আলাস্কা শীর্ষ বৈঠক: ট্রাম্পের হার-জিত না হলেও বড় জয় পুতিনের
Published: 16th, August 2025 GMT
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল শুক্রবার যখন বিশ্বমঞ্চে পা রাখেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের অ্যাঙ্কোরেজ শহরের আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। স্থানীয় এলমেনডর্ফ–রিচার্ডসন সামরিক ঘাঁটির রানওয়েতে লালগালিচা বিছানো ছিল তাঁর জন্য। পুতিনকে বরণ করে নিতে আগে থেকে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট পুতিন পৌঁছানোর পর ট্রাম্প হাততালি দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। দুই নেতা উষ্ণ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাঁদের দুজনের মুখেই ছিল হাসি।
পুতিনের জন্য এটি ছিল বিশেষ এক মুহূর্ত। কারণ, ২০২২ সালে রাশিয়া পুরোদমে ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলো তাঁকে এড়িয়ে চলছিল। তখন থেকে তিনি খুব একটা বিদেশ সফরও করেননি। উত্তর কোরিয়া ও বেলারুশের মতো রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ কয়েকটি দেশের মধ্যে তাঁর সফর ছিল সীমাবদ্ধ।
আলাস্কায় পৌঁছানোর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এক সাংবাদিক চিৎকার করে পুতিনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আপনি কি সাধারণ মানুষদের হত্যা করা বন্ধ করবেন?’ এতে পুতিন বিরক্ত হয়েছেন কি না, বোঝা যায়নি। তিনি ওই প্রশ্ন উপেক্ষা করে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন।আলাস্কায় এ শীর্ষ বৈঠক হওয়াটাই পুতিনের জন্য একটি বড় জয়। তবে তিনি সেখানে যে ধরনের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন, তা ক্রেমলিনের কল্পনারও বাইরে ছিল। মাত্র ছয় মাস আগে পর্যন্ত পশ্চিমাদের চোখে তিনি ছিলেন ‘বর্জিত’ নেতা। আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তিনি একজন বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে অভ্যর্থনা পেয়েছেন।
বিদায়বেলায় একটি চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটেছে। পুতিন নিজের রাষ্ট্রীয় গাড়ি না নিয়ে ট্রাম্পের সাঁজোয়া লিমুজিনে চড়ে বিমানঘাঁটির দিকে যান। গাড়ি ছাড়ার সময় ক্যামেরায় ধরা পড়া দৃশ্যে দেখা যায়, গাড়ির পেছনের আসনে বসে তিনি হাসছেন।
বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি পুতিনরাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২৫ বছর ধরে পুতিন সংবাদমাধ্যমের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কেঁড়ে নিয়েছেন এবং তথ্যের জায়গায় মিথ্যা প্রচারণা ছড়িয়ে দিয়েছেন। রাশিয়ার ভেতরে তিনি সাধারণত কঠোর প্রশ্ন করা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না।
তবু আলাস্কায় পৌঁছানোর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এক সাংবাদিক চিৎকার করে পুতিনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আপনি কি সাধারণ মানুষদের হত্যা করা বন্ধ করবেন?’ এ প্রশ্নে পুতিন বিরক্ত হয়েছেন কি না, বোঝা যায়নি। তিনি এ প্রশ্ন উপেক্ষা করে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন।
আলাস্কার শীর্ষ বৈঠকটি হয়তো ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো বাস্তব অগ্রগতি দেখাতে পারেনি, তবে এতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উষ্ণতা বেড়েছে।অল্প সময়ের জন্য ফটোসেশন চলে। এরপর পুতিনের দিকে একের পর এক প্রশ্ন আসতে থাকে। এর একটি প্রশ্ন ছিল—পুতিন কি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে বসতে প্রস্তুত হবেন। পুতিন এ প্রশ্নেও কোনো সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখাননি। শুধু রহস্যময় হাসি দিয়েছেন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মীরা আলাস্কায় উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের আশা ছিল, বৈঠকের পর ট্রাম্প ও পুতিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন। কিন্তু তা হয়নি। দুই নেতা শুধু বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা সাংবাদিকদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন নেননি।
অপ্রত্যাশিতভাবে প্রথমে পুতিনই বক্তব্য দেন। তিনি বৈঠকের পরিবেশ নিয়ে প্রশংসা করেন। তাঁর কথায়, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে গঠনমূলক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। এরপর তিনি সংক্ষেপে আলাস্কার অতীত (রাশিয়ার অংশ থাকাকালীন) ইতিহাস তুলে ধরেন।
পুতিন কথা বলার সময় ট্রাম্প চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কয়েক মিনিট পর পুতিন ‘ইউক্রেন পরিস্থিতির’ উল্লেখ করেন, যেটি ছিল বৈঠকের মূল আকর্ষণ। তিনি বলেন, শান্তি চাইলে প্রথমে সংঘাতের ‘মূল সমস্যা’ দূর করতে হবে। তাঁর এ বক্তব্য কিয়েভসহ অন্য জায়গাগুলোর জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যুদ্ধের শুরু থেকে যে বিষয়গুলো পুতিন যুদ্ধবিরতির পথে বাধা বলে দাবি করে আসছেন, সেসবের একটি এটি।
পুতিনের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে আছে ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক কার্যকলাপ বন্ধে ইউক্রেনের সম্মতি, ইউক্রেনে বিদেশি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ না থাকা ও দেশটিতে নতুন নির্বাচন আয়োজন। কিয়েভের কাছে এগুলো আত্মসমর্পণের শামিল। তারা এগুলো মানতে রাজি নয়। তবে সাড়ে তিন বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পরও মস্কোর কাছে এখনো এগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
সব মিলে এটা পরিষ্কার যে বৈঠকে কোনো চুক্তি হয়নি।
আলাস্কায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল স ক য় ইউক র ন র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম
গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।
এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।
আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’
দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’
ব্যবসার শুরুরহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।
রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।
হকার থেকে এজেন্টকয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’
পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’