিয়ে থাকেন আপনারা। এমটিবির সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) উদ্যোগগুলোর প্রভাব সমাজে কেমন পড়েছে?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: স্কুলশিক্ষার্থীদের বাইসাইকেল উপহার দিয়ে থাকেন আপনারা। এমটিবির সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) উদ্যোগগুলোর প্রভাব সমাজে কেমন পড়েছে।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: স্কুলশিক্ষার্থীদের সাইকেল উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা তাদের স্কুলে যাতায়াতকে সহজ করে দিয়েছি, যা শিক্ষার্থীদের স্কুল উপস্থিতি বাড়াতে এবং ঝরে পড়া কমাতে সহায়তা করছে। আমাদের সিএসআর কার্যক্রম আরও বিস্তৃত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি খাতে আমরা নিয়মিত সিএসআর তহবিল ব্যয় করছি। উদাহরণস্বরূপ, উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ গাছ রোপণের মাধ্যমে আমরা জলবায়ু সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছি। দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীল ব্যাগ বিতরণ, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা (বিশেষত স্কুলে) এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজিত কৃষি প্রশিক্ষণ—এসবই আমাদের সমাজবান্ধব ব্যাংকিংয়ের দৃষ্টান্ত। সব মিলিয়ে এমটিবির সিএসআর কার্যক্রম সমাজে টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তুলছে মানবিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টেকসই খাতের ঋণ ব্যাংকের স্থিতিশীলতায় অবদান রাখছে