মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে পাকিস্তানের প্রতি আক্রমণ করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মিথ্যা আর প্রতারণা ছাড়া কিছুই দেয়নি’ এই দেশটি।

পরে অবশ্য ট্রাম্প পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে নরম মনোভাবের জন্য সেই দেশের নেতাদের অভিযুক্ত করতেই থাকেন।

এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী অংশীদারত্বকে ‘দারুণ’ বলে উল্লেখ করছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর প্রধান হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিয়েছেন।

আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, খনিজ ও তেল খাতে তাদের সঙ্গে বড় মুনাফার চুক্তি করবেন। যদিও পাকিস্তানি কর্মকর্তারা নিশ্চিত নন, ট্রাম্প যে জ্বালানির ‘বড় মজুতের’ কথা বলছেন, তা আদৌ কোথায় আছে।

তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, পাকিস্তান আবারও ওয়াশিংটনের প্রিয় তালিকায় উঠে এসেছে। বহু দশক ধরে দুই দেশের সম্পর্কের এই পারদ ওঠা-নামা করছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে।

ভারত একসময় ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা হয়েছে ১৯ শতাংশ।

ভারত একসময় ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা হয়েছে ১৯ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি বলেন, ‘হঠাৎ করেই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে উষ্ণতা এসেছে, যা কেউই আশা করেনি।’

এই উষ্ণতার আংশিক কারণ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে পাকিস্তান দুটি দ্রুত সাফল্য দেখিয়েছিল।

গত মার্চে পাকিস্তান ইসলামিক স্টেটের এক শীর্ষ নেতাকে আটক করেছে। ওই নেতার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বোমা হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ রয়েছে। ওই হামলায় ১৮০ জনের বেশি নিহত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে ১৩ জন মার্কিন সেনা ছিলেন। ওই ব্যক্তিকে আটকের জন্য ট্রাম্প কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে পাকিস্তানের নামোল্লেখ করেন।

গেল বসন্তে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছিল, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেবে। কারণ, তিনি ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাতে মধ্যস্থতা করেছেন। অবশ্য নয়াদিল্লি ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি বারবার নাকচ করে বলেছে, তাদের যুদ্ধবিরতিতে ওয়াশিংটনের কোনো ভূমিকা ছিল না।

গেল বসন্তে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছিল, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেবে। কারণ, তিনি ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাতে মধ্যস্থতা করেছেন। অবশ্য নয়াদিল্লি ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি বার বার নাকচ করে বলেছে, তাদের যুদ্ধবিরতিতে ওয়াশিংটনের কোনো ভূমিকা ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের কেন্দ্রীয় চরিত্র পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল সৈয়দ আসিম মুনির। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংঘাতের পর থেকে আরও প্রকাশ্য ভূমিকা নিয়ে সামনে এসেছেন তিনি। এই সপ্তাহে ফিল্ড মার্শাল মুনির মার্কিন জেনারেল মাইকেল কুরিলার অবসরে যাওয়ার অনুষ্ঠানে অংশ নেন। কুরিলার মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।

দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এটি ছিল পাকিস্তানি ফিল্ড মার্শালের যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় উচ্চপর্যায়ের সফর। (অথচ পাকিস্তানের বেসামরিক নেতা, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এখনো ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।)

গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নত করার ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে এমনটা দাবি করে আসছিলেন।

২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে পাকিস্তান উঠে আসে। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক ছিল উত্থান-পতনে ভরা। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে। আল–কায়েদার এই শীর্ষ নেতা দীর্ঘদিন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে লুকিয়ে ছিলেন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পায় যে পাকিস্তান দ্বিমুখী খেলা খেলছে।

আবার পাকিস্তানের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষুব্ধ। কারণ, তারা মনে করে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করেছে। তারাই পাকিস্তানকে সন্ত্রাসীদের নিশানা বানিয়েছে, যার ফলে দেশে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

তবে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে সম্পর্ক গড়ার সুযোগ এনে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র কি কারও নির্ভরযোগ্য মিত্র হতে পারে? ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে মোদি বিনিয়োগ করেছিলেন। আর এখন দেখুন মোদির কী অবস্থা। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কেন আলাদা হবে?—হুসেইন হাক্কানি, পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

পাকিস্তানি কর্মকর্তারা দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ খনিজের উৎস এবং বিটকয়েন খনির কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। গত এপ্রিল মাসে ট্রাম্প-সমর্থিত একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের ক্রিপ্টো কাউন্সিলের সঙ্গে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছে। ওই প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতারা পাকিস্তান সফরকালে ওই চুক্তি করেন।

পাকিস্তান আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি বেশি পণ্য আমদানি করবে, যার মধ্যে তুলাও রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের খনির প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দেবে তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নতুন সম্পর্ক দীর্ঘ মেয়াদে কতটা ফল দেবে, তা স্পষ্ট নয়। যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি বা গুরুত্বপূর্ণ খনিজের চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে।

ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ থ্রেলকেল্ড বলছিলেন, সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা ছাড়া নিকট–ভবিষ্যতে পাকিস্তান আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিতে পারবে, তা পরিষ্কার নয়।

ট্রাম্প পাকিস্তানের তেল মজুত উন্নয়নের ঘোষণা দিয়ে আরও নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন।

ইসলামাবাদভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর রিজিওনাল স্টাডিজের সভাপতি জওহর সেলিম বলেন, ট্রাম্প যদি এমন কিছু সম্পর্কে সচেতন না হন, যা সম্পর্কে আমরা জানি না—তাহলে তিনি আসলে কোন ধরনের মজুতের কথা বলছেন, তা একেবারেই পরিষ্কার নয়।

পাকিস্তানের চীন ঘনিষ্ঠতাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের পথে বাধা হতে পারে। চীন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। গত মাসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির চীন সফরে গেলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই দুই দেশকে ‘অটুট বন্ধুত্বের’ দেশ বলে অভিহিত করেন।

চীন–পাকিস্তানের অংশীদারত্ব এখন আরও ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতার দিকে এগোচ্ছে। পাকিস্তান এখন চীনের তৈরি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে। বলা হচ্ছে, গত মে মাসে চীনের তৈরি বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবহার করে তারা অন্তত একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। ওয়াশিংটনে উড়াল দেওয়ার কয়েক দিন আগে ফিল্ড মার্শাল মুনির চীন থেকে ১০টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার পেয়েছেন।

পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি বলছিলেন, ‘পাকিস্তানে চীনের বিনিয়োগ বা আমাদের প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণের ক্ষমতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পাল্লা দিতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক কখনোই ধারাবাহিক ছিল না।’

আরও কিছু বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলছেন, দুই দেশের এই উষ্ণতা কত দিন টিকে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের আরেক সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি বলেন, ‘ট্রাম্পের খাতায় ভালো থাকার সুবিধা আছে। আপনি তাঁর প্রশংসা করুন, তিনিও আপনার প্রশংসা করবেন।’

হাক্কানি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি কারও নির্ভরযোগ্য মিত্র হতে পারে? ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে মোদি বিনিয়োগ করেছিলেন। আর এখন দেখুন মোদির কী অবস্থা। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কেন আলাদা হবে?’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র স কর মকর ত র ঘন ষ ঠ কর ত র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

কোটিপতি হলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করেন তিনি

পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের অনেকে কায়িক পরিশ্রম ছেড়ে দেন। আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। কিন্তু সবাই তা করেন না। এমন একজন জাপানের কোইচি মাতসুবারা। ৫৬ বছর বয়সী এই জাপানি নাগরিকের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি ইয়েন (প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা) হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন।

মাতসুবারা সপ্তাহে তিন দিন, প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে কাজ করেন। তিনি সরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এ কাজ থেকে মাতসুবারা মাসে ১ লাখ ইয়েন (প্রায় ৮২ হাজার ৬৪ টাকা) আয় করেন, যা টোকিওর গড় বেতনের তুলনায় অনেক কম। তারপরও তিনি এ কাজ করেন। কারণ, তিনি এটাকে শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক প্রশান্তির উপায় হিসেবে দেখেন।

মাতসুবারা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ী ছিলেন। মাধ্যমিকের পর তিনি একটি কারখানায় মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ইয়েন (প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) বেতনে কাজ শুরু করেন। খরচ বাঁচিয়ে কয়েক বছরে প্রায় ৩০ লাখ ইয়েন (২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা) সঞ্চয় করে তিনি প্রথম স্টুডিও ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।

পরে বাড়ি কেনার ঋণ আগেভাগে পরিশোধ করে ধীরে ধীরে আরও ফ্ল্যাট কেনেন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন মাতসুবারা। এখন টোকিও ও এর শহরতলিতে তাঁর সাতটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার সবই ভাড়া দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন।

ধনবান হলেও মাতসুবারা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। এখনো তিনি সস্তা ফ্ল্যাটে থাকেন, নিজের খাবার নিজে বানান, নতুন জামাকাপড় কেনেন না, সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং প্রধানত সাইকেলে চলাচল করেন। তাঁর জীবনদর্শন—‘প্রতিদিন কিছু না কিছু করার আশা করি, সুস্থ থাকতে চাই এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে চাই।’

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে মাতসুবারাকে ‘অদৃশ্য কোটিপতি’ বলে উল্লেখ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। জাপানে ধনীদের এমন সাধারণ জীবনধারা অস্বাভাবিক নয়। দেশটিতে সাদাসিধে জীবনযাপন অনেকের মধ্যে দেখা যায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ