শেখ মুজিব যেভাবে ‘দ্বিতীয়বার’ খুন হলেন
Published: 15th, August 2025 GMT
আমরা কথা বলছি ১৫ আগস্ট নিয়ে। আজ কারও চোখে ‘বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী’, কারও কাছে ‘নাজাত দিবস’। দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এ দেশে একটা রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গৃহযুদ্ধ চলছে ষাটের দশক থেকেই। একদল মনে করেন, ‘শেখ মুজিব না জন্মালে বাংলাদেশ হতো না’। আরেক দল মনে করেন, মুজিব হচ্ছেন ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’।
এক দল মুজিবের মাজার গড়ে তাঁর বন্দনায় ব্যস্ত। অন্য দলটি তাঁর বাড়ি-ভাস্কর্য ভাঙেন। তাঁরা একে অপরের ধ্বংস চান। দুই দলেই আছেন বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী। বিপরীত মেরুর এই চিন্তার মধ্যে একটা নিষ্পত্তির সম্ভাবনা অকল্পনীয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আওয়ামী লীগের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ মনে করতেন বাঙালির ‘পয়লা নম্বর শত্রু’ আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে মনে করতেন ‘দুই নম্বর শত্রু’। অনুগতরা তো সব সময় সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, প্রশস্তিগাথা লেখেন।
কেউ কেউ বলেন, একটি লোক কেমন তা জানতে হলে তার শত্রু কী বলে, সেটি জানা দরকার। শত্রুর চোখে কেমন ছিলেন মুজিব? তাঁর সম্পর্কে এই দুই ‘শত্রু’ কী বলেছেন, তা উল্লেখ করছি।
আরও পড়ুন১৫ আগস্ট ১৯৭৫: কেন সেদিন প্রতিরোধ হলো না২৯ আগস্ট ২০২২ভুট্টো বলছেন: একাত্তরের জানুয়ারিতে যখন ঢাকায় যাই, তখন আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোভাবে জানতে এবং বুঝতে পেরেছি। তাঁকে আমার মনে হলো অসম্ভব বিনয়ী। যে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে, সেসব নিয়ে তিনি যুক্তিসহকারে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলেন। যেসব ব্যাপারে তাঁর ধারণা নেই, সে বিষয়গুলো তিনি অল্প কথায় সারেন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ভাসা-ভাসা এবং কিছু মৌলিক বিষয়কে খুব সহজ চোখে দেখেন। আমার ধারণা ভুল হতে পারে, যদিও মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনো পূর্বসংস্কার নেই।…মুজিবের কাছে ন্যায্যতা হলো বাংলার স্বাধীনতা আর আমার কাছে হলো পাকিস্তান টিকিয়ে রাখা; মুজিব মনে করেন ছয় দফা হলো জনগণের সম্পত্তি, আমার কাছে জনগণের সম্পদ হলো পাকিস্তান। আমাদের মতাদর্শ ছিল সাংঘর্ষিক (জুলফিকার আলী ভুট্টো, দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি)।
মুজিব সম্পর্কে ইয়াহিয়ার ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত: মুজিবকে আমি আবেগতাড়িত, প্রচারসর্বস্ব ও অপরিপক্ব লোক মনে করি। ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর শুরু। সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি। সোজা কথায়, তিনি হলেন একজন আন্দোলনকারী। চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তাঁর নেই। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তাঁকে খুব সহজেই প্রলোভিত করা যায়। তাঁর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, তিনি কথা রাখেন না। তাঁর ওপর ভরসা করা যায় না। মুজিব সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হলো, নিজেকে যতই চালাক এবং অন্যের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে বলে মনে করুন না কেন, আসলে তিনি বোকা। যেকোনো সুবিধাবাদী লোক তাঁকে প্রতারিত করতে পারে। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এবং ভুট্টোর ফাঁদে পড়েছেন। তাঁকে নিয়ে কে কী করছে, এটা তিনি বোঝেননি (১৯৭৮ সালে লাহোর হাইকোর্টে রিট আবেদনে সংযুক্ত ইয়াহিয়া খানের জবানবন্দি)।
আরও পড়ুন১৫ আগস্ট: আসল সত্য জানা জরুরি২৩ আগস্ট ২০২২ভুট্টো পাকিস্তান ভাঙার জন্য মুজিবকে দায়ী করেছেন। ইয়াহিয়া পাকিস্তান ভাঙার জন্য মুজিব এবং ভুট্টো উভয়কেই দায়ী করেছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব দেশের প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে দর-কষাকষির ম্যান্ডেট পান। আলোচনা ভেঙে গেলে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী হামলা চালায়। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তানে যান। অন্যরা গ্রেপ্তার এড়িয়ে যান ভারতে।
রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির (পরে নাম হয় কমিউনিস্ট পার্টি) অন্যতম নেতা গিওর্গি ভ্যালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ ১৮৯৮ সালে ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা নামে একটি বই লেখেন। তাঁর মতে, মানুষ তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলির কারণে ইতিহাসে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। তাঁর মধ্যে এমন সব গুণের সমাবেশ ঘটে, যার ফলে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মহান। তাঁরা হলেন ‘মেন অব ডেসটিনি’। তাঁরা এমন সব চিন্তা নিয়ে আসেন, মানুষের মনোজগতে যা প্রচ্ছন্ন থাকে। তাঁরা এটাকে নাড়া দেন, উসকে দেন, ধারালো করেন। মুজিব এ কাজটা করেছিলেন।
পঁচাত্তরের পরে মুজিবের ভাবমূর্তি যেটুকু পুনরুদ্ধার হয়েছিল, হাসিনার বাড়াবাড়িতে সেটি ধসে যায়। আওয়ামী বলয়ের বাইরে নাগরিকদের কাছে হাসিনা ফ্যাসিস্ট। আর মুজিব হয়ে যান ফ্যাসিবাদের আইকন। হাসিনার অপশাসনের দায় মুজিবের নয়। যেহেতু হাসিনা মুজিব নামক বটিকা ফেরি করে দেশ শাসন করতেন, স্বাভাবিকভাবেই মুজিব গণরোষের শিকার হন।মুজিব অনুপস্থিত থাকলেও তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। গ্রামের মানুষ তাঁর জন্য নফল রোজা রেখেছে। একসময় দেশ পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়েছে। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব দেশে ফিরে সরকারের হাল ধরেন। এ পর্বের তিনিই নায়ক।
বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর, এ সময়টা ছিল টালমাটাল। দেশটা গরিব। মানুষের আকাঙ্ক্ষা আকাশছোঁয়া। রাষ্ট্র নতুন। জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মুজিব তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি। রাষ্ট্র ও সরকারের সে সক্ষমতা ছিল না। ছিটেফোঁটা কিছু আইন বানিয়ে এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় মনোরম শব্দাবলি বসিয়ে ঔপনিবেশিক কাঠামো এবং স্থিতাবস্থা রেখে দেন তিনি। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকারি দলের লোকেদের লুটপাট আর সন্ত্রাস, বিরোধী দলের দায়িত্বহীন আচরণ, দুর্ভিক্ষ সামলাতে সরকারের ব্যর্থতা, একদলীয় ‘বাকশাল’ সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিজের হাতে সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া, সামরিক-অসামরিক দ্বন্দ্ব—এগুলোই একটা ভয়ংকর পরিবর্তনের শর্ত তৈরি করে দিয়েছিল। চাটুকার পরিবেষ্টিত মুজিব মানুষের মন বুঝতেই পারেননি। পরিবর্তনটি এল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট।
গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের দিন তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যটি ছাত্র–জনতা ভেঙে ফেলে। রাজধানীর বিজয় সরণি।.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম জ ব র রহম ন ত তর র আগস ট সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
জয়পুরহাটে গভীর নলকূপের লাইনম্যানের হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার
জয়পুরহাটে গভীর নলকূপের এক লাইনম্যানের হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার (১৫ আগস্ট) ক্ষেতলাল উপজেলার বরাইল ইউনিয়নের কলিঙ্গা গ্রামের একটি ফসলি জমি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত আবু সাইদ (৬৫) ওই গ্রামেরই বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ওই গভীর নলকূপের লাইনম্যান ও পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
পুলিশ বলছে, নিহতের হাত-পা বাঁধা ও গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
চিরকুট: ‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’
কুমিল্লায় মা-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার
পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার রাতে আবু সাইদ নলকূপ পাহারা দেওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। তবে, শুক্রবার সকালে তিনি বাড়িতে ফেরেননি। পরে পরিবারের সদস্যরা তার মোবাইলে ব্যবহৃত নম্বরে যোগাযোগ করে না পেয়ে নলকূপের ঘরে গিয়ে তার হাত-পা বাঁধা মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
ক্ষেতলাল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল করিম বলেন, ‘‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জয়পুরহাট জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় পরবর্তী আইনি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।’’
ঢাকা/আব্দুল্লাহ/রাজীব