সমষ্টিগত অবচেতন তথা কালেকটিভ আনকনশাসের ধারণা প্রথম পাওয়া যায় বিশ্লেষণভিত্তিক মনোবিজ্ঞানের জনক, সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইউংয়ের বদৌলতে। ব্যক্তিগত অবচেতন, যা কিনা ভুলে যাওয়া বা দমিত করা অভিজ্ঞতার ভান্ডার, তার মতোই সমষ্টিগত অবচেতন হলো এমন এক মানসস্তর, যা ‘সব মানুষের মধ্যে অভিন্ন’ এবং যেখানে আছে ‘সমষ্টিগত প্রকৃতির চিত্র ও রূপ, যা পৃথিবীর সব প্রান্তে পুরাণের উপাদান হিসেবে এবং একই সঙ্গে অবচেতন সৃষ্টিতে পুনরায় প্রকাশিত হয়।’ এই অবচেতনের কেন্দ্রীয় উপাদানের নাম তিনি দেন আর্কিটাইপ অর্থাৎ প্রাক্‌-মানবিক কালের সঞ্চিত প্রতীক, কাহিনি কাঠামো ও ভাবচিত্র, যা মানব কল্পনার ভিত গড়ে দেয়। ইউংয়ের মতে, শিল্পী প্রায়ই কেবল ব্যক্তিগত স্রষ্টা নন; তিনি সমষ্টিগত মনের বাহন। শিল্প কতটা অবচেতন আর কতটা সচেতন ক্রিয়া, তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তবে যদি মানবসত্তার কল্পনার রূপরেখা ও শিল্পকর্মের ওপর তার প্রভাব আমরা বিবেচনায় আনি, অবচেতন মনের প্রভাব সুস্পষ্ট ও দৃঢ়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইউংয়ের এই মতামত বা ‘সমষ্টিগত অবচেতন’ শিল্পকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ঠিক কীভাবে প্রভাবিত করে এসেছে বা এই ‘সমষ্টি’ ঠিক কতটা প্রকট?

শুরুতেই বলেছি আর্কিটাইপের কথা। ইউং আর্কিটাইপকে বর্ণনা করেন এভাবে যে এগুলো নির্দিষ্ট কোনো ধারণা নয়; বরং ধারণা গঠনের সম্ভাবনা, যা মানবজাতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তৈরি। যার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাতা আর্কিটাইপের প্রকাশ মিসরের দেবী আইসিসে যেমন আছে, তেমনি আছে খ্রিষ্টীয় শিল্পে ভার্জিন মেরি বা হিন্দু দেবী পার্বতীতে। আবার জোসেফ ক্যাম্পবেল তাঁর ‘দ্য হিরো উইথ আ থাউজ্যান্ড ফেসেস’ গ্রন্থে বলেন, এমন মোটিফ শিল্পে এলে তা দর্শকের মনে স্বতঃসিদ্ধ এক পরিচিত অনুভূতি জাগায়, যা উইংয়ের তত্ত্বেরই অন্য রূপ।

সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়াকে উইং যেভাবে দেখেন, তার মানে অনেকটা দাঁড়ায়—শিল্পী প্রায়ই সচেতনভাবে জানেন না তিনি কোন প্রতীক আহ্বান করছেন, তবু তা গভীর মানসিক কাঠামোর সঙ্গে মিলে যায়।

সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়াকে উইং যেভাবে দেখেন, তার মানে অনেকটা দাঁড়ায়—শিল্পী প্রায়ই সচেতনভাবে জানেন না তিনি কোন প্রতীক আহ্বান করছেন, তবু তা গভীর মানসিক কাঠামোর সঙ্গে মিলে যায়। উদাহরণ হিসেবে, পশ্চিমা শিল্পে এডভার্ড মুঙ্কের দ্য স্ক্রিম (১৮৯৩) অস্তিত্বগত আতঙ্কের আর্কিটাইপিক রূপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যেখানে বিকৃত মুখাবয়ব ও রক্তিম আকাশ শ্যাডো আর্কিটাইপকে স্মরণ করায় যা কার্ল ইউংয়ের মতে, মানুষের অবচেতনের সেই অংশ, যা আমরা সচেতনভাবে অস্বীকার করি বা দমন করে রাখি। প্রায়ই এতে থাকে ভয়, হিংসা, কামনা, সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ প্রবৃত্তি, তবে এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে সৃজনশীল শক্তিও। একে তিনি বর্ণনা করেছেন, দ্য থিং আ পারসন হ্যাজ নো উইশ টু বি হিসেবে। আবার পাবলো পিকাসোর গোয়ের্নিকা (১৯৩৭) মৃত্যুর ও ধ্বংসের আর্কিটাইপকে ধারণ করে, যেখানে যুদ্ধকে কেবল ঐতিহাসিক নয়, সর্বজনীন মানসিক আঘাত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। 

এ ছাড়া যদি আমরা দক্ষিণ এশীয় শিল্পীদের কথা বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলায় প্রায়ই অর্ধ–অবচেতন প্রতীকী রূপ দেখা যায়, যার মধ্যে অতিপ্রাকৃত মুখ, অদ্ভুত দেহের বিন্যাস অন্যতম; যার সঙ্গে ইউংয়ের অ্যানিমা বা ওয়াইজ ওল্ডম্যান আর্কিটাইপের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা সমষ্টিগত অবচেতনের এমন এক প্রতীক, যেটি প্রজ্ঞা, পরামর্শ, নৈতিক দিকনির্দেশনা এবং আধ্যাত্মিক সত্যের বাহক হিসেবে মানুষের কল্পনায় পুনঃপুন প্রকাশ পায়। ইউং একে দ্য পারসোনিফিকেশন অব দ্য মিনিং অব লাইফ হিসেবে বর্ণনা করেন। 

‘মাদার’ ও ‘হিরো’ আর্কিটাইপ বলে দুটি ধারণা ইউংয়ের কাজে আমরা দেখতে পাই, যা যথাক্রমে, মাতৃ প্রতিমূর্তি সমষ্টিগত অবচেতনের এক অন্যতম প্রধান প্রতীক, যা লালন, সুরক্ষা, উর্বরতা ও জীবনের উৎসকে ধারণ করে এবং হিরো আর্কিটাইপ নির্দেশ করে—বীর প্রতিমূর্তি, ইউংয়ের ভাষায়, যা মানুষের সম্মিলিত কল্পনায় সাহস, আত্মত্যাগ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রতীক। এ দুটির রূপায়ণ দেখা যায় যামিনী রায়ের লোকশিল্প-প্রাণিত রেখা ও রঙের ব্যবহার, বিশেষ করে কৃষ্ণলীলা বা মাতৃত্বের চিত্রের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া নকশি কাঁথার মোটিফ যেমন সর্পিল নকশা, বৃক্ষ, পাখি, সূর্য প্রায়ই প্রাচীন আর্কিটাইপের প্রতিধ্বনি, যা বাংলার লোকস্মৃতি ও বৈশ্বিক প্রতীকের সংমিশ্রণ।

মাতৃ প্রতিমূর্তি সমষ্টিগত অবচেতনের এক অন্যতম প্রধান প্রতীক, যা লালন, সুরক্ষা, উর্বরতা ও জীবনের উৎসকে ধারণ করে এবং হিরো আর্কিটাইপ নির্দেশ করে—বীর প্রতিমূর্তি, যা মানুষের সম্মিলিত কল্পনায় সাহস, আত্মত্যাগ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রতীক। কার্ল ইউং (জন্ম: ২৬ জুলাই, ১৮৭৫—মৃত্যু: ৬ জুন, ১৯৬১).

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউ য় র ন আর ক

এছাড়াও পড়ুন:

নানা জটিলতার মধ্যে শনিবার নিটিং ওনার্স এসোসিয়েশনের নির্বাচন

অবশেষে নানা জটিলতার মধ্যেই শনিবার (১৬ আগস্ট) বাংলাদেশ নিটিং ওনার্স এসোসিয়েশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যদিও এ নিয়ে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।

যদিও প্রার্থীদের দাবির মুখে ৭১ জনের মধ্যে ২৫ জন ভুয়া ভোটার বাতিল করা হয়েছে। বাকীরা রয়ে গেছে। সেই ভুয়া ভোটার নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে প্রার্থীদের মধ্যে।

জানা যায়,  বর্তমান কার্যকরী কমিটি বাণিজ্য মন্ত্রনালয় থেকে কমিটির মেয়াদ ২ মাস বাড়িয়ে আগামি ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সময় নিয়ে আসে। সেই মোতাবেক ১১ আগস্টের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার বিধি বিধান ছিল। ফলে ৯ আগস্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন ধার্য্য ছিল।

কিন্তু ৭ আগস্ট দিবাগত রাতে নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ থেকে আনিসুর রহমান সানি পদত্যাগ করেন। এতে করে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান। রাতেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতাকারী প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে ৯ আগস্ট নির্বাচন হচ্ছে না।

কিন্তু পরদিন ৮ আগস্ট প্রার্থীরা নোটিশ বোর্ডে দেখতে পায় নির্বাচন বোর্ডের কমিশনার মো: স্বপন চৌধুরীকে নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান করে ৯ আগস্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঠিক রাখা হয়। এই ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে।

পরে ৮ আগস্ট সকালে বাদশা নামে একজন ভোটার নির্বাচন পরিচালনা বোর্ড বরাবর লিখিত আবেদন করেন। পরে ওইদিন বিকালে নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরী ৭দিন পিছিয়ে নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারন করে ১৬ আগস্ট।

এদিকে প্রার্থীদের দাবির মুখে ১৩ আগস্ট বর্তমান কার্যকরী কমিটি ৭১ জন ভুয়া ভোটারের মধ্যে ২৫ জন ভুয়া ভোটার বাতিল করেন। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি বিধান উপক্ষো করে ১৬ আগস্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানকে আইনসম্মতভাবে দেখছেন না প্রার্থী ও সাধারণ ভোটাররা।

এ বিষয়ে নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ১৬ আগস্ট নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কেউ কোন লিখিত অভিযোগ বা অনুযোগ করেনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ